Cinque Terre

এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম

১২ মে , ২০২৫


প্রাবন্ধিক, সাবেক সভাপতি, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও সিলেট বিভাগে প্রদেশ আন্দোলন


অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১২টি কমিশন গঠন করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এর প্রধান হলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। তিনি গত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সরকারের  প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। যেখানে বাংলাদেশকে যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী এই চারটি প্রদেশে বিভক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন ও সুপারিশের পর থেকে ১২,৫৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১ কোটি ১১ লাখ জনবহুল, চা বাগান, বালু, পাথর, প্রাকৃতিক গ্যাস-তেল, ০২টি বৃহৎ বিমানবন্দর, ধান-মাছ সমৃদ্ধ হাওর, পাহাড়, টিলা ও নদী বেষ্টিত, প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় নানা প্রশ্ন, সন্দেহ, সংশয়, দুঃখবোধ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। 

১৯৪৭ সালের ০৬-০৭ জুলাই অনুষ্ঠিত গণভোটের মধ্য দিয়ে ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিলেট জেলা তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেয়। যা ছিল ভারতবর্ষের দিনলিপিতে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনা। সিলেট জেলা ও পাশর্^বর্তী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ভারতের আসামে থাকবে, না নতুন দেশ পাকিস্তানভুক্ত হবে এ নিয়ে মানুষের মতামত নিতে গণভোটের আয়োজন করা হয়। মুসলিম লীগ পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে কুড়াল প্রতীকে এবং কংগ্রেস ভারতের আসাম প্রদেশে থেকে যাওয়ার অনুকূলে কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রচারণায় অবতীর্ণ হয়। সমসাময়িক রাজনীতির কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগ তাদের বাক্সে ভোট দিতে মুসলমান; এবং কংগ্রেস হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ভারতে থেকে যাওয়ার পক্ষাবলম্বনের আহ্বান জানাতে থাকে। সেক্ষেত্রে আসাম মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল ব্যতিক্রম। তিনি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সিলেট জেলা ও সংলগ্ন এলাকার পূর্ব বাংলায় একীভূত হওয়াকে সমর্থনের আহ্বান জানান। উল্লেখ করা  প্রয়োজন যে, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বাংলা প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে ভাগ হয়ে যায় এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পুনরায় এক হয়ে বাংলা প্রদেশ নাম ফিরে পায়। 

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ একে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর প্রস্তাবিত নতুন রাষ্ট্রে পূর্বাংশের নাম পূর্ববাংলা হিসেবে আলোচনা হতে থাকে এবং তদনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রদেশটি পূর্ববাংলা নামে অভিহিত হয়। ১৯৫৫ সালের ২৪ অক্টোবর পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তনক্রমে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। যাই হোক, সনাতন ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য সকল মহলে ছড়িয়ে দিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন ভাদেশ^র পূর্বভাগ নিবাসী আসামের মন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী। এই বক্তব্যটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ্য হলে মওলানা ভাসানীকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং গণভোট অনুষ্ঠানের সপ্তাহদিন পূর্বে তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পান। এতদসত্ত্বেও গণভোটে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তখন সিলেট জেলায় সিলেট, করিমগঞ্জ, দক্ষিণ সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ নামে পাঁচটি মহকুমা ছিল। ভোটের গণরায় অনুযায়ী করিমগঞ্জ মহকুমাসহ পাশর্^বর্তী অঞ্চল বর্তমানের বাংলাদেশে অন্তর্গত হওয়ার কথা থাকলেও বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কারণে করিমগঞ্জ আজ ভারতের একটি সীমান্ত জেলা। এই হলো সিলেটবাসীর দুর্ভাগ্য। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সিলেটকে একটি পৃথক প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার দাবি, আশ^াস ও আলোচনা ছিল প্রবল। কিন্তু সেই দাবি পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ আমলে কখনো আলোর মুখ দেখেনি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সিলেট বিভাগকে প্রদেশ করার যৌক্তিক দাবি এবারেও উপেক্ষিত ও প্রত্যাখ্যাত হলো। 

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনির্ভাসিটিতে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আলী রীয়াজকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা সংবিধান সংস্কার কমিশন ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। আইনসভায় উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ বুঝানোর জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস নামে পরিচিত। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষের নাম সিনেট এবং নিম্নকক্ষ হচ্ছে হাউস অব রিপ্রেন্টেটিভস। দুইকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রধানত ফেডারেল স্টেটে হয়ে থাকে। ইউনিটারি স্টেটে আইন পরিষদ ব্যতিক্রম ছাড়া এককক্ষের হওয়া স্বাভাবিক। সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক একাধিক কক্ষের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার সুপারিশ গভীর তাৎপর্যময় ও ইঙ্গিতপূর্ণ। তাদের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্র সম্ভবত নিজ চরিত্রকে এককেন্দ্রীয়তা থেকে পরিবর্তন ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট গ্রহণে উদ্যোগী হচ্ছেন। যার অর্থ হলো এই যে, বালাদেশ রাষ্ট্রকে একাধিক প্রদেশে বিভক্ত করার বিষয়টি এখন আর দূরের কিছু নয় বরং নিকট আগত মাত্র। 

প্রায় ১৯ কোটি মানুষের  ১,৪৭,৬১০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট তুনামূলক ছোট দেশে ব্যয়বহুল প্রদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সুযোগ আর অবশিষ্ট থাকলো কোথায়। জনগণ প্রদত্ত ভ্যাট, ট্যাক্স, শুল্ক, টোল প্রভৃতি জমা হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। আবার দেশবাসীর মাথাপিছু দেনা বৃদ্ধি করে বিশ^ব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, এডিবি’র মতো সংস্থার কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণ প্রাপ্ত হয় সরকার। এভাবে সঞ্চয়িত জাতীয় তহবিল ভিত্তিক বাজেটের বহুলাংশ ব্যয় হয়ে যায় রাজধানীকেন্দ্রিক খাত সমূহে। অবশিষ্টাংশ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছায় অথবা নামমাত্র ব্যয়িত হয়। রাষ্ট্র কাঠামো প্রশাসনিক, রাজনৈতিকভাবে বিকেন্দ্রিভূত না হওয়ায় অঞ্চলভিত্তিক এই ব্যয় বৈষম্য। 

প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে যদি চারটি প্রদেশে ভাগ করা হয় কিন্তু সিলেট বিভাগকে পুনরায় চট্টগ্রাম প্রদেশের সাথে সম্পৃক্ত রাখা হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সিলেট বিভাগবাসীর বঞ্চনা, বৈষম্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হবে মাত্র। প্রদেশ বাস্তবায়িত হলে প্রাদেশিক রাজধানীতে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করা হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের  প্রাদেশিক প্রধান কার্যালয়। ইচ্ছা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলকে যেতে হবে সেখানে। এ প্রসঙ্গে স্মরণে রাখতে হবে যে, সড়ক পথে সিলেট নগরীর সাথে দেশের রাজধানী ঢাকার দূরত্ব হলো ২৩৭.৫০ কিলোমিটার। অপরদিকে চট্টগ্রামের সাথে সিলেটের ব্যবধান ৩৮০ দশমিক ২০ কিলোমিটার। এসকল দিক বিবেচনায় রেখে সিলেট বিভাগে প্রদেশ স্থাপনের সম্ভাব্যতা. উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।