Cinque Terre

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

১১ এপ্রিল , ২০২০


সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী

[email protected]
করোনাক্রান্তিতে মানবতার ক্রন্দন

গোটা বিশ্ব এখন কোভিড -১৯ (নভেল করোনাভাইরাস) এর  প্রাণঘাতি আক্রমনে বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে এই সংক্রামক রোগকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দুনিয়ার প্রায় সকল দেশের মত আমাদের দেশেও এটি মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্তের তালিকা। প্রতিদিন বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। করোনার এই ক্রান্তিকালে বিশ্বের সর্বত্র যখন মানবিকতার বিভিন্ন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে তখন মানবতাকে যেনো গলা টিপে হত্যার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছি আমরা। একের পর এক লোমহর্ষক নির্মমতা বাঙালির চিরন্তন ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সমাজজীবনে সৃস্টি করছে গভীর ক্ষত।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিদেশ ফেরত এক যুবক ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কোয়ারেন্টিনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ম্যানেজ করে বাড়ি ফেরেন। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেশে ফেরাদের খোঁজা শুরু করলে তিনি বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যান। সেখানে কিছুদিন থেকে আরেক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নেন। দূর্ভাগ্যজনক পরিণতি হল পালিয়ে পালিয়ে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। এভাবে করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর জেনে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন একাধিক ব্যক্তি। করোনা আক্রান্ত এলাকা থেকে দল বেঁধে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন আত্মীয় বাড়িতে। আক্রান্তদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের পরিবার পরিজনদেরকে সামাজিকভাবে অপদস্ত করা হচ্ছে। করোনা আক্রান্তদের দেওয়া হচ্ছে অপবাদ। কিন্তু এসব তুচ্ছ মনে হল, জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যাওয়া যুবকের লাশ দাফনে মসজিদের খাটিয়া ব্যবহার করতে না দেওয়ার সংবাদ দেখে। খাটিয়া ছাড়া দুই ভাই ও বাবার কাঁধে করে লাশ দাফন করতে নিয়ে যাওয়ার একটি ছবি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। কী নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বাস করছি । স্ত্রীর দাফন কাজে অংশ নিতে স্বামীকে বাধা দিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়েও মেয়েকে দাফন করতে পারেননি বাবা। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়িতে পড়ে আছে। স্বজনরা কেউ কাছে যাচ্ছেন না। নিচ্ছেন না দাফনের উদ্যোগ। ত্রাণের জন্য নাম তালিকাভূক্ত করতে গিয়ে ধর্ষিত হতে হয়েছে এক গৃহবধূকে। এ ধরণের নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা শিরোনাম হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের। ক্রান্তিলগ্নে মানুষ যেখানে মানবিক হয়। সহযোগী হয়। সেখানে এ ধরণের অমানবিক নিষ্ঠুর উদাহরণগুলো পীড়াদায়ক। এসবই কি শুধু করোনাক্রান্তির ভয়াবহতা নাকি মানবতা বোধহীন সমাজবাস্তবতা! সামাজিক বিচ্ছিন্নতার স্লোগান কি আমাদের মানবতাবর্জিত সমাজব্যবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে। বৈশ্বিক এই মহামারি সামাল দিতে যেখানে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার দূর্বলতা চোখে পড়ার মত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ব্যাপক পরীক্ষার ব্যবস্থা যখন সাধারণের আয়ত্তের বাইরে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসকরা যখন দুর্যোগের বলি হচ্ছেন। করোনা চিকিৎসার উপযোগিতা তৈরীতে রাষ্ট্র যেখানে হিমশিম খাচ্ছে। তখন চারপাশের এই নির্মম দৃষ্টান্তগুলো আরও বেশি হতাশার সৃষ্টি করে। 

বাংলাদেশ বরাবরই সকল দুর্যোগ আর সংকট মোকাবিলা করেছে দৃঢ় মনোবল আর মানবিক দায়িত্ববোধ দিয়ে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রণোদনা ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে সাধারণ মানুষই সংকটে এগিয়ে এসেছে হৃদয়ের উষ্ণতায়। চিরকালীন বাঙালি সংস্কৃতিতে ভ্রাতৃত্ববোধ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, পরার্থপরতা, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে। যে সমাজব্যবস্থায় মানুষ শত সংকটেও আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করতে চায় না সেই সমাজে কেন এখন এ ধরণের অমানবিকতার ছড়াছড়ি? সামাজিক মূল্যবোধ কি তাহলে হারিয়ে যেতে বসেছে। এসবতো এক ভঙ্গুর, আত্মকেন্দ্রিক সমাজচিত্র। 

প্রশাসনের নির্দেশনাকে মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। করোনাভাইরাস ভয়াবহতাকে আমলে নিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে বরং আইন লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ঘটছে। অতীতে দেখা গেছে বাংলাদেশের পুলিশ  সাধারণত অমানবিক আচরণ করে। চিকিৎসকরা মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। কিন্তু এবার এই করোনাক্রান্তিতে সব প্রতিষ্ঠিত ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। লাশ বহন, দাফন থেকে শুরু করে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এবার যে উদাহরণ সৃস্টি করেছেন তা প্রশংসনীয়। মানবিক পেশা হিসেবে  চিকিৎসকদের কাছ থেকে শুরুতে যে সহমর্মিতা মানুষ প্রত্যাশা করেছিল তা পায়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের সমন্বয়হীনতা ও সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিতের ব্যর্থতা থাকলেও আমাদের চিকিৎসকরা মানবতার পরীক্ষায় উক্তীর্ণ হতে পারেননি। এখন জীবন দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়বদ্ধতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে এমন অমানবিকতাও সমর্থনযোগ্য নয়। 

করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। লাশ দাফনে স্থানীয়রা বাঁধা সৃষ্টি করলে প্রশাসন নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠাচ্ছে। এতে করে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। সৌহার্দ্যের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষ আতংকিত হচ্ছে। মানুষের জাগরণ ছাড়া কোনো দূর্যোগ প্রশমন সম্ভব নয়। লক ডাউনের নামে পাড়া, মহল্লা, গ্রামীণ জীবনযাত্রা সবকিছু অচল করে দিলে জনসম্পৃত্তি বিঘ্নিত হবে। জনপ্রশাসনের অদূরদর্শী ও অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা যদি সাধারণ মানুষের মত আবেগে গা ভাসান তাহলে  সংকট আরও ঘনীভূত হবে। মানবিকতার হাত বাড়িয়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যেভাবে আর্থ মানবতার সেবায় নিয়োজিত আছেন তা গভীর আশাবাদের সৃষ্টি করে। মানবিক সাহায্য আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাকে আরও পরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত করতে হবে।

অফিস, আদালত,দোকান পাট সব বন্ধ। সকল প্রকার গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন আয়ের সুযোগ একেবারে নেই। যারা বিভিন্ন ব্যবসা বা দৈনন্দিন কর্মক্ষেত্রের আয়ের ওপর নির্ভরশীল তারা নিঃসন্দেহে খুবই অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। সরকারি, বেসরকারি সাহায্য, সহযোগিতায় একটা শ্রেণী হয়তো কিছুটা হলেও নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। কিন্তু যারা এ সমস্ত সাহায্য সহযোগিতার আওতায় নিজেদের না পারছেন সংযুক্ত করতে আবার না পারছেন দৈনন্দিন সাংসারিক চাহিদা পূরণ করতে। তাদের এই নির্মম দুঃসময়ে রাষ্ট্রকে পাশে দাঁড়াতে হবে।

উন্নত দেশগুলোর মতো সবার জন্য প্রণোদনা সাধ্য ও সামর্থ্য মত চালু করতে হবে। গভীর আন্তরিকতা আর হৃদয়জ দায়বদ্ধতা থেকে ক্রান্তিকালীন দূর্দশাগ্রস্ত মানুষদের মনোবল অটুট রাখা এখন জরুরি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সরকারের গৃহিত সকল পদক্ষেপকে জনবান্ধব করতে হবে। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তি ও অন্তর্ভুক্তি ছাড়া ধেয়ে আসা এই মহামারি মোকাবিলা সম্ভব নয়। মানবতার ক্রন্দন থামাতে হলে মানবিক অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার স্খলন মানবিক ক্রন্দনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে। করোনাক্রান্তি দূর হোক। মানবতার জয় হোক।