Cinque Terre

ফারজানা ইসলাম লিনু

২২ ফেব্রুয়ারী , ২০২১


গল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক


মিয়ানমারে অভ্যুত্থান : বিলম্বিত প্রত্যাবর্তন

দশকের পর দশক ধরে চলমান নিষ্ঠুর নির্যাতন, দমন-পীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে মায়ানমারের রোহিঙ্গারা। তাদের জাতিগত পরিচয় তো বিপন্ন হয়েছেই, কেড়ে নেওয়া হয়েছে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার। 

মৌলিক মানবাধিকার হরণ করার পাশাপাশি মিয়ানমারের সরকারগুলো রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে একটি খোলা কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কেউ বের হতে পারে না, সেখানে কেউ ঢুকতেও পারে না। 

সর্বশেষ ২০১৭ সালে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামে এক চরম নিষ্ঠুর অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গা নিধনের এই অভিযানে উগ্রবাদী রাখাইন বৌদ্ধরাও জল্লাদের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়।

মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা হাজার হাজার নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করে, হাজার হাজার নারীকে গণধর্ষণ করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।

বিশ্ব মানবতাকে হতবাক করে দেওয়া এই হত্যাযজ্ঞ ও রোহিঙ্গা জনগণের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা বৈশ্বিক গণমাধ্যমে প্রধান শিরোনাম হয়। টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড : রোহিঙ্গা নির্যাতন চারদিকে নিন্দার ঝড় উঠে। 

তথাপি জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন অন্যায়কারী শক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে, নিন্দা ও প্রতিবাদের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখে।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া  লাখ লাখ রোহিঙ্গার সম্পদ, সম্ভ্রম সব হারিয়ে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। অভ্যন্তরীণ নানা আর্থ-সামাজিক টানাপোড়নের মধ্যেও অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।

‘মানুষ মানুষের জন্য’Ñমানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, দুর্যোগে দুর্বিপাকে আমরাও পাশে দাঁড়াতে পারি। কিন্তু সীমিত সম্পদ ও সামর্থ দিয়ে নিজের ঘর চালানোই দায়, সেখানে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার’ সামিল। তাই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মায়ানমারকে চাপ দিতে বিশ্বমোড়লদের কাছে ধর্ণা দেওয়া হয় বার বার। 

একে তো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার বরাবরই উদাসীন। তার ওপর বিশ্বের দুই প্রভাবশালী পরাশক্তি রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধবাদী আচরণ, ভারতসহ আরও কিছু দেশের সুবিধাবাদী অবস্থানের কারণে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ বার বার ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া কর্মকাÐ বাড়ছে দিনকে দিন। তাদের অবস্থা হয়েছে ‘সাগরে পেতেছি শয্যা আর শিশিরে কি ভয়?’

দূর পরবাসের অনিশ্চিত জীবনে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা অবলীলায়। আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও বখাটেদের উৎপাতে অতিষ্ট স্থানীয় জনগন ও প্রশাসন। আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। 

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ রীতিমতো বেকায়দায় পড়েছে। সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টা বার বার মুখ থুবড়ে পড়াতে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গত তিন বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতি, সাধারণ নির্বাচনসহ আরও নানা কারণ দেখিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রতিবার পিছিয়ে দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। অতীতে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশ এখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি।

এদিকে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলোতে ধারণক্ষমতার অধিক রোহিঙ্গাদের বাস। চাপ কমানো এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকারকে বিকল্প চিন্তা করতে হচ্ছে।

নোয়াখালীর ভাসানচরে প্রায় তিন হাজার পঁচানব্বই কোটি টাকা খরচ করে জীবন ধারণের সব ধরনের সুবিধাসহ পরিকল্পিতভাবে একটি নগর গড়ে তোলা হয়েছে। পাকা বাড়ি, পর্যাপ্ত রোড নেটওয়ার্ক, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অনেক সুবিধা আছে।

বাংলাদেশ সরকার নিজের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রদানের এই চেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে উল্টো সন্দেহ পোষণ করছে পদে পদে। রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে না নেওয়ারও সুপারিশ করছে তারা। এইসব সন্দেহ ও নিষেধাজ্ঞায় কর্ণপাত না করে এই পর্যন্ত কয়েক দফায় বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুবিধা বঞ্চিত রোহিঙ্গারা নতুন বাসস্থানে অপেক্ষাকৃত ভালো সুযোগ সুবিধা পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। 

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমার ও দেশটির জেনারেলদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে জাতিসংঘের একটি আদালতে। মধ্য আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার করা মামলায় অং সান সুচিকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে তলব করা হয়। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’, মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেতা নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চি তার দেশের বিরুদ্ধে আনা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অকপটে  অস্বীকার করেন। জাতিসংঘের এই সবোর্চ্চ আদালত উপযুক্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে অন্তরবর্তীকালীন রায় দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা প্রতিরোধে মিয়ানমারকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আইসিজেতে এই মামলা এখনো বিচারাধীন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় আছে বিশ্ব।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোয় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে মিয়ানমার। ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পার্সন্স ফ্রম রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক চুক্তি অনুযায়ী ২৩ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল।

অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এইসব চুক্তি আমাদের জন্য তেমন কোন আশার আলো না। তবুও আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, এইবার কিছু একটা হবে অন্তত।

কিন্তু গেলো সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে গত ১ ফেব্রæয়ারি।

মিয়ানমারে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এই নিয়ে আমাদের ভাবনা, দুশ্চিন্তা কম নয়।

আশংকা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে নিপীড়ন শুরু হলে এদেশ থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে না। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

যদিও ক্ষমতা দখলের পর জান্তা প্রধান প্রতিশ্রæতি দেন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা মেনে চলবেন তিনি।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলেরও ধারণা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের গৃহীত অঙ্গীকারগুলো সেনা সরকার নিশ্চিত করলে প্রত্যাবাসন নিয়ে আর কোন ভাবনা থাকবে না। কিন্তু আমরা যে ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।