Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

২১ অগাস্ট , ২০২০


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


শান্তির ‘বটবৃক্ষ’ : আজিজুর রহমান

আমাদের শোক সাগরে ভাসিয়ে বড় ‘অকালে’ ও আকাল সময়ে চলে গেলেন ‘মাটির মানুষ’ মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। ‘অকাল’-এজন্য যে তিনি  আমাদের শান্তির ‘বটবৃক্ষ’। তিনি কারো-নেতা, লিডার, আজিজ চাচা, আজিজ ভাই, নৌকা চাচা, নানাজী ইত্যাদি; নিঃশঙ্কোচে কাছে যাওয়া, কথা বলা যায়; গণ-মানুষের এইতো চাওয়া। ‘যুধিষ্ঠীরে’র মতো ধৈর্য সহকারে অন্যের পেটের কথা শোনেছেন। তিনি ‘অজাতশত্রু’। যে বার তাঁর ওপর বিরোধী দলের এক যুবক হামলা করেছিল-শহর উত্তপ্ত অবস্থায় আজিজ ভাই প্রতিশোধ নিতে বাধা দিলেন। আজকের নোংরা রাজনীতির মাঠে এমন উদারতা কেবল তিনি আমাদের শেখালেন। এই দর্শন ও মানবিকতা শিখেছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। আমৃত্যু তাঁর মনন ও ধ্যানে ছিল মাতৃভূমির কল্যাণ চিন্তা। ভোগ , বিলাস, জৌলুশ ও দুরভিসন্ধিমুলক কাজে প্রতি তাঁর ছিল নিষ্পৃহ অবস্থা। এগুলো আজিজুর রহমানকে স্পর্শ করেছে তা কেউ অবশ্যই বলতে পারবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি তিন বার জনপ্রতিনিধি হয়ে জাতীয় সংসদে গেলেও আমরা লক্ষ করেছি যে আজিজুর রহমান কোনো গাড়ি বা ফ্ল্যাট গ্রহণের মতো লোভনীয় দিকে চোখ রাখেননি। এই হলো তাঁর গণ-চেতনার গভীরে থাকা রাজনৈতিক কমিটমেন্ট।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষদিকে ‘মনু নদী’র কূলঘেষে থাকা নির্জন গুজারাই গ্রামে [২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩] আজিজুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। বুঝাই যায় মনুর হার না মানা প্রবাহের মতো তাঁর জীবন- স্রোতও একাকার হয়ে চলেছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে নদীর সঙ্গে মিতালী করে সাঁতার দেওয়া, গান গাওয়া, নাটক করা একসময় তাঁর নেশা হয়ে যায়। এই নেশাটাই পাকিস্তান আমলে তাঁর প্রতিবাদী চরিত্রের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করে দেয়। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে ‘তমদ্দুনী’ পরিবেশে তাঁর শৈশব কাটলেও কীভাবে যে কিশোর আজিজুর ‘হিন্দুয়ানী বাঙ্গালি’ [!] সংস্কৃতি গ্রহণ করে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের লড়াকু সৈনিক হলেন তা ভাববার বিষয়। তাঁর পরিবার, প্রতিবেশ এবং রাষ্ট্রদর্শন তখন ছিল প্রতিকূল অবস্থায়। ছাত্রাবন্থায় তিনি মৌলভীবাজারের স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নবারুন’ সংস্থার প্রভাবশালী সদস্য হয়ে প্রকাশ্যে নাটক ও গান করতে শুরু করেন। তখনো রক্ষণশীল মুসলিম পরিবার থেকে এভাবে সংস্কৃতির মাঠে তরুণদের আসতে দেখা যায়নি। আজিজুর রহমান ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ও অগ্রবর্তী যোদ্ধা। তিনি তাঁর সময় ও সমাজকে অতিক্রম করার সাহস দেখান। তাঁর এই সাংস্কৃতিক ভুবনে হাওয়া দিয়েছিল বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী ঘটনাবলী। ফলে বাঙালি আত্ম পরিচয়ের শিকড় তরুণ আজিজুরের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে। তখন তাঁকে আমরা পাই অসাম্প্রদায়িক লড়াকু সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে-যিনি ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে বাঙালির কৃষ্টি রক্ষার জন্য ধাবমান। 

তরুণ আজিজুর রহমানের কর্মকান্ডের দিকে দৃষ্টি পড়েছিল তখনকার পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের নেতা পীর হবিবুর রহমান [বামন্থী] ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর [আওয়ামীলীগ]। আবার তাঁর বন্ধুদের বেশিরভাগ ছিলেন সমাজতন্ত্রী ভাবধারার। তাঁরা দুইজন নিজ নিজ দলে ভিড়ানোর জন্য চেষ্টা করেন। এই  দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে তিনি রাজনীতির পথে না গিয়ে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিকধারায় কাজ করতে চেয়েছিলেন। মৌলভীবাজার জেলা শহর সে আমলে মুসলিমলীগের রাজত্ব চলতেছিল। চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এই আসনটি মুসলিমলীগ পেয়ে যায়। ফলে মৌলভীবাজারে মুসলিমলীগ বিরোধী অবস্থান তৈরি জরুরি হয়ে পড়ে। এই বাস্তবতায় তাঁরা মিয়া, পীর হবিবুর রহমান, দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রমুখ আজিজুর রহমানকে উজ্জীবিত করেন। আজিজুর তখন বাংলার  সংস্কৃতি রক্ষা, চলমান আন্দোলন-সংগ্রামকে গ্রামমুখিন করার জন্য পায়ে হেঁটে বিভিন্ন জনপদে যাতায়াত শুরু করেন।

ষাটের দশকের প্রতিটি আন্দোলনে আজিজুর রহমানকে আমরা দেখি একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মিছিলে সংগ্রামে এবং গানে গানে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ওড়াতে। ষাটের দশকে পাক-সরকার যখন রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায় তখন মৌলভীবাজারের মতো মফঃস্বল শহরে প্রতিবাদী মিছিলে রাস্তায় ছিলেন আজিজুর রহমান। ১৯৬৭ সালে রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রবর্জনের প্রতিবাদে তাঁর অবদান স্মরণীয়।

১৯৬৮ সালে সাংগঠনিক সফরে শেখ মুজিবুর রহমান মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট পৌছান; মৌলভীবাজারে বৈঠক হয়। ফরিদ গাজী সাহেব সাহসী আজিজুর রহমানের কথা কানে দিয়েছিলেন বলে ধারণা করি। আজিজুর রহমান তখন ব্যক্তিগত কাজে সিলেট ছিলেন-গাজী সাহেব তাঁকে খোঁজাখুঁজি করে পাননি। অবশেষে দৈবক্রমে সেদিন ফরিদ গাজী আজিজুর রহমানকে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যান। কিন্ত আজিজুর রহমান সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বললে শেখ মুজিব উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘পঁচিশ বছর বয়সে না বুঝলে আর কখন বুঝবে।’ হুকুম দিলেন যে ‘আজিজ আওয়ামীলীগে যোগ দেবে’। সাংস্কৃতিক কর্মী আজিজুর রহমান হয়ে গেলেন রাজনৈতিক কর্মী। অতঃপর তাঁর সত্তার ভেতর গণমুখি-রাজনীতির বিকাশ আমরা লক্ষ করি।

সত্তরের নির্বাচনে আজিজুর রহমান মাত্র সাতাশ বছর বয়সে বিপুল ভোট পেয়ে এম পিএ নির্বাচিত হয়ে মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দিবানিশি কাজ করেন। নির্বাচনের সময় চা-শ্রমিক ও কৃষক সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সাংগঠনিক ভূমিকায় বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।  বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মৌলভীবাজার ফিরে গণ-সঙ্গযোগ করতে নেমে পড়েন। তিনি ২ মার্চ পথ-সভা ও মশাল মিছিল, ৩মার্চ থেকে ৬ মার্চ হরতাল ও জঙ্গী মিছিল পরিচালনা করেন। ১০ মার্চ গণ সমাবেশ করেন। ১১ মার্চ মৌলভীবাজার মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে আজিজুর রহমান আহবায়ক নির্বাচিত হন। ২৬ মার্চ তিনি পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন অনেক নির্যাতনের পর ২৭ মার্চ ছাড়ে। সে রাতে আবার গ্রেফতার করে নির্যাতন করে সিলেট জেলে পাঠায়। ৭ এপ্রিল  জনতা সিলেট জেল ভাঙ্গলে আজিজুর রহমান মুক্তি পান এবং প্রতিরোধ আন্দোলন করেন। ২৮এপ্রিল মৌলভীবাজার পাকসেনাদের দখলে চলে গেলে তিনি কৈলাশ্বর গিয়ে যুবকদের ট্রেনিং এ পাঠান। প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্ত মতে চারজন তরুণ এম পিকে বিহারের চাকুলিয়ায় ট্রনিং এ পাঠানো হয়-তাঁর মধ্যে ছিলেন আজিজুর রহমান। পরে তিনি চার নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন এবং ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারে আনুষ্ঠানিক স্বাধীন পতাকা উত্তলন করেন।

অকৃতদার আজিজুর রহমান নিঃস্বার্থভাবে আমৃত্যু মাতৃভূমি ও মানুষের সেবা করে গেছেন। তিনি মানুষের অন্তরের গহীনে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমরা হারালাম এক বিশাল বটবৃক্ষ-যার ছায়াতলে আমরা শান্তি পেয়েছিলাম। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।