বেলাল আহমেদ
২০ অগাস্ট , ২০২০
কবি, সাংবাদিক
অন্তরাল মানে দুঃসহ বাস্তব। অতিশয় হৃদয়গত টানাপোড়েন। এসব টানাপোড়েনে পড়ে বারবার যার দুয়ারে দাঁড়াতে পারতাম নিঃসংকোচ চিত্তে, তিনি আব্দুল মুকিদ। আব্দুল মুকিদ। নাম থেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা এক মহামানব। গত হলেন দু্ই বছর পূর্ণ হলো আজ। আমাদের শিক্ষক। প্রিয় শিক্ষক। জীবনের যত ব্যথা বেদনা আমাদের তা নিজের ভেতরেই নিয়ে নিতেন স্যার। অনুপ্রেরণা ছিলেন। সব বাধা টপকে ছিটকে বেরিয়ে আসার অনুপ্রেরণা। পথ দেখাতেন। অন্ধকারের বুক চিরে আসা আলোর রেখা ধরে যাওয়া পথ। সবসময়ই সেই আলো রেখায় ছিল সমাজ সচেতনতা, আদর্শের লড়াই আর রাজনীতি সচেতনতা। সে পথ ধরে আজ আমাদের কেউ কেউ কিংবা অনেকেই স্ব স্ব জায়গায় সুদৃঢ়Ñসচেতন।
‘ক্ষমা করো অজ্ঞাতেই, যেহেতু জেনেছিÑ
আমার অস্তিত্বে তুমি ঈশ্বরের মতো।’
জিয়া হায়দার কি ভেবে কবিতাটি লিখেছিলেন? প্রশ্নটা থাক, ভাবনারা কেবল আপনাকেই আবিস্কার করে বারবার এ প্রশ্নে। এসব ভাবনা কেবল আপনাকে আমাকে এক বিপ্রতীপ কোণে বসিয়ে তেরছা করে কেটে কেটে দিয়ে যায়। না। আপনাকে কেউ কাটেনি। সে সাহস নেই। নেই সেই শক্তি। এমন ভাবনা গ্রাস করছে। করতেই পারে। মানুষ হিসেবে এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতেই হয়। দিতে হবে। নানা কাজে ও ঘটনায় মানুষেরা এমন চিন্তার মুখোমুখি হয়, জীবন নিয়ে ভাবে, ভাবতে বাধ্য হয়, মানুষ হিসেবে এটি যদি মানুষের কোনো রকমের পরাজয়ও হয়, তবু এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। যেমন মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি নেই কারও।
আপনি কে? আপনি জানেন হয়ত। আমি জানি। আমরা, মানে শৈশবÑকৈশোর থেকে আপনার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে যারা। যারা রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়াতে পেরেছিল আপনার সমান গুরুত্ব নিয়ে তাঁরা। যারা আপনার চারপাশের ছড়িয়ে থাকা আলো নিয়ে আলোকিত হতে চেয়েছিল তাঁরা জানেন। একটি অঞ্চল। মফস্বলের আলো ঝলমলহীন একটি জনপদকে যে আলো বিলিয়ে দিতে দিতেই নিজের জীবনের আলো নিভিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে অপরাধের বিষন্ন জালে জড়িয়ে রেখে গেলেন স্যার।
আমরা মুকিদ স্যারকে জেনেছি যখন মাধ্যমিকের বারান্দায় পা দিয়েছিলাম। কাসেম স্যার। মুকিদ স্যারেরও স্যার। বেশ গর্ব নিয়ে কাসেম স্যার তখন একটা গল্প বলেতেন। মুকিদ স্যার আর আজম ভাইয়ের (আজম খান) গল্প। তখন দেওকলস দ্বি পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। কলেজে তখনও উন্নিত হয়নি। আমরাও নতুন গিয়ে ভর্তি হয়েছি। তো কাসেম স্যার আর আব্বার মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সে জন্য প্রায়ই পেটে খাওয়া চিমটিগুলো অনেক ¯েœহের, আদরের ছিল। সুযোগ পেলেই বলতেন ‘শুন, সেবুল (আব্দুল মুকিদ স্যার) আর আজমের মতো হতে হবে তোমাদের। এ দু’জন আমার স্বপ্নের এ স্কুলটির প্রথম ছাত্র। তারা এখান থেকেই সফলতার সাথে এসএসসি পাশ করে আজ বিশ^বিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে।’
মুকিদ স্যার তখন চট্টগ্রম বিশ^বিদ্যালয় থেকে মাত্রই রসায়নে মাস্টার্স করে ফিরেছেন। এতদিনে কাসেম স্যার যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। হওয়ারই কথা। ১৯৭২ সালে তিনি নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্কুলটি। জুনিয়র স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৭৮ সালেই মাধ্যমিকে উন্নিত হওয়া পর্যন্ত অনেক দখলই সইতে হয়েছে। সুদীর্ঘ সময়ধরে মাটির দলা দিয়ে মূর্তি তৈরি করার মতো স্কুল আর এর শিক্ষার্থীদের তৈরি করেছিলেন। ১৯৯৪ সালের এক মধ্য দুপুরে স্যার (কাসেম স্যার) জানালেন তিনি এবার অবসরে যাবেন। তার জায়গায় বসিয়ে যাওয়ার মতো একজন যোগ্য লোকও তিনি তৈরি করে নিয়েছেন। সে মানুষ আর কেউ নয়। আব্দুল মুকিদ। এ বিদ্যালয়েরই প্রথম ছাত্র। তারপর থেকে ধীরে ধীরে একটি অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন আপনি। হয়ে ওঠেন প্রেরণার উৎস।
আপনি এখন চিরজীবিত। অমরত্বের পথে আপনি। সমকালীন রাজনীতি আর শিক্ষকতার মিশেলে বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক সর্বাগ্রগণ্য কারুকৃৎ আপনি। মানবশরীর নিয়ে খুব বেশি মর্ত্যবাসী হওয়া যায় না। এখন থেকে আপনি মহাবিশ্বের মহাকালের আদিÑঅন্তহীনতায় সমর্পিত। আপনার সৃষ্টি অবিনাশী, আপনার সত্তা অবিনাশী, আপনার ছড়ানো আলো চির-সক্রিয় থাকবে আমাদের মনে ও মননে। আপনার প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি।