Cinque Terre

পার্থ তালুকদার

২৩ অগাস্ট , ২০২০


প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার


বাউল ছুরত মিয়া : মুর্শিদের পথে

বাউল শাহ মো. ছুরত মিয়ার প্রতি আমার কৌতুহল জাগে বন্ধু আবুল কালাম আকন-এর মুখে গল্প শুনে। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। আকনের কাছ থেকে তাঁর মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে একদিন ফোন করি। মিনিট পাঁচেক কথা বলে তাঁর সম্পর্কে একটু ধারণা পাই। ‘বাউল’ শব্দার্থের সঙ্গে তাঁর আচরণের কোথায় যেন একটু মিল পেলাম। কারণ বাউল মানেই একটু ক্ষ্যাপা, এলোমেলো, অগোচালো। আমি প্রশ্ন করি, ‘ছুরত ভাই, আপনি এ পর্যন্ত কয়টা গান লিখেছেন ? তিনি ঝটপট উত্তর দেন, ‘কয়টা গান লিখছি তা তো হিসাব করিনি, তবে আপনি যদি তিন মাস ধরে আমার গান নিয়ে রিপোর্ট করেন তবুও আমার গান শেষ হবে না’! 

তাঁর এমন উত্তরে আমি চমকে উঠি। মনে মনে বলি আমি যাকে খুঁজছি সে আপনিই ! কারণ আমার অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক জোগাতে পারে শাহ মো. ছুরত মিয়ার মতো এমন আপনভোলা বাউলই। আমি আবার প্রশ্ন করি, ‘ছুরত ভাই, আপনার কি কোনো গানের বই আছে ?’

তিনি বললেন, আমার কত বই আছে, গানের পাতা আছে, তবে আমি এখনও  মোট (একত্র) করিনি। গানের বই বের করতে আমার তৌফিকে কুলায় না। তৌফিকে কুলাইলে বই বের করার ইচ্ছা আছে। আমি তো অনেক গান লিখছি, সব গান একসঙ্গে করতে গেলে একমাসের জন্য আমার একজন মুহুরি লাগবে।

বললাম মুহুরি লাগবে ?

তিনি উত্তর দিলেন-হুম, মুহুরি লাগবে। আমার একার দ্বারা এতসব গান ‘মুঠ’ করা সম্ভব নয়।

: আপনি কি রাধারমণের গান করেন ?

-আমি তো রাধারমণের গান গেয়ে পুরস্কার পাইছি। আবুল মাল আবদুল মুহিত (সাবেক অর্থমন্ত্রী) আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিছেন। ঢাকা শিল্পকলায় ত্রিশ হাজার টাকা পুরস্কার পাইছি। আমি তো রাধারমণকে নিয়া গানও লিখছি।

: শুনান তো একটু।

সুনামগঞ্জ জেলা মোদের উন্নতমান সবই পেলাম  

জগন্নাথপুর পৌরসভায় কেশবপুর হয় আদর্শ গ্রাম ॥

বাউল সাধক রাধারমণ, কেশবপুরে জন্মগ্রহণ

বিশ্বজুড়ে আশিকগণে গুণগান করিতেছে শুনলাম ॥

: আপনি কি এখনও গান করেন ?

-গান ছাড়া আমার ভালো লাগে না। আমি এই গানের জগতের মানুষ, অন্য কোনো চিন্তা আসে না।

: আপনার জীবন বা গান নিয়ে কেউ লেখালেখি করেছে ?

-মোশারফ মাস্টার আমারে নিয়ে লিখছেন। আর কেউ লিখেনি। তবে আমারে নিয়া জগন্নাথপুরের ইউএনও স্যার কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। তিনি একদিন বললেন আপনি কি বাংলাদেশ নিয়া গান লিখছেন? আমি গাইলাম বাংলাদেশ নিয়া গান। পরে বললেন আপনি কি শেখ মুজিবুরকে নিয়া গান লিখছেন? গাইলাম শেখ মুজিবুরকে নিয়া গান। এরপর বললেন আপনি কি শেখ হাসিনাকে নিয়া গান গাইতে পারবেন ? তখন গাইলাম শেখ হাসিনাকে নিয়া গান। সরকার আমার কাছে যে ধরনের গান চাইবে সে ধরনের গান গাইতে আমি প্রস্তুত।

আমি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন তিনি রাস্তায় হাঁটছিলেন। তাই কয়েক মিনিট কথা বলেই আমি মোবাইল রেখে দিই। তবে আমার অতৃপ্তি রয়ে গেল, কৌতুহল বেড়ে গেল। বাউল ছুরত মিয়া বললেন, ‘আপনি একদিন গরীবের বাড়িতে আসেন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা হবে’। আমারও তাঁর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। কিন্তু করোনা ভাইরাস ও নিজের ব্যস্ততা দুটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি জানালেন সিলেট বেতারে তিনি গান করেন। যেদিন গান গাইতে সিলেট আসবেন সেদিন আমার সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু সেটাও হয়ে ওঠে না। তবে প্রায়শ আমি তাকে ফোন করে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করি। উনি মাঝে মাঝে উৎসাহ নিয়ে কথা বলেন আবার অনেকসময় বলেন, আমি ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলবো। এরই মাঝে একদিন আমি তাঁর নাম লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে ঢাকায় শিল্পকলায় রাধারমণ সঙ্গীত উৎসবে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন পেয়ে গেলাম। একদিন রাত দশটার দিকে তাকে ফোন করি। জানতে চাইলাম, কী করেন ছুরত ভাই ? ওপাশ থেকে বললেন, ‘আমি এখন গান গাই, বন্যা নিয়া গান বানাইছি, শুনেন আমার গানটা’। এই বলেই হারমোনিয়ামে সুর তুলে গান গাইতে শুরু করেন ছুরত মিয়া। আমি চোখ বন্ধ করে তাঁর গান শুনতে থাকি। বোঝা গেল বেশ দরদি কন্ঠ তাঁর, আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে আটকা পড়লাম। গান শেষে প্রশ্ন করি, ছুরত ভাই, আপনার জন্ম সাল ও পিতামাতার নাম একটু বলবেন।

-১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আমার জন্ম। তখন বাংলা আষাঢ় মাস। তারিখ মনে নাই। পিতার নাম আবদুল বারিক, মাতা আহ্লাদি বিবি। দ্ইু ছেলে আমার, স্ত্রীর নাম জাহানারা বেগম।

: রাধারমণের গান আপনার কেমন লাগে ?

-রাধারমণের অনেক গান তো আমিই আবিষ্কার করছি। রাধারমণের যে গ্রামে জন্ম আমি সেই গ্রামেরই সন্তান। আমি তাঁর যে কয়টা গান গাইতে পারবো অন্য কেউ সারা জীবনেও পারবে না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম তাঁর আশ্রমে থাকতেন এক মহিলা; নাম বিন্দু। আমি ছোটবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাধারমণের সমাধিতে গিয়ে ওই মহিলার গান শুনতাম। তাঁর কাছ থেকে অনেক গান সংগ্রহ করেছি। কিন্তু গানের খাতাটা এখন আর নাই। তবে রাধারমণের অনেক গান আমার এখনো মুখস্ত আছে।

: রাধারমণকে আপনার কেমন মনে হয় ? 

-উনি তো মহাপুরুষ। তিনিও বাউল, আমিও বাউল।

: তাঁর সঙ্গে আপনার একটা পার্থক্য আছে। আপনি বাউল আর রাধারমণ বৈষ্ণব-সহজিয়া।

-তাঁর সঙ্গে আমার একটাই পার্থক্য, তিনি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিছেন আর আমি মুসলিমের ঘরে। আর কোনো পার্থক্য নাই। তিনি ভগবানকে পাওয়ার জন্য সাধনা করতেন, আমি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সাধনা করি। আল্লাহ ভগবান যাই বলেন না কেন দুজনই এক। আমরা দুজনই তার প্রেমের সাধক। 

: বাউলরা তো দেহসাধনা করেন আবার এই সাধন প্রণালী শেখার জন্য সৎ গুরুর সঙ্গ নিতে হয়। আপনার গুরু কে ?

আমার গুরুর নাম শাহ মো: আশকির শাহ ভান্ডারি। বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার হবিবপুর গ্রামে।

: বাউলরা তো দমের সাধনা করেন। তাঁরা সংসার ধর্ম পালন করে না এমনকি সন্তানসন্ততিও নেয় না। তাদের সাধনসঙ্গিনী থাকে। আপনি তো বিয়ে করেছেন, সন্তানও আছে, তাহলে আপনি কি সেই অর্থে প্রকৃত বাউল ?

Ñআপনি ঠিক বলছেন। তবে আমার গুরু যখন আমাকে এই উপদেশ দিলেন তখন থেকে আমি আর সন্তান নিচ্ছি না। এখন আমি শুধু সাধনা করি। এখন আমি মুর্শিদের দেখানো পথে চলি।

: আপনার ওস্তাদ কে?

-মো: ইসরাইল মিয়া।

: আপনি কি দেহসাধনা করেন? দেহতত্ত্ব নিয়ে কোনো গান আছে আপনার ?

আমার প্রশ্ন শুনে ছুরত মিয়া তাঁর লিখা দেহতত্ত্ব বিষয়ক গান গাইতে শুরু করেন।

একবার নিজের চিন্তা করো

পরার চিন্তা করতে করতে তনু ঝরঝর

কোন দিন পাখি উড়ে যাবে সবাই হবে পর ॥

: বাউলরা বিশ্বাস করে আমাদের এই দেহ-ই হচ্ছে মন্দির মসজিদ, এখানেই আছেন আল্লা ভগবান। তারাই মনের মানুষ, তারাই অচিন পাখি। তাই আমাদের মন পবিত্র রাখা উচিত। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি ?

-অবশ্যই মন পবিত্র রাখতে হবে। মন শুদ্ধ না থাকলে প্রকৃত সাধনা হবেনা, তার দেখা পাওয়া যাবে না। আপনি আমার লেখা এই গানটি শুনেন দাদা।

বাউল ছুরত মিয়া আবারও গান গেয়ে উঠলেন-

মন পবিত্র প্রাণ পবিত্র

পবিত্র রাখো অন্তর

প্রাণবন্ধু অসিবে গো তর ॥

: আপনি কোন কোন ধারা নিয়ে গান লিখেছেন ?

-আমি অনেক ধরনের গান লিখছি। দেহতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণ লীলা  এসব অনেক গান।

: বাউল আবদুল করিমের সঙ্গে আপনার কোনো স্মৃতি আছে ?

-তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। আমরা দুজন একসঙ্গে মালজোড়া গান করেছি। ক্বারী আমির উদ্দিনের সঙ্গেও আমি মালজোড়া গানে অংশ নিছি। উনারা প্রশ্ন করছেন আমি উত্তর দিছি আবার আমি প্রশ্ন করছি উনারা উত্তর দিচ্ছেন।

: আপনার কি শিষ্য আছে ?

-আছে, তবে তারা আমার কথা শুনেনা। তারা টাকা জমানোর ধান্ধায় থাকে। একদিন আসে আরেকদিন আসে না। তবে আমি কোনোদিন টাকা জমানোর ধান্ধা করি নাই।

: জীবনের শেষ সময়ে আপনার একটা মনের ইচ্ছার কথা বলেন।

-আমার শ্বাসপ্রশ্বাস যতদিন আছে ততদিন আমি গান গাইতে চাই। যতদিন তাঁর দেখা না পাই ততদিন সাধনা করে যেতে চাই।

: আপনার কোনো বেদনা আছে, কষ্ট আছে ?

-আমার অনেক কষ্ট দাদা। ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করেছি। আমার লেখা একটা কষ্টের গান শুনেন।

তুমি সাথী হইয়া অন্যের সনে কাঁদাইলে আমারে

মনপ্রাণ জীবন যৌবন সব দিছি তোমারে ॥

দিনে রাতে আমায় তুমি কত আঘাত দিলে

সেই আঘাত সহে না আর আমার কোমল প্রাণে ॥

: এখানে ‘তুমি’ বলতে কাকে ইঙ্গিত করেছেন ?

-সৃষ্টিকর্তা। আমার যত গান আছে সব তাকে উদ্দেশ্য করেই লিখা।

: এবার রাধারমণের একটা বিচ্ছেদ পর্বের গান ধরেন ছুরত ভাই।

বাঞ্চা কল্পতরু রে বন্ধু জগতে ঘোষণা

নিজ গুণে আসছো যখন পুরাও মোর বাসনা।

হায়রে বন্ধু যাই যাই আর বইলো না ॥

মোবাইলের ওপাশে গাইতে থাকেন ছুরত মিয়া। আহ্ এমন দরদি কন্ঠ! আমি চোখ বন্ধ করে গানের কথা ও তাঁর মায়াবি সুর হৃদয়াঙ্গম করার চেষ্টা করি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। গান শেষ হলেও তার রেশ রয়ে যায়। রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। আমি বিচ্ছেদের ঘোরে আটকা পড়ি। আমার চোখদুটি যেন ছলছল করছে। শত সুখের মধ্যেও মানুষের মাঝেমাঝে বড় অসহায় লাগে, নিজেকে একা লাগে। যেন পুকুরের মধ্যখানে ফুটে থাকা একাকি এক পদ্মফুল। সে তখন পরমের সান্নিধ্য পেতে চায়। সে হয়ে ওঠে পরমের কাঙাল। এই পরমকে পেতেই সাধনা করেছেন রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, আবদুল করিম থেকে শুরু করে আজকের বাউল ছুরত মিয়া। তাই আমাদের রাধারমণ যেমন জিইয়ে আছেন শাহ মো. ছুরত মিয়ার মতো বাউলের মরমি কন্ঠে, নিগুঢ় সাধনায়, ঠিক তেমনি তাদের পরম্পরায় বাংলা লোকসাহিত্যে বাউল ছুরত মিয়াও বেঁচে থাকবেন স্বমহীমায়, এটা নিশ্চিত।