Cinque Terre

মোহাম্মদ আলী

১৫ এপ্রিল , ২০২০


প্রাবন্ধিক


উৎসবহীন বৈশাখ

আজ উৎসবহীন বৈশাখের প্রথম দিন। বাংলা বছরের শুরুর দিনটি আর কখনো এমন হয়নি। বাঙালি দলবেঁধে অনুষ্ঠানে যায়নি আজ। ঘরে-বাইরে কোথাও পান্তা ইলিশ খায়নি। কোথাও  বাউল গানের আসর বসেনি। মেলায় যায়নি। যাবে কোথায়, মেলা-ই নেই। গাঁয়ের মেয়েদের রেশমি চুড়ি আর লাল ফিতেতে চুল বাঁধা হয়নি। বাঁশি আর মুখোশে নিজেকে ঢাকেনি শিশুরা। আজ টিভিতে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে সমস্বরে শুনিনি ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’

বাঙালির জন্য এমন বৈশাখ বরণ আগে আর কখনো হয়নি। পান্তা ইলিশ খাওয়ার সাধ, সময় আর সাধ্য নেই অনেকের। এই করোনার কালে ভুলেও কারো মনে হবে না, উৎসবে যাই, কিংবা অনুষ্ঠান করি। এখন একা থাকার দিন। কোথায় উৎসব? কোথাও কিছু নেই, সব স্তব্দ। আতঙ্কে আছে আমার মাতৃভূমি, গোটা পৃথিবী।

উৎসব আয়োজন ও উদযাপনের জন্যে প্রথম প্রয়োজন মনের আনন্দ। উৎসব তো আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। অথচ আজ মানুষের মনে আনন্দ নেই। আনন্দের বদলে কেবল আতঙ্ক। বিশ্বব্যাপী এই মহামারীতে পতঙ্গের মতো মরছে মানুষ। কেউ চিকিৎসা পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। দেখা দিচ্ছে খাবার সঙ্কট। মানুষ যদিও বাড়িয়েছে সাহায্যের হাত, তবু তা বড় অপ্রতুল। তাছাড়া এ এমন এক রোগ, ঘরে থাকতে হয়। বাইরে বেরুলেই মৃত্যুর হাতছানি। তবে এটি স্পষ্ট করে বলছি, আতঙ্ক নয় আমাদের প্রয়োজন সচেতনতার। 

করোনা বড় কঠিন আর রহস্যময়। সামাজিক দূরত্ব এ রোগের বড় প্রতিষেধক। তাই মানুষ আজ দিশেহারা। বড় অস্বস্তিতে কাটছে বিশ্ববাসীর দিন। বাঙালির জীবনেও আনন্দ নেই। নেই উৎসব। আজ প্রীতিবিনিময়ের একমাত্র উপায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কারণ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবার জন্য অবশ্যপালনীয় বিধান হলো ঘরে থাকা। 

বাঙালির জীবনে নববর্ষ নিয়ে আসে নানা ব্যঞ্জনা ও খুশির খোরাক। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী লড়াই শুরু হয়েছিল মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তবে ক্রমেই তা সংহত হয়েছে বাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে। রবীন্দ্র-নজরুলের দেখানো সাংস্কৃতিক পথে হেঁটেছে বাঙালি।

এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল চালিকা ছিল মানুষের সম্মিলন। সবার আবেগ ও সব অনুষঙ্গ যেন ক্রমেই একত্রিত হয়েছিল বৈশাখের উৎসবের বহুমাত্রিকতায়। বাংলা নববর্ষ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণের উৎসব। এ দেশের আদিবাসীরাও এ সময়ে বৈসাবি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে পালন করেন। ওই উৎসবও নবর্ষের। বাংলাদেশে এসব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ফলে এই উপলক্ষগুলো আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর। 

পঞ্চাশের দশকে নবজাগ্রত বাঙালি বাঙালিয়ানা চেতনায় ঋদ্ধ হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ছোটবড় নানা পরিসরে নববর্ষ পালিত হয়েছে। তবে ১৯৬৩ সনে সংগীত সংগঠন ছায়ানটের উদ্যোগে প্রথম কোনো মুক্ত জনপরিসরে রমনা পার্কের বটমূলে বড় আয়োজনে নববর্ষের প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু হয়। 

সেকালে পাকিস্তান সরকার বহুভাবে চেষ্টা করেছে এই উৎসব বন্ধ করার। কিন্তু ততদিনে তা হয়ে উঠেছিল সবার প্রাণের উৎসব। আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবি জোরদার হলে নববর্ষ উদযাপনের প্রয়াস যেমন বেড়েছে তেমনি রমনা বটমূলের নববর্ষে প্রভাতী অনুষ্ঠানে মানুষের যুক্ত হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। 

তবে উৎসব বন্ধ থাকল কেবল ১৯৭১ এ। সে তো মুক্তিযুদ্ধের বছর, জাতি তখন আপন স্বদেশ গড়ার পথে রণাঙ্গণে ত্যাগে-বীরত্বে লড়ে চলেছে। তখন উৎসবের ফুসরৎ কোথায়। আজও যেনো আমাদের আবার অস্তিত্বেও লড়াই হচ্ছে। এ যুদ্ধেও আমাদের জিততে হবে। এ যুদ্ধও আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই।   

এখন বৈশাখী উৎসবের আয়োজন জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রভাতী অনুষ্ঠান কোথাও গড়িয়েছে দিনব্যাপী, কোথাও বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের বর্ণিল অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। এখন নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী মেলা নগরেও প্রচলিত। আকর্ষণের কেন্দ্র চলে এলো বাদ্যে, সজ্জায়, বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এসবই ছিল বাঙালির চিরকালিন লোকজ ঐতিহ্য। রাজধানীর এই শোভাযাত্রা দিনে দিনে কলেবরেও আকর্ষণে বড় হয়েছে। দেশের আনাচে কানাচেও এই ধারা পালিত হচ্ছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের নববর্ষ যেন উচ্চতর মর্যাদায় বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীর তাবৎ জাতির নববর্ষের নিজস্ব অনুষ্ঠান রয়েছে। আমাদের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে বৈশাখ নবরূপে হাজির হয় আমাদের মাঝে।

আজ তাই শিশুরাও বিষাদে। বর্তমান সরকার গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই উৎসব চালু করায় শিক্ষার্থীরা আপন ঐতিহ্য লালন করার সুযোগ পেয়েছে। আসলে নিজেদের সংস্কৃতি নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে হয়। তাই যদিও বাইরে গিয়ে ১৪২৭ বাংলা সনের প্রথম দিন আমরা উদযাপন করতে পারিনি, কিন্তু এই বেদনা থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

এই শিক্ষা হলো-গোটা পৃথিবী আজ বিমর্ষ। মানুষের মনে উৎকন্ঠা। তাই সকল মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে হবে। নির্ধারিত নিয়ম মানতে হবে সবাইকে। সর্বোপরি সচেতন হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। কৃচ্ছতা সাধন ও ঘরে থাকার কঠোর নিয়ম অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। তবেই পরের যে বৈশাখ বাঙালির জীবনে আসবে সেটি হবে, উদ্বেগহীন, রোগহীন উৎসবমুখর।