Cinque Terre

মানস কান্তি দাস

৩০ নভেম্বর , ২০২০


এমবিবিএস; এমডি; এফএসিপি  

এসোসিয়েট প্রোগ্রাম ডিরেক্টর;

ইন্টার্নেল মেডিসিন রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম

প্রিন্স জর্জেস হাসপাতাল

ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড

ইউএসএ


স্বাস্থ্যখাতের স্বচ্ছতা : জনগণের অধিকার

মানবাধিকার, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক চিরস্থায়ী। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (ইউডিএইচআর) এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিএসইসিআর) স্বাস্থ্যকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে এ ধারণাটিকে আরও মজবুত করে তোলে। অধিকন্তু, মানবাধিকারগুলিও মানব বিকাশের একটি সমীকরণ হিসাবে স্বীকৃত। (বি এম সি জার্নাল ২০০৬)।এই গবেষণাপত্রে মানবাধিকার এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমত মানবাধিকার, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশ্লেষণ এবং তৃতীয়ত কিভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকাশ ও মানবাধিকারের উন্নয়ন করা যায় তার বিষদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য অধিকার উন্নয়নে সরকারের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও নির্দেশনা দেয়া আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গঠনতন্ত্র স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের মধ্যকার সম্পর্কের আলোকপাত করেছে। এতে বলা হয়েছে যে ‘স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য মান উপভোগ জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য ছাড়াই প্রতিটি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার’। 

১৯৭৮ সালে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এর আলমা-আটা ঘোষণা এবং ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য প্রচারের জন্য অটোয়া সনদ, ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (ইউডিএইচআর) এবং ১৯৬৬ সালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিইএসসিআর) ব্যক্তি এবং পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য সমান অধিকারকে আরও প্রশস্থ করে। মানবাধিকার কেবল নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয়নি, সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, এবং কর্মসংস্থানের অধিকারকেও গুরুত্ব প্রদান করেছে। অধিকন্তু, মানবাধিকারের মৌলিক শিরোনাম হলো-প্রতিটি ব্যক্তির মর্যাদাকে একজন মানুষ হিসাবে রক্ষা করা। সামাজিক অধিকার পূরণের সংস্থান এবং ব্যয় সংহত করার জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তদুপরি, সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের সক্রিয় সম্পৃক্ততা এবং নীতি নির্ধারণ, নীতি বাস্তবায়ন, বাজেট বরাদ্দ এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিটি ব্যক্তি তার অধিকার পেতে সক্ষম হবে তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। 

সুতরাং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, আবাসন, কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুষ্ঠু বিতরণের মতো মৌলিক সংস্থাগুলিতে সবার জন্য সুযোগের সাম্যতা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে এটি লক্ষ্য করা যায় যে রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসেবা, পর্যাপ্ত খাদ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং পর্যাপ্ত জীবিকা, প্রাপ্যতা ও সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রকৃত মৌলিক মানবাধিকার উপভোগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনা। সকল রাষ্ট্রের মানবাধিকারের লক্ষ্য পূরণের জন্য কার্যকর বিকল্পগুলি অন্বেষণ করা উচিত। অধিকন্তু, সামাজিক অসমতা, দুর্বিপাক ও বঞ্চনা নিরসনে রাষ্ট্রের ভূমিকা সামাজিক উন্নয়নে পরিবর্তন আনতে পারে। রাষ্ট্রের সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তার বিধানের ফলে দরিদ্র, দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলি সমাজে তাদের যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। রাষ্ট্রকে প্রতিটি ব্যক্তির অসুস্থতা ও রোগ থেকে রক্ষা করা, ন্যূনতম সেবা প্রদান এবং তাদের স্বাস্থ্য অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা হঠাৎ করেই কোন রোগ ছড়িয়ে পড়লে, সরকারকে নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। জাতি, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ এবং ভৌগলিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রত্যেককে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার ন্যূনতম মৌলিক শর্ত বজায় রাখা উচিত। প্রাথমিক পরিষেবা প্রদান কেবলমাত্র স্বাস্থ্যসেবাই নয়। এটি নিরাপদ খাদ্য, স্বাস্থ্যকর আশ্রয়, পানীয় জল, পয়ঃনিস্কাশন ইত্যাদিসহ হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রী  নিশ্চিত সহ প্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা বুঝায়। তাছাড়া, স্বাস্থ্য সংবাদ প্রচারে নাগরিকের জন্য আইনী, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংগঠনিক পরিবর্তনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুতরাং স্বাস্থ্য প্রচারমূলক ক্রিয়াকলাপের জন্য রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। সামগ্রীর প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা (সহজলভ্য এমন একটি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বোঝায় যা কোনও বাধা ছাড়াই সহজেই প্রাপ্য) বজায় রাখা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। (বাধা গুলোর মধ্যে আর্থিক, ভৌগলিক, ধর্মীয়, শ্রেণি এবং বর্ণ রয়েছে )। স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবাগুলির জন্য মৌলিক সুবিধার উপস্থিতি, মান বজায় রাখা, মান নিশ্চিতকরণের গ্রহণযোগ্য মানদ- এবং বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাগতভাবে পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলির অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহের ক্ষেত্রেও মান বজায় রাখা অতীব জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। এখন প্রশাসনিকভাবে দেশটি ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৯৩টি উপজেলা, ৪৯৬টি থানা এবং ৪৫৫৪ টি ইউনিয়নে বিভক্ত যা প্রশাসনের প্রাথমিক ইউনিট হিসাবে কাজ করে। বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সম্পর্কের আলোকপাত করলে বলা যায় বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং প্রধান নীতিমালার নথিগুলি স্বাস্থ্য অধিকার এবং তার উন্নয়নের স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায় :

(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;

(খ) কর্মের অধিকার, কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;

(গ) যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং

(ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য স্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।

বাংলাদেশ আইসিসিপিআর, আইসিইএসসিআরসহ বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলি অনুমোদন করেছে; আলমা-আটা, আইসিপিডি, বেইজিং ঘোষণা এবং মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট  লক্ষ্য সহ আন্তর্জাতিক ঘোষণার স্বাক্ষরকারী দেশ। তবে নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র/ হাসপাতাল বিনির্মাণ, মানবসম্পদ প্রস্তুত ও সহজলভ্য প্রাপ্যতা, সম্পদ বিতরণ, গ্রামীণ ও নগর বৈষম্য, নারী-পুরুষের ব্যবধান ইত্যাদি কারণে, সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক অসামঞ্জস্যতা বিরাজ করছে। তাই বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকাশ বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছনে অবস্থান করছে ।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সেবার ধরণের সঙ্গে মানবাধিকারের নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের উন্নয়নকে ব্যহত করছে। ‘বাংলাদেশ পর্যালোচনা’ শীর্ষক শিরোনামে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। নাগরিকদের ‘স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার’ এর ওপর কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয় ওই সনদে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতালসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে নানান উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয় ।

নাগরিকদের স্বাস্থ্য অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এই অধিকারগুলিকে গতিশীল করার জন্য সরকারকে সমন্বিত পদ্ধতি নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া। বাংলাদেশ সংসদে, সংসদ সদস্যদের পেশাদার বিভাগের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দল থেকে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব ছিল তবে ২০১৮ সালে তা ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে এ সমস্ত ব্যক্তিরা রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া প্রভাবিত করেন। সুতরাং এটি ইঙ্গিত করে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলি এমন কিছু লোকের ওপর কেন্দ্রীভূত যারা সম্পদ অর্জন এবং বিভিন্ন সরকারি খাতের সুযোগ-সুবিধা অর্জনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নীতি নিয়ন্ত্রণ ও বজায় রাখেন। বিশ্বব্যাংক বলেছে প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুলতা, নাগরিক ও সরকারি পর্যায়ে আইন প্রতিষ্ঠায় সদিচ্ছার অভাব। বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশে নগণ্যসংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থা জনগনের সুস্বাস্থ্যের অন্তরায়। তাছাড়া সেবা প্রদানকারী সংস্থার আন্তরিকতার অভাব, ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অনিয়মের দৌরাত্মসহ নানা পর্যায়ে নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে অব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। প্রায় সকল দেশেই নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকে সরকারের মূখ্য দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃত পক্ষান্তরে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে সরকারি হাসপাতাল যেন এক বিভীষিকার নাম, এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার নাম। এসবের পেছনে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তাদের উদাসীনতাই দায়ী। 

বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার চিত্র ভয়াবহ। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দালালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন কী সরকারি ট্রলি ব্যবহার করতেও বকশিসের নামে অর্থদ- দিতে হয়। অসহায়-দরিদ্র রোগীদেরকে যদি বা হাসপাতালের মেঝেতে ঠাঁই হয়, অনেক সময় তাদেরকে একটা স্বল্পমূল্যের ওষুধ ও বাহির থেকে ক্রয় করতে হয়। সরকারি হাসপাতালের এই বেহাল দশায় উপায়ন্তর না পেয়ে রোগীরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্ত হয়, আর সেই সুযোগ নিয়ে থাকে দালালরা।

‘বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে সম্পূর্ণ মুনাফা-ভিত্তিক বানিজ্য চলছে’ শীর্ষক শিরোনামে ‘বিবিসি বাংলা’ একটি সংবাদ প্রচার করেছিল। সেই প্রতিবেদনে দেশের বেসরকারি চিকিৎসার নামে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে নিয়ে কিভাবে বাণিজ্য চলছে তার চিত্র তুলে ধরা হয়। নিয়মিত সরকারি তদারকি না থাকায় সেবার অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা হয়, রোগীর মরদেহ টাকার জন্য আটকে রাখাসহ নানাভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হয়।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল ১৬১.৪ মিলিয়ন। জি ডি পি ২৭৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে মাথাপিছু মোট জাতীয় উৎপাদন ছিল ১২০৩.২০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৩.৯১শতাংশ এবং ২১.৮ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন।  এক জরিপে দেখা যায় একজন ব্যক্তি নিজ পকেট হতে চিকিৎসা বাবদ ৭১ ভাগ খরচ যোগান দিচ্ছেন যা ২০০৮ সালে ছিল ৬০ ভাগ। তাতে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে চলে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট মাত্র জি ডি পি র ২.৩৭%, যা দক্ষিন এশিয়াতে সর্বনিম্ন। সম্প্রতিক জাতীয় হিসাব মতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ব্যয় মোট ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জনপ্রতি মাথাপিছু ব্যয় ধার্য্য হয়েছে ২৬ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার যা একজন নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবায় সরকারের বাজেট থেকে খুবই স্বল্প পরিমানেই যুক্ত হয়। নাগরিকের নিজ পকেট আর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে স্বাস্থ্যের মূল খরচ আসে আর বাংলাদেশর বাজেট থেকে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ (০.৩) শতাংশ যুক্ত হয়। ২০১২ সাল থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়িয়ে ২৬ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবং বহিরাগত অনুদান ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের নাগরিকেদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা দেখার বিষয়। সরকার ২০৩২ সালের মধ্যে এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমপক্ষে জাতীয় বাজেটের ১৫% এবং জিডিপির ৫% হওয়া উচিত। ২০১২ সালে প্রণীত ‘স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল পত্রে’ ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ এবং ২০৩২ সালের মধ্যে মোট বাজেটের ১৫% অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো ০৬.০৬.২০২০)। কিন্ত পরবর্তীতে কোনো অর্থ বছরের বাজেটেই তার প্রতিফলন নেই, বরং তা আনুপাতিক হারে আরও কমেছে। একযুগ আগেও যেখানে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৬ শতাংশ, তা ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে নেমে এসেছে ৪.৯২ শতাংশে এবং জিডিপির মাত্র ০.৮৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মোটামুটি মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হলে প্রতি ১০,০০০ (দশ হাজার) মানুষের জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে সঙ্গে সেবিকা ও ধাত্রী মিলে কমপক্ষে ২৩ জন জনবল থাকতে হবে (উন্নত বিশ্বের এর পরিমাণ কমপক্ষে ৪৪ জন); কিন্ত বাংলাদেশে আছে মাত্র ৮.৩ জন। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারতে আছে ২৮.৫ জন, নেপালে ৩৩.৫ জন, শ্রীলংকায় ৩৬.৮ জন, মালদ্বীপে ১১.৮ জন, ভুটানে ১৯.৩ জন, থাইল্যান্ডে ২৮ জন, আর দক্ষিণ কোরিয়ায় আছে ৮১.৪ জন। একজন চিকিৎসকের সঙ্গে থাকতে হবে ৩ জন সেবিকা ও ৫ জন অন্যান্য চিকিৎসা সেবাকর্মী। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে আছে ০.৩ জন সেবিকা আর ০.৬ জন অন্যান্য চিকিৎসা সেবাকর্মী। আবার এই সীমিত জনবলের মধ্যে ২০১৯ সালে ২৭.২৭% পদই শূন্য ছিল। (সূত্র : এইচ আর এইচ ডাটা শীট-২০১৯, এইচআরএম ইউনিট, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়)। ২০২০-এর এই করোনাকালীন মহামারীতে স্বাস্থ্যখাতের আসল চেহারা ফুটে উঠেছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৯,২৪৬ কোটি টাকা।

গত অর্থ বছরে এর পরিমাণ ছিল ২৫,৭৯২ কোটি টাকা। তবে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির প্রদেয় উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ বাদ দিলে দেখা যাবে গতবারের তুলনায় প্রকৃত বরাদ্দ মাত্র ১,০২২ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ১৪% বেশি। অবশ্য করোনাকালীন ও করোনা উত্তর স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় আরও ১০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে আরও বরাদ্দের প্রয়োজন। (এ সকল তথ্য ডক্টরস ফর হ্যালথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর ৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্য থেকে নেওয়া)। এই বাজেটে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে পরিচালিত কার্যক্রমকে বেগবান করার কথা বলা হয়েছে। কিন্ত এই করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যা ঘটে চলেছে তা আমাদের সকলেরই জানা। আসবাবপত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে মাস্ক এবং পিপিই সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে; পণ্য সরবরাহ না করেই বিপুল পরিমান অর্থ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বদলী হয়ে গিয়েছেন বলে জবাব দেন। যিনি স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তিনি জবাব দিলেন, ঘটনাটি তিনি দায়িত্বভার নেওয়ার আগে ঘটেছে। 

ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে, এতে জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। তবে আদালতে বিচারাধীন মামলা শীঘ্র নিস্পত্তি করে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া না পর্যন্ত জনমনে এ ব্যাপারে আস্থা আসবে না।

চীনের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাস এর রোগী সনাক্ত করা হয় ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯। এরকম একটা বিপদজনক অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে Global Pandemic ঘোষণার মাধ্যমে সারাবিশ্বকে Medical Emergency Alert জারি করার মাধ্যমে জনগনকে রক্ষায় দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানকে উপদেশ দেন এবং বিশেষ কোনো দেশের প্রতি দোষারোপ না করে সকলে মিলে এই মহামারি প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান । চীন হতে এই ভাইরাস এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ নিয়ে সারা বিশ্বে গত ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখের উপর মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, মোট আক্রান্ত ২ কোটি ৮৬ লাখ। এখনও প্রতিদিন হাজার হাজার আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন এবং অনেকেই মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। এই বিপদজনক অবস্থার মধ্যে আমেরিকা নিজেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হতে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়। তাতে ট্রাম্প প্রশাসনের একলা চলা নীতি আবারও প্রমানিত হলো। 

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোন দেশই প্রথমদিকে এই রোগের ব্যাপারে ততটা আগ্রহ অথবা বিপদের আশংকা করেনি। বাংলাদেশে মার্চের ৮ তারিখ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হয়। আমাদের দেশের এক শ্রেণির লোক এটাকে কমিউনিস্টদের উপর গজব হিসেবে প্রচার চালানোর মাধ্যমে আত্মতৃপ্তির প্রয়াস পেয়েছিল। কিন্ত শীঘ্রই এদেরকে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পন করতে দেখা যায়। গত ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে সরকারি হিসাব মতে মোট আক্রান্ত ৩ লাখ ৩৬ হাজার এবং মারা গেছেন ৪৭০২ জন। বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমিন্যান্স এর প্রধান ঢাকা শহরের কয়েকটি কবরস্থান পরিদর্শন করেছেন। তাঁকে কবস্থানের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানিয়েছেন, করোনায় মৃত্যুর যে সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে তার অন্তত চারগুন বেশি মারা যাচ্ছে। পরীক্ষাহীন অনেকেই মারা যাচ্ছে কিংবা এমনও হচ্ছে, মৃত্যুর পর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে করোনার নমুনা প্রদান এবং ফল পেতে যে ভোগান্তি হয় তাতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, কারো সর্দি, জ্বর, কাশি দেখা দিলে বাড়িতেই সাধারণ সর্দি-জ্বরের ওষুধ গ্রহণ করছেন। যখন সমস্যা তীব্র হচ্ছে তখন হাসপাতালের স্মরণাপন্ন হয়েও ফল পাচ্ছেন না। সামাজিক সমালোচনা এবং আতংকের জন্য অনেকেই তা প্রকাশ করছে না, ফলে পরিনতি হচ্ছে দুঃখজনক।

সংক্রমণের ধারা বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, একজন রোগী সনাক্ত করতে গিয়ে যদি ১০ থেকে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় তবে পরীক্ষা পর্যাপ্ত হয়েছে বলে ধরা হয়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছনে, এমন কী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া সবার নিচে। দি লেনসেট জার্নাল তার ২১ আগস্ট ২০২০ সালে প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরীক্ষা নিয়ে সমালোচনা করেছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সরকার যে পরীক্ষা ফি ধার্য করেছে তা জনগোষ্টিকে পরীক্ষায় নিরুৎসাহিত করবে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা। জুন মাসে সরকার কোভিড পরীক্ষার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২০০ টাকা ফি ধার্য করেছিল, আর বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা ফি দিতে হতো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতি চার জনে একজন দরিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা প্রায় এক হাজারে ০.৮ জনে নেমে এসেছিল এবং আগষ্টে হাজারে ০.৬ জনে নেমে এসেছিল। অবশ্য সমালোচনার মুখে আগষ্টের ২০ তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় ফি পূনঃনির্ধারণের ঘোষণা দেন। এতে বলা হয় ফি ২০০ টাকার পরিবর্তে ১০০ এবং বাড়ি থেকে সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকা দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি সংখ্যার এই দেশে প্রতিদিন ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার করোনা পরীক্ষা করতে সক্ষম। বাংলাদেশের আইইডিসিয়ারের সাবেক পরিচালক ফি নির্ধারণ করার  সমালোচনা করেছেন। 

কোভিড-১৯ রোধে ৯ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকার মাস্ক ও ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাব। কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের কেনাকাটায় উপেক্ষা করা হয়েছে ক্রয়প্রক্রিয়ার নির্ধারিত নিয়মকানুন। নিম্নমানের মাস্ক ও থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দাম দেখানো হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি ছাড়াই চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্য আনা হয়। সরবরাহকৃত পণ্য টেকনিক্যাল কমিটি অনুমোদনের আগেই দু’দফায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই পুরো টাকা লোপাটের সঙ্গে সিম করপোরেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জড়িত। সম্প্রতি অনুসন্ধান চালিয়ে এসব পণ্য শনাক্ত এবং অনিয়মের তথ্য পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ২৭ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থানায় এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের করে  র‌্যাব-১। মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে এবং তাদের পালাতক দেখানো হয়েছে। তারা সবাই সিম করপোরেশনের ম্যানেজিং পার্টনার। এছাড়া এজাহারে অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তাকে বদলিও করা হয়েছে। এটাও এরই একটি অংশ। এ সংক্রান্ত কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে এটা আইনগত পদক্ষেপ। এটা ভালো উদ্যোগ।

মানবিক মূল্যবোধ এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন সন্তান অসুস্থ পিতা মাতাকে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে, এমন কী কেউ মারা গেলে তাকে কবর দেওয়ার জন্য কোনো স্বজন আসছেন না; কোনো হিতৈষী সংগঠন মরদেহ কবর দিচ্ছেন। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ অবস্থায় মাঝে মাঝে ভাল পদক্ষেপ নিচ্ছে। যে শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো মানুষ তৈরি করা, আজ সে শিক্ষা ব্যবসায়িক মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। মূল্যবোধ আজ শুধু মৃত পুঁথিতে বন্দি। চিকিৎসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট ও টাকা উপার্জন চলছে। তাতে বিদেশেও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে । তার প্রমাণ ইতালি বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠিয়েছিল । এ ছাড়া করোনা পরীক্ষা করতে নিয়ে যাবার নাম করে ধর্ষণ করা হচ্ছে। করোনা আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে। ভালোবাসা-আবেগ-দায়িত্ববোধ-সৌজন্যবোধ, কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে পারি না। চিৎকার করে কাঁদতেও ভুলিয়ে দিয়েছে। অবশেষে মানুষেরই জয় হবে-ততদিনে ক্ষয়ের পরিমান হবে পাহাড় সমান। শুধুমাত্র খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যের সুরাহা করলে চলবে না। সত্যিকারের শিক্ষার প্রয়োজন। সেই সাহসিকতার শিক্ষা যার সাহায্যে একজনের মেরুদ- শক্ত হবে। মাথা নিচু করে ভিক্ষা নয়, মাথা উঁচু করে নিজের অধিকার বুঝে নেবে সে। মূল্যবোধের শিক্ষা, যার সাহায্যে বটগাছের মতো দৃঢ় চরিত্র তৈরি হবে। দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের শিক্ষা, যার ফলে চরিত্রের মধ্যে সত্যই এক জাতীয়তাবাদ ফুটে উঠবে। 

ধনতন্ত্রে সব কিছুই পণ্য ব্যবহার মূল্য রয়েছে, যা মুনাফাযোগ্য। মানবিক মূলবোধ গুঁড়িয়ে দিয়েই ধনতন্ত্রের জয়যাত্রা। সেই অভিযান এখনও চলছে। একদিকে প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট সম্পদ লুট, অন্যদিকে সবোর্চ্চ মুনাফাকরণের লাগাতার প্রয়াস হলো ধনতন্ত্রের চালিকাশক্তি। মহামারীর প্রতিষেধক আবিস্কার নিয়ে বিশ্বজুড়েই চর্চা চলছে। বহু প্রতিষ্ঠানেই গবেষণা চলছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির। মহামারীকে পরাস্ত করতে তা অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অক্সফোর্ড, বেজিং, আমেরিকায় এই গবেষণা অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। চেষ্টা চলছে ভারতেও। ল্যাবরেটরিতে প্রাণপাত করছেন বিজ্ঞানীরা। এই সময়েই ল্যাবরেটরির বাইরে চলছে মুনাফার খেলা। আগাম বাণিজ্যের কলা-কৌশল, একচেটিয়ার দখলদারি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভ্যাক্সিন অ্যালায়েন্স বিশ্ব ব্যাপী ওষুধ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই, তা সফল হবার সম্ভাবনা কম। ‘কোভ্যাক্স’ নাম দিয়ে এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এখানে ৭৮টি দেশযোগ দিয়েছে। কিন্তু ওষুধ সংস্থাগুলোর সঙ্গে দেশগুলোকে পৃথক পৃথক চুক্তিতে যেতে হবে। এর মধ্যে ঝুঁকিও থাকবে। কোনো কোনো ওষুধ শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় টিকবে না। শুরু হয়ে যাবে বুকিং এর দরাদরি। চড়তে থাকবে ওষুধের দাম। আস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না, বায়োটেক আপাতত দৌঁড়ে এগিয়ে রয়েছে। তাদের সকলেরই প্রথম কয়েক দফার উৎপাদন চলে যাবে ধনী দেশগুলোর হাতে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন আয়ের দেশগুলো। অন্তত ৯০ টি দেশে এই ওষুধ কবে পৌঁছাবে, কী দামে পৌঁছবে তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সমালোচকদের দাবি যে এই বিশ্বায়ন মূলত পুঁজির বিশ্বায়ন। একচেটিয়া পুঁজির অবাধ চলাচল নির্বিঘœ করার জন্যই ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্যে’র ভিত্তিতে পুঁজিবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলো এই অর্থনৈতিক দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করেছিল। ফলে বিশ্বায়নের নব্য উদারতাবাদ তৃতীয় বিশ্বসহ অনেক দেশেই সংকট ত্বরান্বিত করেছিল। ফলে সংকটের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ পন্থার জমিন শক্ত হয়েছে এবং এখন বিশ্ব জনতুষ্টিমূলকতার নামে এক ধরনের নব্য ফ্যাসিবাদ প্রত্যক্ষ করছে। অথচ বিশ্বায়নের একটি অন্য ইতিবাচক তাৎপর্য থাকতে পারত যদি এটা পুঁজির না হয়ে মানবিক বিশ্বায়ন হতো।

সেরকমই একটি মানবিক বিশ্বায়নের উদাহরণ সৃষ্টি করছে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। তারা দেশে দেশে নিঃস্বার্থভাবে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়ে এক অনন্যসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি সারা বিশ্ব যখন নভেল করোনাভাইরাস নামে প্রাণঘাতী সংক্রমণের ছোবলে বিপর্যস্ত, তখনো তারা কোথাও ওষুধ পাঠিয়ে আবার কোথাও চিকিৎসক পাঠিয়ে তাদের এ মানবিক ধারা অব্যাহত রেখেছে। আর সেটা সম্ভব হচ্ছে এ কারণেই যে, তারা একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ৫২ জনের শক্তিশালী চিকিৎসক দল ইতালিতে পাঠানো হয়েছে। কিউবা অবশ্য আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী দেশ ব্রিটেনের দিকেও। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় যাত্রীবাহী জাহাজ এমএস ব্রেইমারকে যখন কোনো দেশ তাদের তটে ভিড়তে দিচ্ছিল না, তখন কিউবাই তাদের বন্দর খুলে দেয়। জাহাজটিতে এক হাজার যাত্রী ছিল। এসব যাত্রীর মধ্যে যারা সুস্থতা লাভ করেছে, তাদেরকে নিজে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাটরিনা নামের একটি সাইক্লোন আঘাত হানে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক সহায়তার আবেদন জানায়। তখন কিউবান সরকার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ১ হাজার ৬০০ চিকিৎসক ও ৩৬ টন চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তখনকার বুশ প্রশাসন এ প্রস্তাবের কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ১ হাজার ৮০০ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এক লাখের বেশি কিউবান চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ৯৭টি দেশে কাজ করেছেন।

স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং নতুন চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিউবার অসাধারণ সফলতা আসতে কয়েক দশক সময় লেগেছে। এই কাজে কিউবা সোভিয়েত রাশিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু কেমন করে কিউবার মতো তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও ছোট একটি দেশ এই অঙ্গীকার পূরণ করার সামর্থ্য অর্জন করল, তা অনুধাবন করতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে কেমন করে কিউবা তার নিজের চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে মানবসম্পদ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও সামাজিক দক্ষতা তৈরি করেছে। ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পরপরই কিউবা তার চিকিৎসাসেবা প্রদানের ধরন-ধারণে পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাসেবার ওপর জোর দিতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে সমাজজীবনের সঙ্গে পারিবারিক চিকিৎসাসেবার সার্বিক সমন্বয়কে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে চিকিৎসা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণেও পরিবর্তন আনা হয়। প্রথম শ্রেণির চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাক্সক্ষার কোনো কমতি ছিল না কিউবার। কিন্তু কিউবাকে প্রায়ই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে, ফলে কিউবাকে এই নতুন স্বাস্থ্যসেবার নকশা তৈরি ও বাস্তবায়নের কাজটি করতে হয়েছে একটি উন্নয়নশীল দেশের সীমিত গ-ির মধ্যে থেকেই। এ কারণে কিউবাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, সেই সঙ্গে সর্বজনীন চিকিৎসার প্রতি তার দার্শনিক দায়বদ্ধতায়ও অবিচল থাকতে হয়েছে। নিজের দেশের সকল মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম এ রকম একটি চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে বলেই কিউবা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোকে এ বিষয়ে যাথাযথ সাহায্য ও প্রশিক্ষণ প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করেছে। 

নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে সকল পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলে রাষ্ট্র তাঁর প্রাণ নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কিছুটা হলেও সফল হতে পারে। যেমনÑসঠিকভাবে সরকারি ওষুধ সরবরাহ এবং বন্টন নিশ্চিত করা; ডাক্তারদের চাকরির বয়স এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রমোশনের ব্যবস্থা করা; প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে অন্ততঃ একজন পাবলিক রিলেসন্স অফিসার নিয়োগ; একই চিকিৎসক দিয়ে যাবতীয় জটিল রোগের চিকিৎসার সনাতন পদ্ধতি পরিহার; জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে অবস্থানরত ডাক্তারদের শহরের তুলনায় বেশী সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা; প্রতিটি স্বাস্থ্য নিরাময় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য কর্মচারী এবং মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা করা; ১৩০০ কমিউনিটি ক্লিনিক যা দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হয়েছে (প্রতিটি ৬০০০ হাজার লোকের সেবা প্রদানের জন্য তৈরি)  এগুলির মান উন্নয়ন অতীব জরুরি। দেশের জনগণের বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা; প্রতিটি চিকিৎসককে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য সুবিধা প্রদান; প্রতিটি হাসপাতাল ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে যেখানে সিভিল সার্জন ও হাসপাতালের পরিচালক মনিটরিং করতে পারেন; চিকিৎসক এবং হাসপাতালের পরিচালকদের এই পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে মানসিকভাবে গ্রহণ করা। 

চিকিৎসক সেবা দিয়ে সম্মানী নেবেন ঠিক আছে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষার কারণে যেন অসহায় সেবা গ্রহিতাকে সর্বশান্ত না হতে হয় । বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেনো তাদের অঙ্গনে প্র্যাকটিসরত চিকিৎসকগণকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনোরূপ টার্গেট বেঁধে না দেন।

পরিশেষে আবারও বলবো স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। জনগণের ট্যাক্স-ভ্যাটের অর্থে স্বাস্থ্য বিভাগ পরিচালিত হয়, তাই সরকারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে রোগীরা সেবা নিতে আসেন মূলত বিনামূল্যে মান সম্পন্ন চিকিৎসা পাবার আশায়। গরিব রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে সরকারি হাসপাতাল; তাই যুগোপযোগী পরিকল্পনাগ্রহণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা খাতের আমূল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবী।

আমরা আশা করতে চাই এভাবেই বাংলাদেশে সকল অনিয়ম, দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর হয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাবে।