Cinque Terre

শাকির আলম কোরেশী

৩০ নভেম্বর , ২০২০


সম্পাদক

ব্রেকিংস২৪.কম


রাজনৈতিক দলের অপমৃত্যু : নেপথ্য কথন

সংবাদটি বোধহয় ভারতীয় কোন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছিল। বেশ ক’বছর আগের হওয়ায় সঠিকভাবে মনে আসছে না। তবে বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক। খবরটি অনেকটা এরকম ছিল-‘ভাষার মাসে একটি ভাষার অপমৃত্যু’। অর্থাৎ ওই ভাষায় কথা বলার শেষ মানুষটির মৃত্যুতে পৃথিবী থেকে একটি ভাষার চিরবিদায়। দুনিয়ায় এমন অনেক উপজাতীয় ভাষা রয়েছে যা শুধু মুখে মুখেই উচ্চারিত হয়, যার এমন কোন আর্থ-সামাজিক পরিধি বা চাহিদা প্রতিষ্ঠা পায়নি। সুন্দর কোনো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব কোন সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষ্টি এমনকি তার কোন স্বকীয় বর্ণমালা পর্যন্ত যাদের নেই, এরকম দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত ভাষা কয়েক জেনারেশন পরেই মুখে মুখে উচ্চারিত হওয়ার মতো শেষ ব্যক্তিকেও হয়তো খুঁজে না পাওয়ারই কথা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রাপ্ত স্বীকৃতির প্রস্তাবকারী রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই উপজাতি এই নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার অপমৃত্যুতে অবশ্যই মর্মাহত, ব্যথিত।

এতদিন পরে খবরটি মনে ধরার কারণ কিন্তু অন্য জায়গায়। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এক সময়ের প্রতিভাবান সভাপতি জনাব ড. ফেরদৌস কোরেশীর মৃত্যু সংবাদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি রাজনৈতিক দলের অপমৃত্যুর বিষয়টি চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে পার্টি প্রতিষ্ঠার আগ্রহ ও ব্যক্তি স্বার্থে গঠিত এবং প্রচারিত অনেক রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে যাদের কাঠামো, পরিধি এমনকি আদর্শিক চিন্তা-চেতনা পঞ্চান্ন হাজার বর্গ মাইলতো দূরের কথা, নিজ বাড়ির শেষ প্রান্তেও অনেক সময় আদর্শের বার্তা পৌঁছেনি। এমন অনেক রাজনৈতিক দল নিয়ে আলোচনা করা যাবে যাদের কর্ম পরিধি নিজ বাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে যাদের শীর্ষ পদ দুইটি একই খাটের দুই বাসিন্দার দখলে। রাজনৈতিক নীতি নৈতিকতার কদর বা পরিধি কতটুকু হলে এর ব্যাপ্তি বা পরিপূর্ণতা ডাবল সাইজের লেপ-তুষকের নিচে চাপা থাকে, জানালায় উঁকি দিলেই তার একটি সচিত্র চেহারা চোখে ভাসবে। 

ক’দিন আগে বিশ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা ) সভানেত্রী রেহেনা প্রধানের দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীর অনুষ্ঠান দেখে বিষয়টি ভাবনায় এসেছে। শিন্নি তবারক খেতে আসা গুটি কয়েক এতিম মিসকিন ছাড়া ২০ দলীয় জোটের পিছনের সারিরও কাউকেই সেদিন দেখা যায়নি। ভদ্রমহিলা গত বছর ২২ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের একটি ক্লিনিকে দীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন। জাগপার সাবেক সভাপতি ছাত্রলীগের (৭৩-৭৪) সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের মৃত্যুর পর মে ২০১৭-এর শেষের দিকে বাড়ির কেয়ারটেকারকে সেক্রেটারির দায়িত্ব দিয়ে তার সহধর্মনী রেহেনা প্রধান পার্টি প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক বছর পার হতে না হতেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার মৃত্যুতে একটি রাজনৈতিক দল মৃত্যুর দুয়ারে চলে গেছে এবং ২০ দলীয় জোটকে উনিশে নামিয়ে এনেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও সংগঠনের এমন মৃত্যুর ঘটনা মানুষ আগেও দেখেছে। আগামীতেও যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলগুলি ব্যক্তির অবর্তমানে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বে না তারও কি কোন নিশ্চয়তা আছে?  বিশেষ এসাইনমেন্ট নিয়ে গঠিত দলগুলি উই পোকারও জীবন পায়নি কোনো কালে। মোস্তাকের ডেমোক্রেটিক লীগ, ফারুকের ফ্রিডম পার্টি কখন কীভাবে যে অদৃশ্য হলো, পাশের বাড়ির লোকজনও টের পায়নি। ডা. মতিনের জাতীয় পার্টি, জনাব মিজানের খ-িত আওয়ামী লীগ জাতীয় আর্কাইভে আছে কিনা কিউরেটারদের জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানা যাবে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি, আন্দালিব রহমান পার্থের বিজেপি, কাজী জাফরের জাতীয় পাটি (জাফর ) যেন এক মালিকানার দোকানদারের ন্যায় সদাইপাতি নিয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে। কখন যে কার ফ্রিজে ঢুকেন ন্যায্য দর কষাকষিতে, রাজনীতির জোটবদ্ধ গ্রাহকরাই ভাল জানেন। মুখে বুলি আর গলায় গামছা ছাড়া কাদের সিদ্দিকীকে কি কেউ দেখেছেন কোথাও পরিপাটিভাবে বিগত দিনে? কী দরকার ছিল পার্টি গঠনের ছাত্রলীগের প্রাক্তন স্বপ্নবান সভাপতি ড. ফেরদৌস কোরেশীর? কেউ কি কোথাও দেখেছেন প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টির অফিস কিংবা সাইনবোর্ড?  শুনলে কার কাছে না খারাপ লাগে পার্টি নিয়ে দীর্ঘদিন ওঈট তে পড়ে থাকা ফেরদৌস কোরেশীর অতি সম্প্রতি নীরবে পরবাসী হওয়া। কর্নেল অলি, জেনারেল ইব্রাহিম তো চৈত্র মাসের বয়ানই দিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রলীগ যাদেরকেই কেন্দ্রে পিক করেছে, তাদের প্রায় সবাই ভাবনার সাগরে, কল্পনার জগতে নিজেদের উচ্চ আসনে দেখেছেন। ফেরদৌস কোরেশী, শেখ শহিদুল ইসলাম,  শাহজাহান সিরাজ, আ স ম রব, শফিউল আলম প্রধান,শওকত হোসেন নীলু সহ অনেকেই ক্ষমতার দিকে চেয়ে বৃত্তের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেছেন বা কেহ কেহ এখনো ঘুরছেন। যৌথ মালিকানার পার্টি ব্যাবসায়ী রব-মান্নারা রাজপথে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও বাংলার মানুষ কিন্তু ঠিকই তাদের চিনে। সরকার হঠানোর আন্দোলনে যেখানে বিরোধীদল রাস্তায় থাকার কথা বা সরকার পতনে বিরোধীদলের বিজয় উৎসব করার কথা সেখানে স্বৈরাচার পতনের সময়কার সংসদের বিরোধীদলের নেতা আ স ম রব দলবলসহ কোথায় যে পালিয়ে গিয়েছিলেন তানিয়া রবও জানতেন কিনা সন্দেহ আছে। বিষয়টি নিয়ে তো মানুষ এখনো ঠাট্টা তামাশা করে। রাজনীতির ইতিহাসে সরকার পতনের সময় বিরোধী দলের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বের কোথাও আছে কিনা জানা নেই। মাহমুদুর রহমান মান্না তো আরও ভয়ঙ্কর। নেতার কাছে রাজনৈতিক দীক্ষা নিতে গিয়ে তাকে সংসার বৈরাগী করেছেন। অন্যের সাজানো সংসারে নিজে কর্তা সেজেছেন। বিশ্বস্ত সেকেন্ডম্যান না পাওয়াতে বাঘা সিদ্দিকী, রব, প্রধানরা জীবনসঙ্গীকে পার্টি লাইনে দাঁড় করালেও মান্না কিন্তু নিজের কুকর্মকে পর্দার আড়ালে রাখতে সেদিকে পা মাড়াননি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেনের একটি বহুমাত্রিক গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে সর্বমহলে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন, ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে মন্ত্রীসভায় কাজ করেছেন। দেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সাধারণ মানষের কাছে এখনও এক অনন্য উচ্চতায় রয়েছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও একজন বাংলাদেশী হিসেবে তার প্রচুর আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে। ভদ্রলোক বিভিন্ন দলের কিছু অবেহেলিত চৌকস রাজনৈতিক নেতা নিয়ে গণফোরাম গঠন করলেও রাজনীতির মাঠে প্রত্যাশিত তেমন কোন অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। বিগত ত্রিশ বছরে ন্যূনতম ত্রিশজন নিষ্ঠাবান কর্মীও গণফোরামে নাম লেখিয়েছে বলে মনে হয় না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে নিজগৃহে বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন ড. কামাল হোসেন। ড. রেজা কিবরিয়াসহ অসংখ্য গুনীজনদের দলে ভেড়ালেও তৃণমূলে এর ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বরং তার অবর্তমানে দল যে ভগ্নাংশে খন্ডিত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দলতো রীতিমত নিজের ক্লিনিকেই শয্যাশায়ী। মুত্যুঝুঁকি থেকে দলকে বাঁচিয়ে রাখতে ছেলে মাহীর দ্বারা যে সম্ভব না, সেটা দেশবাসী ইতোমধ্যেই বুঝে ফেলেছে। ইসলামী দলগুলি তো আরও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ভাঙ্গা গড়ার প্রশ্নে বাম দলগুলি বরং তাদের চেয়ে ইজ্জত নিয়ে টিকে আছে জাতীয়ভাবে। এক সময় আমার পাশের বাড়ির একনিষ্ট ইসলামী আন্দোলনের একজন সৎ কর্মী বুকে সাহস নিয়ে নির্বাচনের সময় প্রায়ই মাইকিং করতেন-‘যে খেজুর খাইয়া নবী, ইসলাম আনছেন জগতে/ খেজুর গাছে ভোট না দিবায় কোন মতে’। অথচ আজ তারাই থাকেনি বেশিদিন খেজুর গাছের নিচে। ব্যক্তিস্বার্থ ও ভাগ বাটোয়ারার রাজনীতিতে কখনও বটগাছ, কখনও মিনার বা গোলাপফুল ইত্যাদি উপদলে বিভক্ত হয়ে তারা রাজনীতি যে একটা বিজ্ঞান সেই ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছেন । দান খয়রাতের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত তাদের কমিউনিটিকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে সুবিধা নিতে কখনও তারা ধানের শীষে আবার কখনও নৌকায় উঠতেও ওযু তাইমুম করারও সময় নেননি। এই সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি বা অপমৃত্যু কখন যে কোথায় কীভাবে হয় এলাকার এতিম মিসকিনরাও খবর পায় কিনা সন্দেহ। তরকারীতে একটু লবন কম হলেই বউ ছাড়তে হবে, এদের দ্বারা সংসার করা কখনও সম্ভব নয়। রাজনীতিতেও এমন চরিত্রের নেতাদের সংসার বৈরাগী হওয়া অনিবার্য।

থিওরিটিক্যালি রাজনীতি একটি বিজ্ঞান। অর্থনীতি, শিল্পসাহিত্য ও দর্শন যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিশ্বের নামীদামী সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরকমই এটিকে পড়ানো হয়। অথচ আমাদের দেশের একটি বিরাট অংশ তার ন্যূনতম ধারণা না রেখেই নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে। যার কারণে তৃণমূলে এখনও রাজনীতি ন্যূনতম কোন ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। নেতার পিছনে হাঁটা, তার বাড়িতে আসা-যাওয়া এবং কমিটিতে কোনভাবেই নিজের নাম ঢুকানোর চেষ্টা, এটাই হল বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতির চেহারা। ঘরে পরের দিনের খাবারের কোন বন্দোবস্ত নেই অথচ সে স্বেচ্ছাসেবক দল বা লীগের পদবী নিয়ে বাজার মাতিয়ে রাখে। বিয়ে করা যেমন ফরজ, শুনেছি অনেকের ক্ষেত্রে বিয়ে না করাও তেমনি ফরজ। ঠিক একইভাবে সবার জন্য রাজনীতি করা উচিত না। প্রথমেই নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করা জরুরি। পরিবারের স্বচ্ছলতার বিষয়টি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। গোটা পরিবারকে অভাব অনটনের মধ্যে রেখে দলের জন্য নিজের আত্মত্যাগ নির্ঘাৎ বখাটেপনার সামিল। বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নেতার সঙ্গে সেল্ফি তুলে সম্মেলনে ঢাকা যাচ্ছি এমন স্ট্যাটাস দেওয়া ছেলের মা পরদিন অন্যের দরজায় নক করে ওষুধ কেনার জন্য সাহায্য প্রার্থনা আমাদেরকে কী বার্তা দিচ্ছে? এমন কারো রাজনীতি করার দরকার নেই এমন বাধ্যবাধকতা প্রত্যেক দলের তৃণমূলে থাকা জরুরি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ রকম নির্দেশনা থাকা আবশ্যক। তাহলেই তৃণমুলে জাতীয় রাজনীতির একটি সুস্থ ও সুষম শক্ত ভিত্তি গড়ে উঠবে।