Cinque Terre

আদিব বাসিম

১১ নভেম্বর , ২০২০


গদ্যকার


হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী : সাফল্যের দূত

উন্নয়নের আলোর মশাল জ্বালিয়ে সিলেটবাসীকে আলোকিত করার ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। যোগাযোগ আর শিক্ষায় নিয়ে এসেছিলেন যুগান্তকারী পরিবর্তন। দেশে-বিদেশে নিজ প্রতিভায় ছিলেন ভাস্বর। ছিলেন কূটনীতিবিদ, রাষ্ট্রদূত,মন্ত্রী, স্পীকার, আধুনিক সিলেটর স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। আজ তাঁর ৯৩তম জন্মদিন। 

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ১৯২৮ সালের ১১ নভেম্বর  সুনামগঞ্জের এক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুর রশীদ চৌধুরী এবং মাতা সিরাজুন্নেসা চৌধুরী। তারা দুজনেই ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। জনকল্যানমুখি রাজনীতি আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তাঁদের আদর্শ। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর জীবনে এর প্রতিফলন ছিল ষোলআনা। তাঁর জীবন ছিল সাফল্যের পত্র-পুষ্পে পূর্ণ কলেবরে বিকশিত।

১৯৪৭ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তারপর ইংলিশ বারে অধ্যয়ন করেন ও লন্ডনের ইনার টেম্পলের একজন সদস্য হন। লন্ডনেরই ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠান’ থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। এছাড়াও, ম্যাসাচুসেটসের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপে পাকিস্তান ছাত্র সংসদের সভাপতি ছিলেন। সে সুবাদেই তিনি যুক্তরাজ্যে প্রথম এশিয়ান স্টুডেন্টস কনফারেন্স আয়োজনে সক্ষমতা দেখান।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন। এর ফলে তিনি ওই বিভাগের আওতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এছাড়াও, লন্ডনের ব্রিটিশ বৈদেশিক কার্যালয় এবং কমনওয়েলথ কার্যালয়েও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি জার্মানিতে, সৌদি আরবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (১৯৮৫-৮৬) দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪১-তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে তিনি পর পর জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা হুমায়ূন রশীদকে আওয়ামী লীগে নিয়ে আসেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পুনরায় তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদের স্পীকার নির্বাচিত হন।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি নতুন দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বীকৃতির জন্য যোগাযোগ রক্ষা করেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেন। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হুমায়ূন রশীদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তার দুই কন্যাকে আশ্রয় দেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিলÑ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়েদের আশ্রয় দিয়েছি। এটা আমার কর্তব্য। এর জন্য আমি ভীত নই।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামে। দেশে না থাকায় বেঁচে যান তাঁরা। তবে জীবন সংশয় ছিল দেশের বাইরেও। ওই সময় ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে জার্মানিতে (তখনকার পশ্চিম জার্মানি) আশ্রয় দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি সেখানকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন তিনি। এ ব্যাপারে তৎকালিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। ফলে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের ব্যবস্থাপনায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা  নয়া দিল্লীতে যান।

বঙ্গবন্ধুর আশ্রয় দেওয়ার জন্য হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। সংকটে পড়ে তাঁর জীবন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি ‘হত্যা-তালিকা’ তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচ নম্বরে নাম ছিল হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর। তাঁকে দেশে এনে মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সতর্ক থাকায় মোস্তাক সরকার সেটি পারেনি। পরে অবশ্য ওএসডি করে তাঁকে দেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ মাস ওএসডি ছিলেন তিনি। 

১৯৮৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। 

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সিলেট-১ আসন থেকে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদের এবং ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদের সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সে সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে তৃতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এ সময় সাধারণ পরিষদের বেশকটি অধিবেশনে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সভাপতিত্ব করেন। ওআইসির চতুর্দশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি জাতিসংঘের ৩৯তম নিয়মিত অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন ১৯৮৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। ইউএনজি-এ সভাপতি হিসেবে তিনি জাতিসংঘ প্রশাসন ও বাজেট সংস্কারক বিষয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণের পদক্ষেপ নেন।

কূটনীতিবিদ হিসেবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে অবস্থান করেছিলেন। তন্মধ্যে রোম, বাগদাদ, প্যারিস, লিসবন, জাকার্তা এবং নতুন দিল্লী অন্যতম। ১৯৭১-৭২ সালে তিনি নতুন দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ছিলেন। ঐ সময় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য তিনি ৪০টিরও বেশি দেশে যোগাযোগ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানীতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের পর সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ভ্যাটিকানেও একই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক পরমানু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ এবং জাতিসংঘের শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন সংস্থা বা ইউনিডো'র প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারী থেকে ১৯৮৪ সালে ‘মহাত্মা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ পান। বিশ্ব শান্তিকল্পে অনবদ্য কূটনৈতিক ভূমিকার জন্য তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও, তিনি ‘উথান্ট শান্তি পদক’ লাভ করেছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সিলেটে ব্যাপক উন্নয়ন হয়। সিলেটকে পূর্ণাঙ্গ বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, সিলেট শিক্ষা বোর্ড, সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ, সিলেট ওসমানী বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে রূপান্তরিতকরণ, বন্ধ হয়ে যাওয়া সিলেটের টেক্সটাইল মিল পুনরায় চালু, অবহেলিত কোম্পানীগঞ্জের সঙ্গে সিলেটের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে সালুটিকর, কাটাখাল ব্রীজ ও রাস্তা নির্মাণ, সদর উপজেলার টুকেরবাজারে সুরমা নদীর উপর শাহজালাল ব্রীজ-৩, বাদাঘাট সিংগারখাল নদীর উপর বাদাঘাট ব্রীজ নির্মাণসহ সিলেট নগরী ও নগরীর বাইরে অসংখ্য ব্রীজ-কালভার্ট নির্মান, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণসহ এ অঞ্চলের বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয় তাঁর একান্ত কর্মপ্রচেষ্ঠায়। সিলেটের সুরমা নদীর উপর একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মানের পরিকল্পনা ছিল হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর। এছাড়া সে সময় তার ঐকান্তিকতা চেষ্ঠায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে চার লেনে রূপান্তরিত করার একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল। পরে সেই প্রকল্পকেই চার লেনের পরিবর্তে দুই লেন করা হয়। তাঁর সময়েই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ন হয়। এই উপজেলাকে তিনি পর্যটন উপজেলায় রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে অনেক কাজও হাতে নিয়েছিলেন। 

সিলেটের কৃতী সন্তান ও অকৃত্রিম দরদী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ২০০১ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নেই কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অমর কীর্তি। সিলেটবাসী যা কোরদিন ভুলবে না। আজ তাঁর জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।