Cinque Terre

ফাহমিদা ইয়াসমিন

১৭ জানুয়ারী , ২০২১


প্রাবন্ধিক

প্রবাসী লেখক


সমাজ সংস্কার ও নারী মুক্তি আন্দোলন

নারী শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় সেনসেটিভ একটি শব্দ। যে শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুরুষের সুখ, সন্তান উৎপাদনের উৎসস্থল। এই নারীরা পৃথিবীর শুরু থেকেই আজ অবধি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যাই করুক না কেনো তা যেন শুধু গুটিকয়েক কবি, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিকের কলমের ডগায় সীমাবন্ধ। 

নারীরা যে পুরুষের মতো সমাজের একটা বিরাট অংশ তা ধর্মগ্রন্থগুলো স্বীকার করলেও তথাকথিত মোল্লা, পুরোহিত ও সাধু বাবাদের স্বার্থের কারণে অপব্যাখ্যা হয়ে থাকে। এজন্য একটা সময় নারীরা হারিয়ে ফেলে তাদের আত্মগৌরব, তাদের কাজের চাঞ্চল্য। আপনি এই আধুনিক যুগেও এসে নারীদের পরিবার গঠনের ভ‚মিকা দেখলে বুঝতে পারবেন, তারাও কতোটা পুরুষের মতো কাজে পটু। এখনও বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় নারীদের উপার্জনে পরিবার চলে। স্বামীরা আড্ডায় মাতোয়ারা। তবুও নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পায় না। অফিস কক্ষে বসে লালসার স্বীকার, রাস্তাঘাটে রাজনৈতিক বকাটের লালসার স্বীকার হয়। রাষ্ট্রীয় আইন অবশ্য নারী পুরুষের সমমর্যাদার প্রতি বিশ্বাস এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত নানা কর্মকাণ্ড করে থাকে। কিন্তু সেই আইন কখরও কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারে পুরুষের কাছে মর্যাদা পায় না। এ কারণেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীদের নিজেদের অধিকার সুরক্ষার জন্য আন্দোলনে নামতে হয়েছে। ঘোষণা করতে হয়েছে আমরণ অনশনের। এমনকি নারীদের নিজেদের স্তনকে কাপড়ে আবৃত রাখতেও একটা সময় সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমেই সে সব পেরিয়ে এসেছে নারীরা আজকে এই সভ্য সমাজে। কিন্তু এই সভ্য সমাজও নারীদের ত্যাগের, সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে খুব বেশি ভ‚মিকা পালনে ব্যর্থ। নারী আন্দোলনের লক্ষ্য ও কার্যক্রম দেশ, শ্রেণি, জাতি এবং সংস্কৃতি ভেদে ভিন্নতর। ভারত উপমহাদেশে বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নারী আন্দোলন শুরু এবং পরিচালিত হয় সংস্কারবাদী আন্দোলন এবং আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে। সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রগতিশীল নেতা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), ব্রিটিশ পণ্ডিত ডিরোজিও, ব্রাহ্মসমাজ নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে তাঁরা বৈপ্লবিক পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং মানুষের মনমানসে নারী পুরুষের সমতা বিষয়ে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করেন। নারী আন্দোলনের সূচনা পুরুষের মাধ্যমে হলেও পরবর্তী সময়ে নারীরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হন। বিশ শতকের শেষদিকে এসে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে এবং তা সম্ভব হয়েছে বৃহত্তর নারী আন্দোলনের প্রভাবে।

সব চেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, নারীদের জন্য আজ অবধি যত আন্দোলন হয়েছে তার সবই ছিল পুরুষের দ্বারা। ধীরে ধীরে আন্দোলনকে বেগবান করতে নারীদের অংশগ্রহণ শুরু হয়। সময় পরিক্রমায় এখন নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। জানাতে শুরু করেছে নিজেদের শক্ত অবস্থান। একটি বাক্যে তিতা কথাও বলতে হয়, যে নারীরা নারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, বিভিন্ন সময় আবার পত্রিকার শিরোনামে দেখা যায় কাজের বুয়া বা কর্মচারীদের তাদের হাতেই নির্যাতনের ঘটনা। যা খুবই দুঃখজনক। আলোচনার বিষয় আসলে তা নয়। 

নারী আন্দোলনের মুক্তি ও আত্মসচেতনতার যুগ উনিশ শতক। তখনই নারী আন্দোলন শুরু। শুরুর দিকে একক লড়াই করতে হয়েছে রাজা রামমোহন রায়কে। তারই একক প্রচেষ্টায় সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে এবং সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এই সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় তাঁকে। সেই সতীদাহ প্রথা বা নারীদের প্রতি সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়ন বন্ধের জন্য ১৮১৫ সালে রামমোহন রায় আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় প্রগতিশীল ব্রাহ্মদের সহযোগিতায় সতীদাহ বন্ধের জন্য ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সতীদাহ বিষয়ে কয়েকটি বই লেখেন, যেমন সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক এবং নিবর্তকের সংবাদ: প্রথম প্রস্তাব (১৮১৮) ও দ্বিতীয় প্রস্তাব (১৮১৯) এবং সহমরণ (১৮২৯)। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৮১৫ এবং ১৮১৭ সালে সহমরণ বিষয়ে শিথিলতা আরোপ করা হয়। ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ বিলোপে আইন প্রণয়ন করেন। রামমোহন রায় বর্ণবৈষম্য, বহুবিবাহ এবং বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তাঁর মতে নারীর প্রতি নিপীড়ন বিদ্যমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আচরণ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বাঙালি নারীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পশ্চিমা সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিক গ্রহণ করার প্রতি জোর দেন।

সতীদাহ প্রথা বন্ধের পর ঔপনিবেশিক বাংলার সংস্কারকগণ বিধবা পুনর্বিবাহের প্রতি গুরুত্বব দেন। সতীদাহ আইন প্রণয়নের পর নারীরা ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেলেও বিধবা নারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে। বয়স্ক কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ এবং স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা বিবাহ অনুমোদিত না থাকার কারণে বিধবাদের কঠোর জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতো। পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত খাবার, কঠোর গৃহশ্রম, পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য্যকে নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি প্রাত্যহিক জীবনাচরণের কারণে কখনোবা নারীরা বাড়ি থেকে পালিয়ে পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত হতো। মুসলিম সমাজে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ না হলেও সমাজ সংস্কৃতির নিয়মে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা পুনর্বিবাহ করতে পারত না।

বিধবা পুনর্বিবাহ বিষয়ে প্রথম সমর্থন দেয় ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যগণ। ১৮৩৩-১৮৩৪ সালে জ্ঞানান্বেষণ এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় বিধবা বিবাহের সমর্থনে মতামত প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রকাশিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মাধ্যমে তিনি এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালান। তাঁর রচিত বিধবা বিবাহ উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫) বইয়ে তিনি বিধবা বিবাহের সমর্থনে শাস্ত্রের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তিনি ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর আইনসভায় স্মারকলিপি প্রদান করেন। তাঁর প্রচারণা ও আন্দোলন জনসমাজে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে ১৮৫৬ সালের ১৯ জুলাই বিধবা পুনর্বিবাহ আইন প্রণীত হয়। আইন প্রণয়নের পর প্রথমদিকে ব্রাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল সদস্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিধবা পুনর্বিবাহের ঘটনা ঘটে এবং পরিসংখানে দেখা যায়, ১৮৫৬-১৯১১ সাল পর্যন্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু নারীদের মধ্যে মাত্র ৫০০ বিধবা বিবাহ হয়। অধিকাংশ নারী আইনি সুবিধার বাইরে ছিল। তা সত্তে¡ও বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের কারণে হিন্দু সমাজে বিধবা মেয়েদের প্রতি সমাজের নিষ্ঠুর আচরণের বিষয় আলোচনায় পরিণত হয়। অবশ্য সমাজ সংস্কারের ওই নতুন পদক্ষেপ অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়।