Cinque Terre

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন

২০ জানুয়ারী , ২০২১


আবাসিক সম্পাদক

প্রথম আলো

উত্তর আমেরিকা


আমাদের প্রিয় নিজামউদ্দিন লস্কর

আমার শাশুড়ির ইচ্ছে ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না যেন পবিত্র কোরান থেকে পাঠ করেন। বলেছিলেনও। বোনকে কথাও দিয়েছিলেন। না, আমার শাশুড়ির এ শখ পূরণ হয়নি। নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না এ কাজ করতে পারেননি। তাঁর এক প্রিয় বোনের শখ পূরণ না করেই নিজামউদ্দিন লস্কর চলে গেছেন। 

১৭ জানুয়ারি নিউজার্সির শীত সকালে শাশুড়ির কণ্ঠে পবিত্র ধর্মগ্রন্থের পাঠের সঙ্গে বিলাপের উচ্চারণে এ চলে যাওয়ার কথা জানলাম।

নিজামউদ্দিন লস্করের কথা প্রথম জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধের সমর নায়ক জেনারেল ওসমানীর গল্প থেকে। নাটকের মঞ্চ থেকে সরাসরি দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়া এক কিশোরের গল্প। সম্মুখ সমরে আহত হওয়ার হওয়ার গল্প। সমরনায়ক তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন নিজামউদ্দিন লস্করকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। এক চৌকস নিজামউদ্দিন লস্কর মুক্তিযুদ্ধের পর বেশ কিছুদিন শহরে ছিলেন না। 

চা-বাগানে চাকুরি করেছেন। এক সময় জার্মানিতে চলে গেছেন। প্রবাস থেকে ফিরে আসার পরই তাঁর সঙ্গে দেখা। উজ্জ্বল কৃষ্ণ বর্ণ নিয়ে একজন মানুষ কী পরিমাণ সুদর্শন হতে পারেন, প্রথম দর্শনের সেই অবাক করা সময়ের কথা মনে পড়ে। 

আমরা তখন নাটক করব। আশির দশক। নাটকের সংগঠন করার জন্য সভা। নিজামউদ্দিন লস্কর চেতনা বা অন্য কোনও এক নাম দিয়ে সভা ডাকলেন। সিলেট শহরে তখনকার বনেদী ব্যবসায়ী আহমেদ সাহেবের কাছ থেকে নিজামউদ্দিন লস্কর ২০০ টাকার চাঁদা নিলেন। আহমেদ সাহেবকে সভাপতি করা হলো। নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার সঙ্গে আমার একটা সাংগঠনিক যোগাযোগ তখন থেকেই শক্ত হয়ে গেল। 

পরের সময়টা বড় অস্থির। একজন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নাকে যত দেখি, ততই ভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করি। এমন কোনও বিষয় নেই, তাঁর জানা নেই। বিশ্ব সাহিত্যের এমন কোনও পাঠ নেই, নিজামউদ্দিন লস্করের আয়ত্তে নেই। এসব কারণে তাঁর সাহচার্যে আসার পর আমাদের আর কিছু করার বা বলার ছিল না। বলতেন একজনই, আমরা শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ থেকে শেকস্পিয়ার। ব্রেখট থেকে পাবলো নেরুদা নিয়ে গভীর আলাপ।  

নব্বই দশকের শুরুতে আমরা যখন কম্পিউটারের কথা শুনছি। হাতে লেখার বদলে কম্পিউটার কম্পোজের কথা শুনছি, তখন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নাকে দেখি দ্রæত হাতে কম্পিউটার চালাচ্ছেন। লেখা কম্পোজ করছেন। তাঁর উদ্যোগেই সম্ভবত সিলেট স্টেশন ক্লাবে প্রথম কম্পিউটার নিয়ে আসা হয়। সব কাজের কাজী  ছিলেন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। 

তখন প্রথম ভিসিআর নামে বিষয়টা আমাদের নাগরিক জীবনে এসেছে। তাঁর বাসায় রাতের পর রাত জেগে আমরা ভিসিআর দেখতাম। এ এক উৎসব। নাটকপাড়ার লোকজনকে নিয়ে ছিল এমন রাতভরের আড্ডা। প্রায় একই সময়ে সিলেটে রুহুল আজাদ চৌধুরী একজন নাট্যজন হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠেন। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শিশু নিয়ে লেখা তাঁর নাটক ‘পায়ে পায়ে পদ’ বাংলা একডেমির পুরষ্কার পেয়েছিল। 

রুহুল আজাদ চৌধুরী নাটক লেখেন ‘স্বপ্ন লোকের চাবি’। এ নাটকের মূল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন আব্দুল হালিম, নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। আমাদের নানা দুরন্তপনা আর বোহেমিয়ান সময়ের নায়ক হয়ে উঠেন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না।  

নাট্যজন শিবু ভট্টাচার্য, রুহুল আজাদ চৌধুরী, নিজামউদ্দিন লস্কর, রেজাউল করিম, মোস্তফা কামাল, শফিক আহমেদ জুয়েল, অরিন্দম দত্ত চন্দন, এনামুল মুনিরসহ অন্যদের নিয়ে আমদের বোহেমিয়ান বিচরণ। সামাজিক নানা ক্লাব, সংগঠনে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ আমি। যেখানেই যাই, পেয়ে যাই একজন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নাকে।  

নিজামউদ্দিন লস্কর আবৃত্তি করেন, নাটক করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এক অস্থির মানুষের মূর্তিমান প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেন আমাদের কাছে।  

যতই তাঁর সান্নিধ্যে গেছি, নতুন করে আবিষ্কার করেছি প্রতিভার স্ফুরণ। তিন প্রজন্মের লোকজনকে নাড়া দিয়ে গেছেন সময়ের সাহাসী নায়ক নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। 

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কৃতিপুরুষ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিউইয়র্কে আসেন। এসে তাঁর পাড়াতো বন্ধু নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার গল্প বলেন। অগ্রজ থেকে সতীর্থ হওয়া ময়না ভাই এমনি করে আমাদের মধ্যে ধরা দেন।    

বৈবাহিক সূত্রে নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না আমার মামা শ্বশুর হয়ে গেলেন। দিন-রাতের নানা সম্পর্ককে পাশে রেখে পা ছুঁয়ে সালাম করার ঐতিহ্য আমাদের। দেশ ছাড়ার পর যতবার দেশে গেছি, ময়না ভাই (ময়না মামা) কাছে বসিয়েছেন। জামাই আদর করে খাইয়েছেন। পা ছুঁয়ে বিদায় নিয়েছি। জড়িয়ে ধরা উষ্ণতায় ভালোবাসার উত্তাপ ছড়িয়েছেন।  

কাছে বসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প করেছেন। গল্প করতে করতে রণাঙ্গনে সহযোদ্ধাদের কথা বলছেন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। অশ্রæধারা বেয়ে পড়ছে। রোমাঞ্চের এমন গল্প শোনার জন্য কত প্রহর গড়িয়েছে। সবই আজ স্মৃতি হয়ে গেছে। 

আর এ মানুষটি কাছে বসিয়ে বিশ্ব সাহিত্যের কোন বইটি অনুবাদ করবেন, কেন করবেনÑএ নিয়ে আর গল্প করবেন না। চার দশকের অগুনতি স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকবেন ভালোবাসার রঙে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে যাওয়া এক তেজস্বী মানুষ নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। এমন লোকের জন্ম প্রত্যেক সমাজে বারবার হয় না। তাঁর মৃত্যুতে কাঁদবে তিন প্রজন্মের মানুষ। 

কাঁদছেন আমার শাশুড়ি। তাঁর অন্তিমযাত্রায় পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ করে এক অতৃপ্ত আত্মার শান্তি কামনা করছেন। 

দূর দেশ থেকে আমাদের সময়ের দেশের এক প্রতিভাবান খাঁটি সন্তানের জন্য সবটুকু ভালোবাসা জানিয়ে শুধু বলতে চাই, মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকার সব উপাদান নিয়ে নিজামউদ্দিন লস্করের আগমন ঘটেছিল। সবাইকে নাড়া দিয়ে, পাওয়া না-পাওয়ার কোনও হিসেব না করেই ভালোবাসার শেষ স্যালুট নিয়ে চলে গেছেন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানানো ছাড়া আর কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।