সঞ্জয় কুমার নাথ
০৬ অগাস্ট , ২০২০
লেখক : গদ্যকার
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিরকালীন। তিনি না থেকেও প্রবলভাবে আছেন তাঁর গানে কবিতায়, সাহিত্যের নানা শাখায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেঁচে থাকার শৈল্পিক আশ্রয়। কবি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। মৃত্যু নিয়েও ছিল তাঁর অপার বিষ্ময়। অতি আপনজনের একাধিক মুত্যৃ তাঁকে জীবনভর বেদনা-বিষাদে জর্জরিত করেছে।
শৈশবে ভাই, কৈশোরে মা মারা যান। তরুণ বয়সে হারাতে হয় প্রিয়জন কাদম্বরী বৌঠানকে। অকালে মারা যায় পুত্র-কন্যা-স্ত্রী।
রবীন্দ্রনাথের এত প্রিয়জনের মৃত্যু দেখতে হয়েছে যে, মৃত্যু নিয়ে তাঁর অসংখ্য লেখা থেকে ‘মৃত্যুকে ভয় না মৃতুকে জয়’ এ দুটোর মধ্যে ‘রবীন্দ্রভাবনা’ ভীষণ ভাবনায় ফেলে দেয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান!’ আবার বলছেন, ‘ মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ এভাবে মৃত্যু নিয়ে রয়েছে কবির বিচিত্র প্রকাশ।
ছেলেবেলা থেকে ব্রহ্মদর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়েছিলেন তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়াও, এই দর্শনে দীক্ষিত হয়েই জীবন আর মৃত্যু নিয়ে তাঁর কাব্যে কিংবা গদ্যে নিজের একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল। জীবনের মধ্যে থেকে মৃত্যু আর দুঃখকে সহজে বরণ করার কথা তিনি বারবার বলেছেন।
উপনিষদ থেকে ভাবানুবাদ করা একটি শ্লোকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু চিন্তা ধরা দেয় এভাবেÑ‘শোনো বিশ্বজন, শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ/ দিব্যধামবাসী। আমি জেনেছি তাঁহারে মহান্ত পুরুষ যিনি/ আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়।/ তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি/ মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।’
১৯০০ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে মৃণালিনীকে মৃত্যু বিষয়ে লিখেছিলেন, ‘বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে। মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা তো নেই। শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।’
আবার ২ নভেম্বর ১৯২৪, রবীন্দ্রনাথ পরলোকগতা স্ত্রীকে স্মরণ করে আন্দেজ জাহাজে বসে লিখলেন, ‘...তোমার আঁখির আলো, তোমার পরশ নাহি আর,/ কিন্তু কী পরশমণি রেখে গেছ অন্তরে আমার/ ...সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,/ সব মানি সবচেয়ে মানি, তুমি ছিলে একদিন।’
২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫। শিলাইদহ থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘কিছুকাল থেকে মনে হচ্ছিল মৃত্যু আমাকে তার শেষ বান মেরেছে এবং সংসার থেকে আমার বিদায়ের সময় এসেছে।...কিন্তু যস্য ছায়ামৃতং তস্য মৃত্যুঃ-মৃত্যুও যাঁর অমৃতও তাঁরি ছায়া। এতদিনে আবার সেই অমৃতেরই পরিচয় পাচ্ছি।’
‘ছিন্নপত্রাবলী’তে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শোনা যায়-‘ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্ত¡না নেই। কিন্তু বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত¡নাস্থল।’
১৯২০ সাল। আজ থেকে শত বছর আগে, আমেরিকার ‘ওয়াশিংটন’ কাগজে মৃত্যুর পর সত্তার অস্তিত্ব নির্ধারণে সক্ষম ‘এডিসন-এর মেশিন’ বলে এক বিচিত্র যন্ত্রের কথা ছাপা হল। মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব আর ওই আশ্চর্য যন্ত্রের বিষয়ে প্রশ্ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে এলেন মার্গারি রেক্স বলে একজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, ‘মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে আমার আশা আর বিশ্বাসের শেষ নেই। তবে মানুষের কাছে তার প্রমাণের জন্য আমি কোনও যন্ত্রের প্রয়োজন দেখি না।’
জন্মান্তর আর পরলোক বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও অনেকের মতো আলোচনা হয় আইরিশ কবি স্টপফোর্ড ব্রুকের। ‘পথের সঞ্চয়’-এ রবীন্দ্রনাথ সেই কথোপকথন মনে রেখে লিখেছেন, ‘আমার জীবনধারার মাঝখানে এই মানবজন্মটা একেবারেই খাপছাড়া জিনিস। ইহার আগেও এমন কখনো ছিল না, ইহার পরেও এমন কখনো হইবে না।’
মংপুতে একবার মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি- তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭। ছিয়াত্তর বছরে বড় অসুখে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। এরিসিপেলেস তাঁকে অজ্ঞান করে রাখল টানা পঞ্চাশ ঘণ্টা। অবশ্য এ যাত্রায় সুস্থ হলেন কবি। কিছু দিন পর হেমন্তবালাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘কিছুকালের জন্য মৃত্যুদ- এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে।’
আশি বছরের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’ প্রায় একই সময়, সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় একদিন দেখলেন উত্তরায়ণ-এ একটা প্রকা- টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথ বেশ ঝুঁকে পড়ে কিছু লিখছেন। বলাইচাঁদ জিজ্ঞেস করলেন, এত রকম আসবাব থাকতে অত ঝুঁকে পড়ে লিখতে রবীন্দ্রনাথের কষ্ট হচ্ছে কি না। উত্তরে বললেন, ‘সব রকম চেয়ারই আমার আছে। কিন্তু ঝুঁকে না লিখলে লেখা বেরোয় না। কুঁজোর জল কমে গেছে তো, তাই উপুড় করতে হয়।’
২৫ জুলাই, ১৯৪১। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতায়। যাওয়ার আগে আশ্রমের ছোট বড় সবাইকে দেখতে চাইলেন তিনি। গাড়িতে শুইয়ে তাঁকে ঘোরানো হল আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্প পোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’
আশ্রমের ডাক্তার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন। তাঁর দুটো হাত নিজের হাতে ধরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ডাক্তার, আমার আশ্রম রইল আর আশ্রমবাসীরা রইলেন, তাঁদের তুমি দেখো।’
রবীন্দ্রনাথের চোখে তখন জল। কাঁদছেন সবাই। ৩০ জুলাই কলকাতায় তাঁর অপারেশন। ভয় পাচ্ছিলেন ব্যথার কথা ভেবে। তার মধ্যেই মুখে মুখে বললেন নতুন দুটো কবিতা। টুকে রাখলেন উপস্থিত সেবিকারা। আদরের বৌমা প্রতিমার জন্য সে ভাবেই মুখে মুখে বলে লেখালেন একটা চিঠি। কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় অতি কষ্টে শুধু নিজে হাতে সই করলেন ‘বাবামশায়’। সেই তাঁর শেষ লেখা। ৭ আগস্ট ১৯৪১। ২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে অস্তাচলে গেলেন রবি। (তথ্যসূত্র : মনসুর আহমদ, প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন; মধুছন্দা মিত্র ঘোষ, প্রবন্ধ-রবির বৈশাখ কবির শ্রাবণ)