Cinque Terre

সেলিম আউয়াল

০৬ ডিসেম্বর , ২০২০


গল্পকার


কবি তুষার কর : আলাপচারিতায় একদিন

তখন তিনি সদ্য কৈশোর পেরুনো যুবক। দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে, পেছনে পুড়ছে স্বদেশ, চলছে মুক্তির সংগ্রাম-গণহত্যা। এই অবস্থায় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের তাগিদেই একুশ বছরের যুবক তুষার কর কাজ করতে শুরু করলেন ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ নামের পত্রিকায়। পত্রিকাটি সম্পাদক  বিয়ানীবাজারের আবদুল মতিন চৌধুরী। তুষার কর দেশে থাকতেই ছড়া লেখতেন, লেখালেখি করতেন। সেই লেখালেখিকেই সম্বল করে নেমে পড়লেন সাংবাদিকতায়। মতিন চৌধুরীর বাংলাদেশ পত্রিকার রণাঙ্গণ প্রতিনিধি হয়ে লেখতে শুরু করলেন-‘রণাঙ্গন থেকে বলছি’।

তুষার করের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার করের গ্রাম। জন্ম ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ, বাবা রবীন্দ্রনাথ কর, মাতা শান্তিলতা কর। ছয় বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে তুষার কর সবার বড়। বাবার চাকরি জাফলং চা বাগানে। চাকরির সুবাদে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় জাফলংয়ের রাধানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের রাজা জি.সি. হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। মদনমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন সরকারি মুরারি চাঁদ কলেজে। এর মাঝে কবিতা লেখা, আড্ডা, যুগভেরীর টেবিলে কাজ করা। এইসব কারণে ও নানা সংকটে ডিগ্রি পরীক্ষার প্রস্তুতি ঠিকমতো নেওয়া হয়নি, ফলে যা হবার তাই হয়। সোনালী ব্যাংকে চাকরি নেন ছিয়াত্তরে, পোস্টিং হয় কুষ্টিয়াতে। এক বছর কাজ করে ফিরে আসেন আবার নিজের শহর সিলেটে। তারপর চাকরি জীবন শেষ করে সোনালী ব্যাংকের কালিঘাট ব্রাঞ্চ থেকে অবসর নেন। তুষার করের স্ত্রী চিত্রলেখা কর এবং একমাত্র কন্যা প্রজ্ঞাপারমিতা কর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তুষার করের এ পর্যন্ত চারটে বই বেরিয়েছে। প্রথম বই কবিতার, ‘আমার কিছু কথা আছে’। দ্বিতীয় বই ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলো’, তৃতীয় ‘আমরা চলবো আমাদের মতো’ এবং চতূর্থ বই ‘মাঠ হারিয়ে যায়’। তার প্রথম লেখা বের হয় দৈনিক সংবাদের ‘খেলাঘর’ পাতায়, সেটা ১৯৬৫ সনের কথা। সভাপতি-সেক্রেটারি, এইসব পদপদবী নেননি, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন সুরমা খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী, সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা, রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ-এর সঙ্গে। সমস্বরের হয়ে নেমেছেন উনসত্তরে নেমেছেন রাজপথে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। 

একাত্তর সালের ২৭ মার্চ সিলেট শহর থেকে চলে যান বাবার কর্মস্থল জাফলং চা বাগানে। কয়েকদিন জাফলং থাকার পর ডাউকি হয়ে চলে যান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। সেখানে দেখা হয় সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, বাবরুল হোসেন বাবুলের সঙ্গে। তারপর শিলং থেকে চলে যান শিলচর। শিলচর তার মামার বাড়ি। বাংলাভাষী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে দেখা হয়Ñঅনেকে পরিচিত, অনেকের নাম শুনেছেন। শিলচরে দেখা হয় বিয়ানীবাজারের আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি একটি পত্রিকা বের করতেন ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’। সেই পত্রিকায় যোগ দেন তুষার কর।

শিলচরের দিনগুলোতে তুষার কর আড্ডা দিতেন শিলচরের সাপ্তাহিক অরুণোদয় পত্রিকার অফিসে। অফিসটায় সাংবাদিক, শিল্পী সাহিত্যিকদের আড্ডা হতো, মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। সেখানে সবচেয়ে বড়ো একটি বিষয় ছিল সবাই মিলে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী ও বিবিসি’র সংবাদ শোনা। সাপ্তাহিক বাংলাদেশে কাজ করতে করতে এবং অরুণোদয়ের আড্ডায় তিনি অনুপ্রাণিত হলেন, নিজে একটি পত্রিকা বের করে ফেলবেন। কিন্তু নিজেরই অস্তিত্ব যেখানে শরণার্থী, সেখানে পত্রিকা বের করবেন কিভাবে। শিলচরের এক প্রেস মালিক বাকিতে প্রথম সংখ্যা ছেপে দিলেন। শর্ত থাকে পত্রিকা বিক্রি করে মুদ্রণের খরচ ফেরত দেবেন। নিজেই সম্পাদক, নিজেই হকার, নিজেই বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপক।

জুলাই ১৯৭১ থেকে শুরু হয় তুষার করের সাপ্তাহিক দুর্জয় বাংলার পথচলা। কবি দিলওয়ারের দুর্জয় বাংলা কবিতা দিয়ে দুর্জয় বাংলার প্রথম সংখ্যা বের হয়। ট্যাবলয়েড সাইজের চার পৃষ্ঠার পত্রিকা। কখনো দুশো, কখনো তিনশ কপি ছাপা হতো। ভারত থেকে মুক্তাঞ্চলে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুষার কর তুলে দিতেন দুর্জয় বাংলা। ছোটভাই টুটুল করকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন। দুইভাই মিলে পত্রিকা বেচতেন-শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, মুক্তিকামী মানুষের কাছে। সে এক আলাদা অনুভূতি। পত্রিকার দাম চার আনা। কেউ কেউ এক টাকা-পাঁচ টাকাও দিয়ে দিত, সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার একটি অংশ হিসেবে দান। পত্রিকা বেচে টাকা তুলে দিতেন প্রেসের মালিকের হাতে। তবে সবসময় ছাপার খরচাপাতি সবটুকুন তোলা যেতো না।

দুর্জয় বাংলা সুরমা প্রকাশনীর পক্ষ থেকে সিলেটের মুক্তাঞ্চল থেকে বের করা হতো। বিদেশে যোগাযোগ ঠিকানা উল্লেখ করে লেখা থাকত ‘বিদেশস্থ যোগাযোগের ঠিকানা-রফিকুর রহমান, পুরাতন স্টেশন রোড, করিমগঞ্জ’। রফিকুর রহমান হচ্ছেন-লেখক-সাংবাদিক রফিকুর রহমান লজু। তিনি করিমগঞ্জের হিন্দি স্কুলে কম্যুনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে একটি ক্যাম্প পরিচালনা করতেন। দুর্জয় বাংলা বের করতে তাকে সবচেয়ে সহযোগিতা করেছেন অরুণোদয় পত্রিকার সম্পাদক কবি কালিকুসুম চৌধুরী, সাংবাদিক কবি অতীন দাস।  

তুষার করের সঙ্গে কথা হচ্ছিল (৩১ ডিসেম্বর ২০১৮) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিলেট অঞ্চলের সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে। বললেন, তখন কলকাতা থেকে মাইকেল দত্ত নাম নিয়ে মৌলভীবাজারের বিজয় কুমার দত্ত সাপ্তাহিক বাংলা বের করতেন। করিমগঞ্জ থেকে শাহ মুদাব্বির আলী আর আবদুল বাছিত বের করতেন সোনার বাংলা। আর তো ছিলো আবদুল মতিন চৌধুরীর সাপ্তাহিক বাংলাদেশ। এএইচ সাদত খান ও আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলামের মুক্তবাংলা ছাড়া করিমগঞ্জ অথবা শিলচর থেকে সিলেটি কারো সম্পাদনায় বের হওয়া কোন পত্রিকা তুষার কর দেখেননি। তবে তার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো সিলেটের মোস্তফা আল্লামা সম্পাদিত জন্মভূমি পত্রিকা। এটি কলকাতা থেকে বের হতো। ট্যাবলয়েড সাইজে ডাবল কালারে ছাপা হতো এবং পৃষ্ঠাও থাকত অনেকগুলো। সাপ্তাহিক হিসেবে নিয়মিত বের হতো।

কবিতার মানুষ তুষার কর সব সময় কবিতা দিয়ে পত্রিকার সংবাদের হেডিং দেওয়ার চেষ্টা করতেন। খুব বেশি ব্যবহার করতেন কবিতার চরণ। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা ছাপতেন। তার পত্রিকার শেষ সংখ্যা বের হয় ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলায় তখন উড়ছে বিজয়ের পতাকা পত পত করে। তিনি হেডিং দিলেন সুকান্তের কবিতায়-‘মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস/মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।’ এছাড়া সেই সংখ্যায় ছিলো ‘বাংলার দাবি, বাঙালির দাবি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।’ সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ে কবি অতীন দাস, আলোকচিত্রী নিশীথ পুরকায়স্থকে নিয়ে পথ ধরলেন স্বাধীন বাংলার পথে। বগলে দুর্জয় বাংলার বান্ডিল। জকিগঞ্জ হয়ে সিলেটে ঢুকেন।  

তুষার কর ভারত থেকে ট্র্যাংক ভরে নিয়ে এসেছিলেন তার পত্রিকা দুর্জয় বাংলা ছাড়াও সাপ্তাহিক বাংলা, সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, সাপ্তাহিক জন্মভূমি, মুক্তিযুদ্ধ, কম্পাস, দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর, উল্টোরথ পত্রিকার অনেকগুলো কপি। হাসান হাফিজুর রহমান সিলেট আসলে পত্রিকাগুলো দেখে বললেন, ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ এই পত্রিকাগুলো তোমার কাছে থাকা ঠিক না। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালায় দিয়ে দাও। তুষার কর তাঁর কাছে থাকা পত্রিকার সবগুলো কপি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে।

আজ তুষার কর সত্তরের ঘরে। শুভ জন্মদিন কবি।