Cinque Terre

ফারজানা ইসলাম লিনু

০৭ ফেব্রুয়ারী , ২০২১


গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক


জয় করে অটোপাসের জবাব দাও

২০২০ সালের গোড়ার দিকে স্মরণকালের ভয়াবহতম মহামারির অকস্মাৎ আগমনে পুরো দুনিয়া দিশেহারা। দেশে দেশে লক ডাউনের মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে শুরু হয় প্রাণান্তকর চেষ্টা। 

লোক সমাগম ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া হয় ক’দিনের জন্য। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়াতে সেই ছুটি বাড়তে থাকে ক’দিন পর পর। তীরে এসে তরী ডুবে কতজনের। অন্তিম মুহুর্তে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করতে হয় এক রকম বাধ্য হয়ে।

পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের বাবা মায়ের মাথায়ও আকাশ ভেঙে পড়ে। দুই বছরের রুদ্ধশ্বাস প্রস্তুতি শিকেয় তুলে আড়মোড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা টেবিল থেকে উঠে যায়। ভেবেছিল লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে নিশ্চয়ই। স্বল্প বিরতির বিশ্রাম শেষে পরিবর্তিত রুটিনে শিগগিরই তারা আবার পরীক্ষায় বসবে ক’দিন পরেই। 

কিসের বিশ্রাম, কিসের রুটিন? দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। ছাত্রছাত্রীদের অবধারিত বিশ্রামের কাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। 

জীবন বাঁচাতে জীবিকায় হেঁচকা টান পড়ে। সময়ের প্রয়োজনে লক ডাউন ও শাট ডাউন সীমিত আকারে তুলে নেওয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় না। চৌদ্দশিকের বন্দিত্বের চেয়েও চার দেয়ালের স্বেচ্ছা বন্দিত্ব যে আরও কঠিন,তা প্রমাণিত হয় করোনাকালে।

দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত। বিশেষ করে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না সরকার। 

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সময় থাকতেই সব পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাশের ঘোষণা দেয়। সময়মতো তাদের ফলাফল প্রকাশ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। আর এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে আমরা তখনো সিদ্ধান্তহীনতায়। শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার ক্ষণ শেষ হওয়ার নাম গন্ধ নেই।

তবে গনমাধ্যমের কানাঘুষা থেকে জানা যায় বছরের শেষ প্রান্তে সীমিত সিলেবাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া হবে।

শরীরে জমে থাকা শেওলা ধুয়ে মুছে সবাই আবার পড়ার টেবিলে ফিরে আসে। 

টান টান উত্তেজনায় আবারও পরীক্ষা, আবারও অপেক্ষা রুটিনের। 

আচমকা একদিন শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হবে তাদের এইচএসসির ফলাফল। কেউ কেউ হাফ ছেড়ে বাঁচলেও কারও ক্ষেত্রে আবার উল্টোটাও ঘটে। এসএসসিতে আশানুরূপ ফলাফল করতে না পেরে এইচএসসিতে তারা কোমর বেঁধে নেমেছিল। পরীক্ষা না নেওয়ার এমন সিদ্ধান্তে ভীষণ আশাহত হয় তারা। 

তবুও সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। 

সৌভাগ্যবান পরীক্ষার্থীদের সবাই বিনা পরীক্ষায় পাশ করে স্ব স্ব যোগ্যতায় উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ পাবেন, আপাতত এইটুকুই সান্তনা।

দুনিয়ার তাবৎ সিদ্ধান্তই কারও জন্য পৌষ মাস, কারও জন্য সর্বনাশ। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিকে দিকে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা, সমালোচনা চলছে সমানে। 

অবস্থা এমন হয়েছে, কলাটা ছিলাইয়া দাও, পরক্ষণেই ছিলাইছো কেন বুঝাইয়া দাও। আমরা যখন কলা ছিলানো আর বুঝানো নিয়ে ব্যস্ত তখন পৃথিবীর দেশে দেশে অতিমারির মাঝেও চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস।

সব ধাক্কা ধাক্কি শেষে এইবার ফলাফল প্রকাশের পালা। কিন্তু আইনি জটিলতায় থেমে থাকে সেই প্রক্রিয়া। জটিলতা এড়াতে নতুন বছরে আইন পাশ করে রাতারাতি ফলাফল ঘোষণার পর শুরু হয় আরও মুখরোচক কাহিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের নামে শুরু হয় বিস্তর সমালোচনা। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধেও থামছেনা সেই সব ঠাট্টা মশকরা। 

কোমলমতি পরীক্ষার্থীরা এতোদিন পরীক্ষা না দিয়ে ছিল দুঃশ্চিন্তায়। আর এখন পরীক্ষায় অটো পাশ করে পড়েছে আরও বেকায়দায়। পরচর্চার নামে সস্তা পরশ্রীকাতরতা মাঝে মাঝে বিরাট দুর্ভোগ ডেকে আনে। 

প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় অনেকেই প্রত্যাশিত ফল লাভে ব্যর্থ হয়। চাপ নিতে না পেরে কেউবা ডিপ্রেশনে চলে যায়। 

প্রতিটা ঘটনার পেছনে থাকে পরিবারের বাড়তি প্রত্যাশা ও সমাজের অসহযোগিতা।

পরীক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রল তো বুলিংয়ের নামান্তর। আমার শঙ্কা হয়, হীনম্মন্যতা থেকে বাঁচতে বুলিংয়ের শিকার অটোপাশ ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ চরম ডিপ্রেসনে ভোগে অযৌক্তিক কিছু করে না বসে! এমনিতেই দীর্ঘ দশমাস থেকে তারা ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা দিচ্ছে। কতজনের কত রকম পরিকল্পনা ছিল, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

কোভিডের জন্য তারা দায়ী নয়। পরীক্ষা বাতিল কিংবা স্থগিতের জন্য তারা তো আর আন্দোলনে নামেনি, বিছানা বালিশ নিয়ে রাস্তায় শুয়ে অনশন করেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া হলে তারাও পরীক্ষায় বসতে বাধ্য ছিল। অনেকের ভালো ফলাফলের প্রস্তুতি ছিল। 

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল পরীক্ষা না নিয়ে পাশ করানোর এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সমস্যার উত্তরণ হয়তো শতভাগ হবে না। তবুওতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে।

এ বছর ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করেছেন। এর মধ্যে ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৪৭ হাজার ২৮৬ জন, যা মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

এ বছর জেএসসি কিংবা সমমানের ফলাফলকে ২৫ এবং এসএসসি কিংবা সমমানের ফলকে ৭৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার করা হয়েছে। তবে আইনে এর অনুমোদন না থাকায় পড়তে হয় জটিলতায়। পরে অধ্যাদেশ জারি করে ফলাফল প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সংসদ অধিবেশন চলে আসায় আর অধ্যাদেশ জারি না করে আইন সংশোধন করেই বোর্ডগুলোকে বিশেষ পরিস্থিতিতে ফল প্রকাশের ক্ষমতা দেওয়া হয়। হয়েছেও তাই। এ ছাড়া অন্য কোনো পথও ছিল না। 

তাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক তথা আমাদের সন্তানদের কথা চিন্তা করে অটো পাশ নিয়ে ত্যানা না পেছিয়ে তাদের সাহস যোগাই, উৎসাহ দিই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ধাপ তাদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। মেধার প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণদের মধ্যে অনেকেই ছিটকে পড়বে ভর্তি পরীক্ষা থেকে। 

তাই অটোপাশ শিক্ষার্থীদের গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে ভবিষ্যৎ পন্থা নিয়ে শক্তভাবে ভাবতে হবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এইচএসসি পাশ যদি হয় সন্ধ্যা তাহলে তো আসল কীর্তন এখনো বাকি। 

তাই অধিক লম্ফঝম্ফ কিংবা মন খারাপ দূরে সরিয়ে রেখে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। 

নিশ্চিদ্র প্রস্তুতি নেওয়ার পরও অপ্রতুল আসন সংখ্যার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে না কতজন। 

শক্ত হাতে হাল ধরে এগোতে হবে সমুখ পানে।

অটোপাশ করেও আমরা পারি দুনিয়া জয় করতে, দেখিয়ে দিতে হবে সবাইকে।