Cinque Terre

আহমেদ নূর

২৫ জানুয়ারী , ২০২১


সম্পাদক

সিলেট মিরর


অনন্তলোকে ভালো থাকুন ময়না ভাই

ময়না ভাই (নিজামউদ্দিন লস্কর) এখন অনন্তলোকের বাসিন্দা। আজ তাঁর শোকসভা। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারযেখানে তাঁর পদচারণা ছিল সবসময়। আমাদের চেতনা শাণিত করতে, চেতনা জাগিয়ে দিতে এখানে এসেছেন তিনি বার বার। কখনও শোকে, কখনও দ্রোহে, প্রতিবাদী কণ্ঠে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। আজও ময়না ভাই শহীদ মিনারে আছেন। তবে শুধু ছবি হয়ে। শেষযাত্রায় তিনি যে এখান থেকেই বলে গেছেন, ‘বিদায়, বন্ধু বিদায়।’ 

আমাদের দিনগুলো তো ভালোই কাটছিল। সুন্দর, ঝলমলে আকাশ। অতিমারি করোনার দুঃসময় ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছিলাম আমরা। করোনাকালে সরাসরি সাক্ষাৎ কম হলেও নিয়মিত যোগাযোগ হতো। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে অনেকটা ঘরবন্দি ছিলেন তিনি। শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছেন। চুলগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছিল। বলেছিলামসাদা চুলে আপনাকে ভালো দেখায় না। পরে চুলে রং করেছিলেন। কিন্তু জীবনভর অবিরাম ছুটে চলা এই মানুষটির ঘরবন্দি জীবনই যেন কাল হয়ে উঠল। শরীরের ভেতর লুকিয়ে থাকা ব্যাধিগুলো সেই সুযোগে তাঁকে কাবু করতে লাগল। দুই দফা হাসপাতালে যেতে হলো তাঁকে। বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিতে হলো অনেকদিন। শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠলেন না আজন্ম সংগ্রামী এই মানুষটি। আমাদের সব প্রার্থনা, আকাক্সক্ষা, ভালোবাসার দাবিকে পেছনে ঠেলে ছুটে গেলেন অনন্তের পানে। 

আজ এই শোকসভায় আমিও থাকব। না থাকতে পারলেই খুশি হতাম। কারণ এত দ্রুত ময়না ভাইয়ের জন্য আমাদের শোকগাথা রচনা করতে হবে তা কোনওদিনই ভাবিনি। কতই-বা বয়স। সবেমাত্র ঊনসত্তর। বর্তমান বাস্তবতায় এটা খুব বেশি বয়স নয়। আর হলোই বা, তাতে কী? এজন্য ময়না ভাইকে চলে যেতে হবে? আমাদের যে আরেকজন ময়না ভাই নেইÑকষ্টটা, ক্ষতিটা ঠিক এই জায়গাতেই। আজ এই শোকসভায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা ময়না ভাইকে স্মরণ করব। তাঁর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করব। তাঁর চলে যাওয়ার ক্ষতির হিসাব মেলাব। আর তখনই আবার শূণ্যতায় হু হু করে উঠবে বুকটা। ভীষণভাবে অনুভব করব তাঁকে। 

আমাদের কত কথা হতো। তাঁর বাসায়, আমার অফিসে, আড্ডায়। কত বিষয় নিয়ে যে কথা হতো তার ইয়ত্তা নেই। কখনও রবীন্দ্রনাথ, কখনও নজরুল, সুকান্ত থেকে জীবনানন্দ। কিংবা মির্জা গালিব, ওমর খৈয়াম, শেক্সপিয়র, টম ওটুল, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান অথবা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মীর শওকত আলী...। বলে শেষ করা যাবে না। আমি তাঁর স্মৃতিচারণের মুগ্ধ শ্রোতা। কত শত ঘণ্টা যে আমরা এভাবে কাটিয়ে দিয়েছি, সে হিসেব রাখিনি। দরকারও মনে করিনি। কারণ এতে যে আমিই লাভবান হয়েছি বেশি। 

যুবক ময়না ভাই যখন দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তখন আমি কিশোর। তাঁর সঙ্গে আমার বয়সের তফাৎ অনেক। কিন্তু ময়না ভাই কোনওদিন আমার নাম ধরে ডাকেননি বা তুমি বলে সম্বোধন করেননি। সব সময় ‘নূর ভাই’ এবং ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। বাসায় গেলেই ড্রয়িং রুম থেকে হাক দিতেন ভাবিকে, ‘সুলতানা নূর ভাই এসেছেন, কিছু দাও’। একবার ময়না ভাইয়ের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। মামুন ভাই (নাট্যজন মামুনুর রশীদ) ময়না ভাইকে বললেন, ‘এই ময়না, নূর তো তোমার অনেক ছোট, তাহলে তাকে নূর ভাই আর আপনি বলছ কেন?’ ময়না ভাই বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ আপনি বুঝবেন না মামুন ভাই’। এখন কার সঙ্গে সম্পর্কের এমন সমীকরণ মেলাব ময়না ভাই?

আজ অনেক কিছুই আছে, শুধু ময়না ভাই নেই। যাঁর রচনা ও নির্দেশনায় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নাটক ‘রক্ত পলাশ’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। এ নাটকটি রচনার পেছনের কথা ময়না একবার বলেছিলেন। কিভাবে শেষ পর্যন্ত নাটকটি তিনি লিখেছিলেন। দেশের স্বনামধন্য গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান তখন চাকুরির সুবাদে সিলেটে থাকতেন এবং ময়না ভাইয়ের বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিনিই নাটকটি লেখার জন্য ময়না ভাইকে উস্কে দিয়েছিলেন। আর নাটকটির প্র্রেক্ষাপট ধারণা দিয়েছিলেন কর্নেল মীর শওকত আলী। তিনি ময়না ভাইকে শুনিয়েছিলেন কালজয়ী যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর কাহিনি। ময়না ভাইয়ের ভাষ্য মতে, তন্ময় হয়ে শুনছিলেন তিনি। যখন কাহিনি বলা শেষ হলো, মীর শওকতের ডাকে তাঁর ঘোর ভাঙলো। ময়না ভাই মীর শওকতকে বললেন, ‘স্যার, এটা তো আমাদেরই গল্প। ভেম নামের যে জার্মান ছেলেটা তার সতীর্থ বাউমারের সামনে মারা গেল, সে তো আমাদের মরম আলীর মতোই, আমি তাকে যুদ্ধের মাঠে নিজে কলেমা শুনিয়েছি।’ এই হলেন ময়না ভাই। লেখা হয়ে গেল ‘রক্ত পলাশ’। মঞ্চস্থ হলো নাটকটি। দিনটি ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৯৭২। 

ময়না ভাইকে গান গাইতে কতজন দেখেছেন কিংবা তাঁর কণ্ঠে গান শুনেছেন আমি জানি না। তবে আমি তাঁর কণ্ঠে গান শুনেছি। বহুদিন, বহু রাত। ডিএল রায়, অতুলপ্রসাদ, মান্না দে, ভ‚পেন হাজারিকা ঘুরে ফিরে আসতেন আমাদের আড্ডায়। মান্না দে-র গাওয়া ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ বহুল জনপ্রিয় একটি গান। কিন্তু এই গানটির দ্বিতীয় পর্বের আরেকটি গান অনেকেই হয়ত শুনেননি। সেটিও মান্না দে গেয়েছিলেন। ময়না ভাই পুরো গানটি আমাদের প্রায়ই গেয়ে শোনাতেন। আহ, কী যে মেলোডি! ‘স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো কফি হাউজেই,/ আজ আর নেই/ জীবনে চলার পথে হারিয়ে গিয়েছে অনেকেই/ আজ আর নেই’। হ্যাঁ, ময়না ভাই আপনিও হারিয়ে গেলেন, আপনিও আজ আর নেই। 

ময়না ভাইকে নিয়ে কতটা স্মৃতিচারণ করলে যে তাঁর সম্পর্কে বলা শেষ হবে জানি না। হয়ত কখনও শেষ করতেও পারব না। কিন্তু তিনি সততই বেঁচে থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে। কবির ভাষায় তাঁর গন্তব্য এখন, “অন্তহীন ধুলিরঙ পথ, নাম যার ‘মনে রেখো’।

 

এ সংক্রান্ত অন্য লেখা পড়ুন-

বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি