Cinque Terre

এনামুল কবির

১৬ অক্টোবর , ২০২০


সহকারী অধ্যাপক

শাহজালাল মহাবিদ্যালয়

জগন্নাথপুর


‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি’ প্রসঙ্গে

এটা কল্লোল তালুকদারের বই, ক'দিন আগে প্রকাশিত হলো; অবশ্য সংগ্রহ করি এই সেদিন। এর মধ্যে পড়বো- সেই সময় পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বিরাঙ এই বই নিয়ে এবার পাঠ-পর্যালোচনা করতে চায়। এটা বেশ ভালো কাজ, ক’বছর হলো বন্ধুদের আমি সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেবার কথা বলেছি; যদিও এখানে আমাদের ধারাবাহিক হওয়া কত কঠিন! আমার এই লেখাটা সেই সতীর্থতার এক ধাক্কা বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়।

কেন এই বই? একটি সক্রিয় চিন্তা হলো সক্রিয় একটা বিশ্বের চিন্তাও, এদিক থেকে এর যুগ-মন্ত্রণা হলো কাম্য পরিবর্তন। লেখক এখানে সেই কাজটিই করতে চান, তবে সেটা হয় তাঁর শব্দসমবায়ে। কিন্তু একটা বই কেবল তা নয় এবং এর কভার দিয়েও বিচার করা যায় না; কারণ এর আছে নিজস্ব অভিপ্রায়। সে অভিপ্রায় লেখকের চিন্তার সংগঠনরূপে গ্রন্থিত হয়, এর মধ্যে বিস্তৃত থাকে তাঁর পাঠ-পরিকল্পনা। শেষপর্যন্ত এসব হলো একজন লেখকের কল্পনারই বিস্তার। (সে কল্পনা দিয়ে তার চারপাশের মানব ও বস্তুবিশ্বকে দেখে, তাদের সঙ্গে অনুভবের দ্বারা যুক্ত হয়, আর তখন সে সাহিত্য রচনা করে।  -পবিত্র সরকার ) এখানে তাঁর সে কল্পলোক ও ধারণাকে হতে হয় পরিষ্কার- বিষয় আর উদ্দেশ্যের প্রেরণা ব্যতীত সেটা কীভাবে সম্ভব? বই এখানে একটা নির্মাণ বটে এবং এর ¯্রষ্টা হলেন এর লেখক। লেখকের এই সৃষ্টি- বই যখন তার পাঠককুলের কাছে যায়, সেটা আর নিষ্প্রাণ থাকে না; প্রাণের সংক্রাম থেকে তা পাঠককেও সমান সংক্রমিত করে। তাই লেখক থেকে এর পাঠক এখানে এসে একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যান, বলতে গেলে- সেটা হয় একটা সময় ও অবস্থার পুনর্নবায়ন; একটা টেক্সট বা রচনা যা জন্ম দেয় নতুন একটা টেক্সেট, শব্দের প্রচল এবং বিনির্মাণের। এখানে এই হলো একটা বইয়ের কাহিনী, মূলত সপ্রাণ চিন্তা এর স্বভাব ধর্ম।

কল্লোল তালুকদার, তাঁর বই ‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতির এক জায়গায় লিখেছেন, কিন্তু মানুষের মন বড় বিচিত্র।  আমরাও তা স্বীকার করি, সেই সাথে কেবল মনে রাখতে চাই যে, এটাও এই বস্তুময় জগতের ব্যাপার। তাই জাড্যতার বাইরে আসতে আমাদের প্রয়োজন হয় শিল্পের সংকাম, সেটা মানুষের সৃষ্টিশীল এক খেয়ালও বটে; কিন্তু ইতিহাস চর্চা তা নয়, সেটা হলো- একটা বিষয়। এখানে এর বিষয়নিষ্ঠাই হতে পারে এর উদ্ধার, লক্ষ্যণীয়রূপে দাবি করতে পারে অবস্থার রয়ানকৃত সৌন্দর্য; এর ফল হলো- এরকম সৌন্দর্র্য বা সংক্রাম নিয়ে সে হাজির হবে এর পাঠকের দরোজায়। সৃজনশীলতার নন্দনে আমরা দেখি ভাবরূপের এক বস্তুগতরূপ- একটা বই বা গ্রন্থ এবং বাজারে যার উপস্থিতি সুবাদে সে এখন এক পণ্যও। এবার এখানে যা বলা দরকার, তা হলো একটা সময়কে যদি সে পাঠ বা বিষয়চর্চা এর পাঠকে নিজস্ব একটা প্রতিবিম্বে নিয়ে আসতে চায়, তবে সেটা হবে- বিষয়ীগত দর্পণধারীর কাজ। এখানে প্রতিটি বয়ান বা রচনা আমাদের সে কথাই বলতে উৎসুক। এর অর্থ হলো সেই বয়ান বা রচনা একটা অবস্থা বা আমাদের যাপিত দিনগুলির ভাষিক সাক্ষ্য হলেও তা হলো আসলে মানুষি এক হৃদয়ের প্রতিবেদন। তবে অন্ধত্বের বাইরে সেটা নিশ্চয় পাঠকের জন্য নিয়ে আসবে উপলব্ধির বিচার, অবগতির জন্য অভিজ্ঞতা ও তার নতুন সঞ্চয়ন। পাঠক হিসেবে আমরাও এখানে পেতে পারি এর সমান আস্বাদ; বলা বাহুল্য একজন পাঠক এখানে অতিক্রম করে যান সেই দর্পণধারী- লেখককে। 

এসব কথা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই যা বলতে চাই, এবার আমরা সেখানে প্রবেশ করি-

একজন লেখকের কাছে তাঁর লেখাই সব, এর বাইরে তাঁর কামনা করার কিছু নেই। এবার প্রশ্ন হলো এখানে তিনি কি ভেদাভেদহীন বেদনাকে ধারণ করতে পেরেছেন যা পাঠকের জন্য জরুরি তথা নৈব্যর্ক্তিক? যদি তাই হয়, একটা বলার মতো কথায় সেটা হয় প্রদীপ্ত, তা হলে একজন লেখক যে তাঁর কাজে সফল তা বলাই বাহুল্য। আমার মতে, ‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি’র লেখক এখানে পুরোই উৎরে গেছেন এবং তাঁর বইয়ের মতোই ভারী তাঁর এ কৃতিত্ব। রাজনৈতিক ইতিহাসে যা দাবি করা হয়, বয়ান করা মুহূর্ত ও এর অগ্র-পশ্চাদ বিবেচনা, এখানে বলতে গেলে এর অধিকাংশই টুকে রাখা গেছে। তাই এর পাঠক মনে করতে পারেন, এটা তার জন্য তত ধৈর্যের ব্যাপার নয়, বরং কোষধর্মী পাঠে- হাতের কাছে হয়ে উঠেছে ব্যবহারিক এবং সেই সাথে এতদঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর ৮টি সফরবৃত্তান্ত যা এর মূল বিষয়বস্তু সে সম্পর্কেও এক নির্ভরযোগ্য পাঠ। তাই আমি মনে করি, সহজাতভাবে এটা আমাদের জানা-শোনার সীমানাকে প্রসারিত করেছে এবং ইতিহাসের যোগসূত্রে যে এই অঞ্চল বাইরে নয়, বরং অধিকতর নিকটবর্তী- জাতির নির্মাতা বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্ম  হয়ে উঠেছিলো- সে সম্পর্কেও । এখানে যে কারও পাঠ-পর্যালোচনা নিশ্চয় এর সে অবস্থানকে সহজে চিহ্নিত করবে, বৌদ্ধিক সমালোচনায় দূরবর্তী কিছু মনে হবে না, সৌন্দর্য আর সংক্রামে হবে দিক-নির্দেশনাকারী এক উচ্ছ¡াস। বলতে গেলে কল্লোল তালুকদারের মতো যোগ্য ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব হয়েছে এমনটা।

কিন্তু এখন সময়টা মনে হয় অধঃপতনেরকাল! তাই এখনকার সময়ে পড়াশোনা আর ততটা দেখা যায় না, চারদিক যেনো স্ট্যানবাজিতে পূর্ণ; এর ফলে বাস্তবচিত্রটা দাঁড়াচ্ছে- অতিক্রমণ হয়ে উঠেছে আমাদের স্থবিরতার এক গল্প। মধ্যমেধার বরপুত্রেরা ঝেঁকে বসে আছে সব জায়গায়, রাজনীতিতে দেখি- বখাটেদের উৎপাত, আদর্শিক যে রাজনীতি ছিলো, সেখানে এখন পুরোই অন্ধকার! অপরাপর সত্তাগুলোতেও সে মচ্ছব সমান সক্রিয়, মধ্যমেধার জমিনে তাই লক্ষ্যণীয় হলো উৎকট চিৎকার, সাংস্কৃতিক অবদমনে- বাকহীন এক অবস্থা; মূল্যায়নের যদি কিছু থাকে, তবে তার পরিমাণগত দিকটা হচ্ছে ডাকাতি অর্থনীতির। এই অবস্থার ওপর একজন লিখবেন ও গবেষণায় হবেন আন্তরিক- দুরূহ বৈ কি। সমস্যা- এর অবস্থারই সাক্ষ্য বহণ করে, এর ফলে পিছিয়ে পড়া সমাজে বস্তাপচার মতো একটা কিছুর বাড়বাড়ন্তকে উৎসাহিত করে। বলতে গেলে এটা হলো এখন আমাদের সমাজের মূল প্রবণতা, এর মধ্যে ভিন্ন কিছু চিন্তা ও সেরকম প্রকাশনা তাই সহজ সাধ্য নয়। তবুও কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন, সেই বস্তপচা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জাড্যতায় নিয়ে আসেন প্রাণঘন বার্তা বা বয়ান। এখানে লেখককে হতে হয় একগুঁয়েই- কথাটা বলেছিলেন অবশ্য ওরহান পামুক; আমরা এখানে দেখবো- কল্লোল এর এটা হলো প্রথম বই, তবুও কী ওজনদার বইটা না তিনি লিখেছেন!

উল্লেখ্য যে, এর সবটা আমি এখনো পড়ে শেষ করতে পারিনি, তবে এখানে বলার মতো সাহসটা হচ্ছে পাখির চোখ দিয়ে দেখা- মনোযোগী পাঠের জন্য তা যথেষ্ট নয়, তবুও এর উপক্রমণিকা থেকে মনে হবে এ এক বিদ্যায়তনিক আলোচনা । আমরা দেখি, গ্রন্থের বাহির ও তার শিরোনাম যা ধারণ করে আছে, সে মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে বইটা শুরু হয়েছে উপনিবেশকাল ও তার রাজনীতি দিয়ে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে স্থান করে নিয়েছে সুনামগঞ্জের নামকরণ প্রসঙ্গও- ‘সুনামের নামতত্ত¡’; কিন্তু এখানে লেখকের কী মন্তব্য তা আমরা স্পষ্ট করে কিছু জানতে পারি না। আত্মগত ও বিষয়ীগত আবেগের অবস্থানও তত অস্পষ্ট নয়, তবে ভুলে যাবার বিরুদ্ধে যদি ইতিহাস চর্চা হয় একটা দায়, তবে বলতে হবে, স্থানীয় পর্যায়ে সে চর্চা এবং তার কালের অনেক বিস্মৃত নায়ক সম্পর্কে আমরা এখান থেকে ভালোই জানতে পারি।  এর পরই শুরু হয় এর দ্বিতীয় অধ্যায়- পাকিস্তান আমল। এই পাকিস্তান আমল থেকেই ইতিহাসের যে স্রোত- তা প্রবাহিত হয় অধিক, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের দিক থেকে এটা ছিলো তার উপনিবেশিক শোষণের দ্বিতীয় পর্যায় এবং এর মেয়াদকালও কম নয়- ২৩ বছর! তবে মোহভঙ্গ পাঠেরও বেশি সময় লাগেনি, ছাত্র-রাজনীতি তার ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে লাভ করে ইতিহাস নির্মাণ করার মতো প্রভাব- ভাষা আন্দোলন হলো সেই সময়ের কীর্তি। ইতিহাসের এই কীর্তি ও ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব হয়ে উঠেন চেতনার আরেক নাম ও এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। এভাবে যুক্তফ্রন্ট থেকে ছয় দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচনে দেখা যায়, তিনি ততদিনে মহীরূহ- বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা থেকে শুরু করে নতুন এক রাষ্ট্রের পিতা। এটা তাঁর জন্য সহজ ছিলো না, তাই সেসব দিন ঐতিহাসিক যোগ সৃষ্টিতে তাঁকে করতে হয়েছিলো বিস্তর রাজনৈতিক সফর; সেই সফরগুলো মধ্যে  ৮টির বৃত্তান্ত স্থান পেয়েছে কল্লোল এর এই বইয়ে- যা এর মূল আবেদন ও বিষয়বস্তু।

এখানে লক্ষ্যণীয় হলো এই আবেদন ও বিষয়বস্তু কেবল আর সংবাদসূত্রের একটা বয়ান হয়ে নেই, সেই সাথে আছে এর বিস্তৃত পরিপার্শ্বের বয়ানও। সে কারণে পাঠকের কাছে এর আকার যত না স্ফিত, এখানে তত লক্ষ্য করা যায় এর যৌক্তিক নির্মিতি। তাই প্রবোধ ছাড়াও এটা পাঠকের মন ভার করবে এমন নয়, তবে এটা বলা যায়, এই বিচার লেখকের জন্য হয়তো থেকে যাবে আরও অনেক দিন। আমরা এবার শেষের দিকে চলে এসেছি, তবে সততাপূর্ণভাবে আরও একবার উল্লেখ করা উচিত যে, ধৈর্যই হলো মহত্তের লক্ষণ। এখানে আলোচ্য এই বইটিকে আমি বলেছিলাম, বিদ্যায়তনিক এক আলোচনা; তাই বলে সৌন্দর্যের প্রশ্নে সে আমাদের চিন্তাকে আঘাত করে না বা অভিঘাত আর পুনরুৎপাদনে ব্যর্থ- এমনটা বলা হবে ভুল।

সবশেষে নিচ্ছি দেরিদার স্মরণ, তাঁর একটা কথা মনে পড়ছে, এখানে রাখছি সেটাও- ‘আমরা হচ্ছি বইয়ের অভিভাবক।’ কেন- সেদিকে আর যাই না; তবে এটা বেশ ভালো করেই মনে রাখতে হচ্ছে যে, আমরা বাস করি অংশীদারিত্বপূর্ণ একটা বিশ্বে। এদিক থেকে একজন লেখক হলেন মূলত যত্র যোগাড়িয়া; কল্লোল তালুকদার তাঁর ‘সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীত’ লিখতে গিয়ে গ্রন্থপঞ্জির যে দ্বার উন্মোচন করলেন, আমাদের সামনে রাখলেন তাঁর রত্নাকরীয় ধৈর্য আর কাজ, বিনির্মাণে- বলতে গেলে সেটা বিস্ময়কর এবং এর ওজনও তাই অসামান্য।

আমরা তাঁর প্রশংসা করি।