Cinque Terre

তুষার কর

১২ সেপ্টেম্বর , ২০২০


মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও শিশু সাহিত্যিক


কাছে ছিলে দূরে গেলে
দূর হতে এসো কাছে

 

 

 

করোনা মহামারি শুরু হলে, একদিন ফোন করেছিলাম, সেই আলাপ। এর মাঝে কতদিন কেটে গেল দেখা হয়নি। আর কোনোদিন দেখা হবেনা, কথাও হবেনা। একে একে আমাদের মিলন মেলাটি ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের বন্ধু পুরঞ্জয় চক্রবর্তী ২৪ আগস্ট, সোমবার ভোরে না ফেরার দেশে চলে গেছে। দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ব্যাধি, হৃদরোগসহ নানা রোগে ভোগে এই বন্ধুটি, রৌদ্রছায়াময় পৃথিবীকে বিদায় জানালো। এই মুহূর্তে, শরৎ সকালে, আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্মৃতিরা দল বেঁধে ভিড় করছে। সেখানে কত কথা, কত গান। আহা! আমাদের কিশোরবেলা, সোনালী সূতোয় বোনা কিশোরবেলা। 

পুরঞ্জয়কে প্রথম দেখি, ১৯৬৩ সালে, তখন পরিচয় নয়, বন্ধুত্বও নয়। জাফলং চা বাগান থেকে সিলেটে রামকৃষ্ণ মিশনে এসেছি, বিবেকানন্দ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার গ্রহণের জন্য। এই শতবার্ষিকী উৎসবে আমার কাকামনি গীতিকার ও নাট্যকার সুনির্মল করের লেখা নাটক ও নৃত্যালেখ্য মঞ্চস্থ হলো। ‘নরেনের স্বপ্ন’ নাটকে নরেনের ভূমিকায় পুরঞ্জয় অভিনয় করে। নরেনের কী দিব্যকান্তি রূপ! মঞ্চে নরেন যখন ধ্যানমগ্ন তখন অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। পুরঞ্জয় খুব সুপুরুষ ছিল।

পঁয়ষট্টি সালে সিলেটে স্থায়ীভাবে আসা। কী আশ্চর্য! আবার পুরঞ্জয়, একই পাড়ায় মীরাবাজারের আগপাড়ায়, একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত বসবাস। তারপর সবকিছু ফেলে মুক্তিযুদ্ধে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলবেলায় দেখা সাক্ষাৎ। একদিন সবাই জড়ো হয়ে ‘কিশোর সংঘ’ নামে একটি সংঠন গড়ে তুলি। পাড়ার বড়রা উপদেষ্টা। পঁচিশে বৈশাখকে সামনে রেখে এই উদ্যোগ। রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ এক নাম। আমরা রবীন্দ্র জয়ন্তী করবোই, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই কাজের শুরু। মহড়া, চাঁদা তোলা-কত কাজ। সে কী আনন্দ! কাজ ভাগ করে দেওয়া হলো। পুরঞ্জয় দেখবে নাটক। ‘কাবুলিয়াওয়ালা’ মঞ্চস্থ হলো। ‘কাবুলিওয়ালা’ চরিত্রের পুরঞ্জয় অভিনয়ও করলো। এত বছর পর, স্মৃতির রেশমী পথে সেই ছবি স্পষ্ট ভেসে উঠছে। আগপাড়ায় তিন চারটে ছোট বড় মাঠ ছিল। পুরঞ্জয়ের বাড়ির পাশের মাঠ, তারু মিয়ার মাঠ, নদীয়া বাবুর টিলার চত্বরÑএইসব মাঠে আমরা রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীর আয়োজন করেছি। তৎকালীন সিলেটের কত গুণীজন, কত শিল্পী আমাদের অনুষ্ঠানে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ সিলেটে এসে যে টমাস সাহেবের বাংলোয় উঠেছিলেন, সেই বাংলোর এক ইংরেজ সাহেব রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিলেন। সাহেবের নামটি এখন মনে পড়ছে না। রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রতিবাদ, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং বাঙালিত্বের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আমাদের সম্মিলিত এই প্রয়াস।

কিশোর সংঘের পাশাপাশি শিবগঞ্জে আমাদের বন্ধু বেদানন্দ ভট্টাচার্য গড়ে তোলে ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ সাংস্কৃতিক সংগঠন। এও এক ইতিহাস। সিলেটের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস অবশ্যই। পুরঞ্জয় প্রায়ই আমাকে বলতো, এই সময়ের কথা লিখে রাখো, নইলে একদিন হারিয়ে যাবে। আমি আলসেমি করে লিখিনি, অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। পুরঞ্জয় খেলাঘরের একটি সংকলনে কিশোর সংঘ এবং খেলাঘর নিয়ে তার স্মৃতিচারণ করে গেছে। লেখাটি তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ।

আমরা কেউই শুধু ‘কিশোর সংঘে’ সীমাবদ্ধ ছিলাম না। ওখান থেকে যাত্রা শুরু করে খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী, সমস্বরকে নিয়ে ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে মিশে, ঝড়ের খেয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ঠিকানায় পৌঁছে যাই। পুরঞ্জয়, বেদানন্দ, গঙ্গোত্রী, কাজল , পতাকী এক সারি নাম। সবার নাম বলা হলো না। আমি সম্পাদনা করেছি ‘দুর্জয় বাংলা’। আমাদের দলের কেউ একাত্তরে ঘরে বসে থাকিনি। সকলেই রণাঙ্গনের সৈনিক। পুরঞ্জয়ের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল। বৃহত্তর পরিসরে কাজ করবে বলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন নিবেদিত কর্মী ছিল। অফিসের কাজ শেষে ওর আর কোনো কাজ ছিল না, খেলাঘর, উদীচী আর পার্টি। খেলাঘর, উদীচীর কখনো সভাপতি, কখনো সম্পাদক। কখনো বা সদস্য। সিলেট উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। কোনো পদের লোভ তার ছিল না। ছিল স্থির রাজনৈতিক লক্ষ্য। মেহনতী মানুষের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নেওয়া। সেখান থেকে এক চুলও নড়েনি। কতজন এলো আর গেল!  কেউ মনে রাখার মতো মানুষ হতে পারলো না। এরা ধর্মের মোহের কাছে, লোভের কাছে বাঁধা পড়েছে। পুরঞ্জয় এসব মুক্ত, জয়ী পুরুষ। সংগঠন তার খুব প্রিয় ছিল। এক সময় সাংস্কৃতিক জোট, নাট্য পরিষদের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সেতো নিজেই ছিল একজন নাট্যশিল্পী। সর্বোপরি প্রগতিশীল সকল আন্দোলন সংগ্রামে এই যোদ্ধা মানুষটিকে আমরা পেয়েছি। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও পুরঞ্জয় ছিল। আমাদের শহরের শহীদ মিনার নির্মাণের সঙ্গে পুরঞ্জয় চক্রবর্তী এই নামটি যুক্ত। এখানে এলে তার কথা সকলের মনে পড়বেই। কে বলে পুরঞ্জয় নেই!

এবার একান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয় উন্মোচন করি। এক সঙ্গে সোনালী ব্যাংকে আমরা চাকরি করছি। একবার এক দুষ্টু ব্যক্তির ক্ষমতার দাপটে আমাকে ব্যাংকের গোলাপগঞ্জ শাখায় বদলি হতে হয়। ওখানে তিন বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কর্তৃপক্ষের কোনো নড়চড়া ছিল না। পুরঞ্জয় পুরো ব্যাপারটি জানতো। একদিন ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করে বললো, তুষারকে শহরে নিয়ে আসুন, ওর তো তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এই বলা তার জন্য কাল হলো, পুরঞ্জয়কে গোলাপগঞ্জ যেতে বলা হলো। আমি এলাম শহরে নয়, দক্ষিণ সুরমার একটি শাখায়। পুরঞ্জয় বদলির আদেশটি পেয়ে আমাকে বলল, তবু তুই আয়, আমি যাব। কোনো ভাবনা নেই, উদ্বেগ নেই, যেন এটা ঘটতেই পারে, আমরা এমন কাঠামোর মাঝেই তো আছি। আমার চোখ জলে ভিজে যায়। এই ছিল পুরঞ্জয়। কী দায় ঠেকেছিল তার আমার জন্য। বেঁচে থাকতে ওসব প্রসঙ্গ তুললে বলতো চুপ! আমার কিডনি অসুখ জেনে তার সেকি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। আমি কেমন আছি দেখা হলেই আগে জানতে চাইত, সেও তখন খুব অসুস্থ। জানিনা কেন সে ওমন করত। নিজেকে নিয়ে খুব কম ভাবতো। 

আমাদের আড্ডা বসেছে কখনো কোনো রেস্তোরাঁয়, দিলু ভাইয়ের (কবি দিলওয়ার) বাসায় কিংবা বেদানন্দের বাসায়। অফিস করতো পুরঞ্জয়, মনটি থাকত সংগঠনে। অফিসেও সঙ্গে ফাইল পত্তর। ওরকম আর কাউকে দেখিনি। দিলু ভাইয়ের বাসায় আমরা যখনই গেছি দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হয়েছে। বেশি রাত হলে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফেরা। একবার দিলু ভাইকে খেলাঘর ঘরোয়াভাবে কবি ভবনে সংবর্ধনা দেয়। পুরঞ্জয়ের চাওয়া ছিল আমি যেন কবির অভিনন্দন পত্রটি রচনা করি। এও এক স্মরণীয় মধুর স্মৃতি। আজ দিলু ভাই নেই, পুরঞ্জয়ও নেই।

সোমবার সকাল প্রায় দশটায় ঢাকা থেকে তবারক ভাইয়ের ফোন, পুরঞ্জয় আর নেই। কী বলব আমি? তবারক ভাই বললেন, তোমাদের নিয়েই তো আমাদের পথচলা ছিল; আমরা একসঙ্গে চলেছি। পুরঞ্জয়টা চলে গেল। বেশি কথা বলা হয় না। টেলিফোন ছাড়ি। 

এগারোটায় পুরঞ্জয় শেষবারের মতো তার প্রিয়স্থান সকল আন্দোলন, সংগ্রামের পীঠস্থান শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এলো। তার কাছে মানুষেরা অনেকেই এসেছিলেন। আমি যাইনি, অন্য কোনো কারণে নয়। আমার কাছে পুরঞ্জয় যেমন ছিল, তেমনই থাকুক। প্রিয় মানুষের শেষযাত্রা দেখতে আর ভালো লাগে না। রাতে ঘুম ভাঙলে কিংবা ভোরবেলা সেই দৃশ্যটি আমি দেখতে পাই।

পুরঞ্জয় হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে চলে যাবে, এমন ভাবনা ভাবনায় ছিল। চলে যখন গেছে খুব খালি লাগছে। ভালোবেসে যাকে ধরি, সেই চলে যায়। এওতো জানি, শেষ বলে কিছু নেই। পুরঞ্জয়, তোমাকে আমরা ভুলব না, আমি ভুলব না। বিদায় বন্ধু বিদায়। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। মনে রেখোÑ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে/আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে/তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে/নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।’