Cinque Terre

ফারজানা ইসলাম লিনু

৩০ সেপ্টেম্বর , ২০২০


গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক


যেন পুরোটাই চরিত্রহীন নরপশুদের বিচরণক্ষেত্র

করোনার বন্দিত্বে আমাদের মানসিক ও শারিরীক স্বাস্থ্য যখন রীতিমতো হুমকিতে। একদিন টের পাই শরীরে গজানো শিকড় কেমন শক্তপোক্ত হয়ে যাচ্ছে। করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। আপনজনের সান্নিধ্যে যাওয়া যাবেনা পরস্পরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে।

দীর্ঘ পৌনে চার মাসের বন্দিত্বের কপাট খুলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ি একদিন। গন্তব্য এমসি কলেজ।  

বৃষ্টিভেজা নিস্তব্ধ অপরাহ্ন বেলায় প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। মুক্তির আনন্দে পুত্র কন্যাদ্বয় জোরে মারো হেইয়ো টানে শ্বাস নেয়। যেন কত জনমের অবরুদ্ধতার পরে এইটুকু মুক্তি। 

মুক্ত বাতাসে করোনার মৃত্যু ভয়। এই কারণে মানুষের অহেতুক যন্ত্রণা ও দূষণ থেকে সাময়িক মুক্ত এমসি কলেজের সরোবর। অফুরন্ত শ্বেতপদ্ম অনাবিল আনন্দে ফুটেছে পুকুরে। ভেসে থাকা শুকানো ডালে গভীর ধ্যানে অনিন্দ্যসুন্দরী মাছরাঙা। শান্ত চারপাশ, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি ঝরবে যখন তখন।

সৌখিন কিছু মৎস্যশিকারী ছাড়া তেমন কেউ নেই। শান বাঁধানো ঘাটে নিভৃতে বসে ঘাস ফড়িংয়ের উদাস নৃত্য দেখি। পাখপাখালির উল্লাসে আমার মনোযোগে ছন্দপতন ঘটে। কলেজের মাঝামাঝি  টিলা ভেদ করে চলেছে কাক চক্ষু জলের এক চিকন ছড়া। দুই পারে ঘন ঘাসের স্তুপে চিনা জোক কিলবিল করে। পুকুরের খানিক লাগোয়া গগন শিরিষের ডালে বসেছে পাখির মেলা। ভাত শালিকের জড়াজড়ি, ফিঙের নাচানাচি দেখতে দেখতে কিভাবে যে সময় গড়ায়। মেঘের আড়ালে সূ্র্যের অন্তর্যাত্রা। বেলা বুঝার উপায় নেই। ছানাপোনারা এদিক সেদিক চক্কর দিয়ে ফিরে আসে পুকুর ঘাটে।

"আবার আসিব ফিরে".....  ঘড়ি দেখে সন্ধ্যার আগে আগেই বৃষ্টি মাথায় ঘরে ফিরে আসতে হয় নিতান্ত অনিচ্ছায়। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল আর কাঁঠালিচাঁপার গন্ধে আকুল হয়ে আমরা গান ধরি, "এসো নীপবনে ছায়া বীথি তলে, এসো করো স্নান নবধারা জলে। "

আবারও বন্দিত্ব, আবারও করোনা ভয়। পুত্রকন্যার বাপের সান্তনা এই তো শেষ নয়, আমরা বেরুব আরেকদিন। 

অলকানন্দা নয়, ময়ুরাক্ষী নয়, আমার আপন এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে আমাদের শান্তশিষ্ট সুরমা নদী। বর্ষার উগুর নিগুর বৃষ্টিতে উজানের ঢল নেমেছে। শান্ত ধীর সুরমা ফুঁসে উঠেছে তাই। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার শঙ্কা, তবুও ঘর বন্দি মানুষ পানি দেখতে ভীড় করে নদী তীরে। ভাসান পানিতে পা ভেজাতে ভয় লাগে, সুরমার নীল জলে আহ্লাদে অবগাহনের শখ হয় না। কিন্তু শহরের অপারে বন্যার বিধ্বংসী রূপে অপার মুগ্ধতা।  

কোন এক মাঝরাতে অকারণে আমার নিদ্রা ভেঙে যায়। ভরা বর্ষায় শুক্লা দ্বাদশীর মন ব্যাকুল করা জোছনার জল আমার জানালায় আছড়ে পড়ছে। আলুথালু নিদ্রা জড়ানো দৃষ্টি স্থির হয়ে আটকে থাকে গৃহত্যাগী জোছনায়। নদীর পাড়ে জোছনা স্নানের আজন্ম লালিত এক সাধ আমার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পরের দিন চটজলদি রুটিন কাজ সেরে পুত্র-কন্যার বাপকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি পূ্র্ণিমা দর্শনে। করোনার ভয় তুচ্ছ করে নদীর কিনার ঘেষে শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে অবেলায় অন্তহীন পথে ছুটে চলি জোছনা দর্শনে। 

‘চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম’

জনাকীর্ণ শহর পাশ কাটিয়ে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে আমাদের এলোমেলো লং ড্রাইভ শেষ হয়। ফিরতি পথে স্বল্প বিরতিতে থামতে হয় এমসি কলেজের পাশে। ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরব সাক্ষী এই কলেজ, সুনসান নিরবতায় মৌনব্রত পালন করছে। জোছনার আলো আধারিতে গা ছমছম করে আমার। এতো রাতে কলেজে প্রবেশের প্রশ্নই উঠেনা।  আবারও কোলাহলমুক্ত হোস্টেলের পাশ দিয়ে জোছনা আর জোনাকির কিলবিলানি দেখে দেখে ফিরতে হয় গৃহে।

মনে মনে ঠিক করি এখন থেকে প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা ও জোনাকি পোকার খুঁজে যাবো নদীর পারে কিংবা অগহীন কোন অরণ্যে। এই অবারিত প্রান্তর, এই শহর, এই অরণ্য, এই নদী সব আমার, সব আমাদের। কিন্তু মানুষরূপী হায়েনার তান্ডবে সব এলোমেলো। নিরাপত্তাহীনতা ও অজানা আতংকে সব স্বপ্নসাধ ধুলোয় মিশে গেল। 

বাতাসে ভেসে আসে কত কথা, আমাদের অগোচরে পৈশাচিকতার অমন তাণ্ডব নাকি আগেও হয়েছে। পারিবারিক সম্মান ও বিড়ম্বনার ভয়ে মানুষ চেপে গিয়েছে সব অন্যায়। জানাজানি না হওয়াতে আমরাও নির্ভার ছিলাম। এখন তো বিকালের সূ্র্যাস্ত, রাতের জোছনা দূরে থাক দিনের আলোয় সূর্যের দরকারি ভিটামিন ডি গায়ে মাখতেও ভীষণ ভয় করছে। 

পত্রিকায় নির্যাতিতার স্বামীর জবানবন্দী, অধ্যক্ষের অসহায়ত্ব সর্বপরি ঘটনার বিভৎস বিবরণ পড়ে চোখে ঘুম আসেনা। চাপা কষ্ট আর ঘৃণায় প্রচন্ড ক্ষতবিক্ষত হয় অন্তর। 

এই শহর, এই দেশ যেন পুরোটাই চরিত্রহীন নরপশুদের বিচরণক্ষেত্র এক আবর্জনার ভাগাড়। 

বিকেল, দুপুর, সকাল ও রাতের জোছনায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছিটিয়ে জন্মের মতো পানসে করে দিয়েছে আমাদের আপন ভুবন। এই কুয়াশা কেটে স্নিগ্ধ সকাল আসবে কি কভু??

 

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২০