Cinque Terre

হুমায়ুন কবির জুয়েল

১৮ জানুয়ারী , ২০২১


সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব


তোমায় স্যালুট হে বীর মুক্তিযোদ্ধা

নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। চা-বাগানের অপার সৌন্দর্য আর সুরমা নদীর কলকল জলতরঙ্গে জন্ম তাঁর। লেখক,নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী, আলোকচিত্রী, তথ্যচিত্র নির্মাতা এমন নানা মাত্রিক আলোয় আলোকিত আমাদের কালের এক অন্যন্য মানুষ তিনি। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের সাবেক প্রধান পরিচালক নিজামউদ্দিল লস্কর, দীর্ঘদিন জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিলেট ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। 

মাত্র ১২ বছর বয়সে মঞ্চনাটকে পদার্পণ। অভিনয়ের হাতেখড়ি শ্রী কল্যাণ দাস, মোমিনউদ্দিন ভূঁইয়া সুরুজ ও শ্রী শিবু ভট্টাচার্যের হাত ধরে। একক অভিনীত নাটক ‘চেয়ার'সহ অসংখ্য মঞ্চনাটকে তিনি অভিনয় করেছেন।। স্বাধীনতা পূর্ব-উত্তর সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গণ, বিশেষ করে নাট্যাঙ্গণে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুদ্ধের ময়দান কিংবা নাটকের মঞ্চ-সর্বক্ষেত্রেই তাঁর বলিষ্ট নেতৃত্ব দৃশ্যমান। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে নিজামউদ্দিন লস্কর যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র তখনই বি.এ ক্লাসের ছাত্রদের একাধিক নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেতার নাটকের শিল্পী। অভিনয় মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন-চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকে।

২৫ মার্চ, ১৯৭১। রাত ১২.৩০ মিনিট। সিলেটের একটি গ্রামের মঞ্চে অভিনয় করছিলেন নিজামউদ্দিন লস্কর। হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ‘অপারেশন সার্চ লাইট'র খবর পেয়ে, সেই মঞ্চেই জনতার সামনে শপথ নেন দেশকে শক্র মুক্ত করার। ঝাঁপিয়ে পড়েন মহান মুক্তিযুদ্ধে। যতটুকু জানা যায়, পরাধীন বাংলাদেশে সেটাই সর্বশেষ মঞ্চনাটক।

১৬ আগস্ট, ১৯৭১। ৫ নং সেক্টরের ২নং বালাট সাব সেক্টরের অধীন সুনামগঞ্জের আহসানমারা ফেরি ধ্বংস করে, সিলেটের দিকে এগুনোর সময় জয়কলস সেতুর কাছাকাছি এলাকায়, পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে গুলিবিদ্ধ হন কমান্ডার নিজামউদ্দিন লস্কর। কখনো নৌকা, কখনো গরুরগাড়ি, কখনো বা খাটিয়ায় শুইয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শিলং মিলিটারি হাসপাতালে।

স্বাধীন দেশে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের চিহ্ন আজীবন বহন করলেও প্রথম দুই বছর তাঁকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হয়। তবে, থেমে থাকেননি কখনোই। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা সকল সময়ই মুক্তিযোদ্ধা। জীবনভর তাঁকে লড়াই করে যেতে হয়েছে । ১৯৭১ থেকে ২০২১, বারবার মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন তিনি। জীবন এবং শিল্পের সংগ্রাম ছিলো প্রতিনিয়ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৪১ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি,১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় সিলেটের মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘রক্তপলাশ'। স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভবত: এটাই প্রথম মঞ্চনাটক। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার রচনা ও নির্দেশনায়, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের উদ্যোগে একটি নাটক মঞ্চে আসে। সহযোগিতায় ছিলো, সিলেট পৌরসভা। যেখানে অভিনয় করেন, সিলেটের প্রবীণ শিল্পীরা। বেশ কয়েকজন নবীন শিল্পীও ছিলেন। সিলেট ছাড়াও মৌলভীবাজার এবং ঢাকায় উক্ত নাটকের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ‘পাগলাগারদ' নামক এই নাটকের মাধ্যমেই প্রবীণ নাট্যকর্মী অনেকের সাথে আমাদের সংযোগ ঘটে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেট নবীন-প্রবীণ নাট্যকর্মীর যৌথ প্রয়াসে ‘ঝুঁকি' নামে একটি নাটক মঞ্চে নিয়ে আসে। যার রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন, নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। 

‘পাগলাগারদ’-এ আলোক পরিকল্পক ও ‘ঝুঁকি' নাটকে সহযোগী নির্দেশক হিসেবে তাঁর সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়। শৈশব থেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যজন নিজামউদ্দিন লস্কর পরিচিতজন হলেও মূলত:পাগলাগারদ নাটকে কাজ করার সুবাদে ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে পেশাগত কারণে, আমরা দুইজন দক্ষিণ বাংলার পটুয়াখালী জেলায়, তেতুলিয়া নদীর মাঝখানে চরকাজলে প্রায় দুই বছর একসাথে থেকেছি। এখান থেকেই পরবর্তী এক যুগের পারিবারিক সম্পর্ক। পারস্পারিক শ্রদ্ধা-স্নেহ-নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরী হয় আমাদের অজান্তেই। যা-আমার জন্য বিশেষ কিছু। ময়নাভাই প্রায় সকল বিষয়ই নিয়েই আমার সাথে আলাপ করে মতামত চাইতেন। প্রায়শ: সেই মতামতের প্রতিফলনও দেখতে পেতাম।

চরকাজলে ময়না ভাইকে আমি আরো গভীর ভাবে জানতে পারি। ঘন্টার পর ঘন্টা হারানো দিনের গান, গজল, শায়ের, উর্দু কবিতা পরিবেশন করে আমাদের জমিয়ে রাখতেন। পদ্মা-মেঘনা-পায়রা-তেতুলিয়ার মতো বিরাট বিরাট নদী দেখে ফিরে যেতেন তাঁর যুদ্ধদিনের হাওরাঞ্চলে। কখনো কখনো আপ্লুত হতেন, কখনো বা বিষন্ন! যুদ্ধ এবং নাটকের স্মৃতিচারণ করতে করতে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। উনি আর আমি মিলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ‘এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার' করতে চেয়েছিলাম। সেটা আজও হয়ে উঠেনি! জানি না আর কোনদিন হবে কি না! যেমন হয়ে উঠে হয়ে উঠেনি আমি আর রাজীব মিলে আলো-ছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন!

নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। ২০১৮ সালে দৈনিক সিলেট মিরর সম্মাননা ছাড়াও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেট সহ আরো অনেক সংগঠন-প্রতিষ্ঠান তাঁকে নানা পদক সম্মানে ভূষিত করেছে। 

বহু গুণে গুণান্বিত নিজামউদ্দিন লস্কর খুব ফ্যাশন সচেতন, সুবক্তা, পড়ুয়া, বিজ্ঞানমনষ্ক, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে যুগোপযোগী করা অর্থাৎ সব মিলিয়ে সর্বতোভাবে একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন। প্রতিটা মূহুর্ত যাপন করতেন সৃজনশীল কাজে। সময়কে মূল্য দিয়েছেন জীবনভর। কারো কাছ থেকে কিছু শেখায় ছিলো অন্তবিহীন আগ্রহ। জ্ঞান বিতরণে ছিলেন আরো বেশি উদার। তাঁর আরো একটি গুণ আমাকে আকৃষ্ট করে, সেটা হলো কোন কিছু অজানা থাকলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করা এবং জেনে তারপর এ বিষয়ে কথা বলা। 

লেখক ও নাট্যকার নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না রচিত মঞ্চনাটক-রক্তপলাশ, গ্রাস, যুগ বদলের হাওয়া, শুধুই দর্শক, পাগলাগারদ, ঝুঁকি ইত্যাদি। অসংখ্য বেতার নাটকের রচয়িতা ও পরিচালক তিনি। নিজের যুদ্ধকথা নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ একাত্তরের রণাঙ্গনে , অনুবাদ গ্রন্থ আই লাভড এ্যা গার্ল, ডেথ অব এ্যা ডিক্টেটর, দ্যা মঙ্ক হু সোল্ড হিস ফেরারি, লিভ টু বি হানড্রেড এণ্ড এনজয় ইট, রূপান্তরিত উপন্যাস হৃদবদল, ভ্রমণকাহিনী ইউরোপের পথে ইত্যাদি পাঠক মহলে ভুয়সী প্রশংসা পেয়েছে। 

‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ এর অংশ বিশেষ মঞ্চায়ন তাঁর সর্বশেষ মঞ্চনাটকের কাজ। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নাট্যকর্মিদের নিয়ে ছিলো এ বিশেষ প্রযোজনা। রচিত সর্বশেষ বেতার নাটক ‘যুদ্ধ দিনের কথা' ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ, বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর তিনি শিশু সংগঠন পাঠশালা’র সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘শিশুর জন্য ভালোবাসা’য় অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। হুমায়ুন কবির জুয়েল এর সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের কন্ঠসৈনিক আরতী ধর, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শিল্পী সুরকার সুজেয় শ্যাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মণ রানা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আল-আজাদ এবং শিশু পাপেটশিল্পী চন্দ্রবিন্দু তোতা। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না দর্পণ থিয়েটার, সিলেট আয়োজিত, সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীদের সংস্কৃতিচর্চার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান ‘দর্পণে সিলেটের সংস্কৃতি’তে একমাত্র অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। হুমায়ুন কবির জুয়েল এর পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় সরাসরি সম্প্রচারিত এ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়সীমা ১ ঘন্টা। কিন্তু, ঐদিন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দর্শক প্রায় ২ ঘন্টা নিজামউদ্দিন লস্করের স্মৃতিচারণ উপভোগ করেন। পরে সকলের অনুরোধে ১২ জানুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৯টায় আলোচনার পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত হয়। ভাগ্য খারাপ, ময়না ভাইকে নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব আর হলো না! এ শূন্যতা রয়েছে আজীবন।

সকল জাতীয় সংকটে তাঁর উপস্থিতি আমাদের সাহসী করে তুলতো। করোনার এই মহামারীর একেবারে শুরুতেই আমরা যখন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যানারে মানুষের জন্য কাজ করা শুরু করেছিলাম, তখন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সাথে রাস্তায় ছিলেন। আপত্তি মানেন নি। পরবর্তীতে তাঁকে না জানিয়েই আমরা কাজ করতাম। আশংকা ছিলো, তাঁর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে। আজও চোখে ভাসছে-সাদা টি-শার্ট, নীল জিন্সপ্যান্ট, পায়ে কেডস পড়া নিজামউদ্দিন লস্করের নেতৃত্বে আমরা মিছিল সহকারে রেজিষ্ট্রারী মাঠে যাচ্ছি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হলের নামকরণের বিরুদ্ধে জামাত-শিবিরসহ সাম্প্রদায়িক চক্র যে, আন্দোলন শুরু করেছিলো তার প্রতিবাদে সেখানে সমাবেশে চলছিলো। চোখে ভাসছে মোটর সাইকেল চালিয়ে প্রান্তিকে আসছেন ময়না ভাই, পেছনে ভাবী। কি রোমান্টিক পরিবার! ভাবিও একজন নাট্যকর্মী। তাঁরা ভাই-বোনেরা মিলে একটি নাটকের দল গড়েছিলেন। নাম ‘ভাই-বোন সমিতি’। আজকের দিনে ভাবতেও অবাক লাগে কেবল নাটক করার জন্য একটি পরিবারে সংগঠন গড়ে উঠেতে পারে! সেই ভাই-বোন সমিতির নাটকে নির্দেশনা দিতে গিয়েই সুলতানা ভাবির সাথে পরিচয় অত:পর পরিণয়।

নাট্যমূহুর্ত বুঝাতে গিয়ে তিনি একটা গল্প বলেছিলেন,‘২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের তৎকালিন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। তাঁর বক্তৃতা চলাকালে একজন সাংবাদিক হঠাৎ বলে উঠে, “Mr. Churchill, you are a theif.” ।

উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে যায়। নিরাপত্তাকর্মীরা দৌড়ে এসে তাকে ঝাঁপটে ধরতে গেলে চার্চিল তাদের ইশারায় থামতে বলেন। সেই সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি আমাকে Theif বললে কেন? ঘর ভর্তি মানুষ অথচ পিনপতন নিরবতা। ভয়ঙ্কর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! কি বলেন সেই নারী সাংবাদিক? অতপর: সেই সাংবাদিক উত্তরে বললেন, “Mr. Churchill, you are a theif. Because you have stolen my heart.”

আমি ও বলছি, ময়না ভাই,You are a theif. Because you have stolen my heart.