Cinque Terre

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী

২৫ ফেব্রুয়ারী , ২০২১


সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক


রক্তে কেনা ফেব্রুয়ারি : ভাষার কথা

প্রতিবছরই আমাদের মাঝে ফিরে আসে বাঙালির নিজের রক্তে অক্ষর কেনার দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দিনটি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর শৌর্যবীর্য আর চেতনা জাগরণের প্রতীকও বটে। মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও তাবৎ আন্দোলনকে বানচাল করতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম গুলি করে হত্যা করা হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শফিউলসহ আরও অনেক ছাত্রযুবাদের। এই দিনে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালির দীর্ঘ ভাষা আন্দোলন একটা চূড়ান্ত রূপ নেয়। সৃষ্টি হয় বাঙালি জাতির ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়। যে অধ্যায় আমাদের জাতিসত্ত্বার গৌরবের, অহংকারের এবং প্রেরণার। 

মাতৃভাষার জন্য বায়ান্নর সেই লড়াইয়ের বীরত্বগাথা আজ দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে এবং ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তাই বলা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার, আমাদের গৌরবের, আমাদের প্রেরণার। 

ভাষার জন্য বাঙালি জাতির আন্দোলন ছিল সু-দীর্ঘকালের। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্ব থেকে ভাষা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল। চল্লিশের দশকের শুরুতে এ আন্দোলন মূলত সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক ‘ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতীয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।’ এতে প্রতীয়মান হয় ভাষার জন্য আন্দোলন বাঙালির সু-দীর্ঘকালের। 

বিশেষত ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে পাকিস্তানি শাসকরা মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করায় পূর্ববাংলায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তৎকালেই রাজপথে প্রথম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। তখন থেকেই ভাষা কেন্দ্রিক এ আন্দোলনের মূল সূচনা ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। একুশে ফ্রেবুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হলে পুলিশ ছাত্র-যুবাদের মিছিলে গুলি চালায়। এ দিন সূর্যসন্তানেরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে ফিরিয়ে আনেন মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। তাই বোধ করি, একুশে ফেব্রæয়ারি শহিদদের রক্তেই কেনা হয় মায়ের ভাষার অধিকার, বাংলা অক্ষর। পরবর্তীতে বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃতি ঘটে বাংলা বর্ণমালার।  

ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা এই যে, ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে দেশভাগের পর পাকিস্তান অংশের পূর্ববাংলা আসলে স্বাধীনতা লাভের অন্তরালে একধরণের পরাধীনতাই লাভ করে। শাসনের নামে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বপাকিস্তানিদের (পূর্ববাংলার জনগণের) ওপর চাপিয়ে দেয় শোষণ-নিপীড়নের যাঁতাকল। এতেই পাকিস্তানিরা ক্ষান্ত হয়নি, তারা শোষণ-নিপীড়নের পাশাপাশি বাঙালির মায়ের ভাষার অধিকার কেড়ে নিতে আরও তৎপর হয়ে উঠে। দেশ ভাগের শুরু থেকে পশ্চিমারা একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা চেয়েছিল, বাঙালিদের হাজার বছরের ভাষাটিকে ভুলিয়ে দিতে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা শঠতার আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বদলে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালি সূর্যসন্তানেরা পাকিস্তানিদের এমন ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তখন থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে মুখর হয়ে উঠে এবং পূর্ব বাংলাজুড়ে ছাত্র-জনতা মিছিল-মিটিং ও আন্দোলনে সরব হয়ে পড়ে। 

১৯৫২ সালে একুশে ফ্রেব্রæয়ারি ছাত্র ও যুবাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জনবিস্ফোরণ ঘটে। সে থেকে ভাষার জন্য আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও রাজপথে নেমে আসে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে ভাষা শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। 

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাষার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তঝরানোর পর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে আন্দোলনের মুখে ৯ মে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে কাগজে-কলমে আমাদের মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে এ কথা পরিষ্কার বোধগম্য যে, রক্তাক্ত একুশ বাঙালিদের শিখিয়েছে যে কোনও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করে ঠিকে থাকতে হয়। যখনই বাঙালি জাতি কোনও অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছে, একুশ হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের অদম্য সাহস। বলাইবাহুল্য যে, বাায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের সে ভয়ানক রুপ বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সে প্রেরণা থেকে একাত্তরের সাতই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের বাঙালিরা মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীনতার আড়াই দশক পূর্ণ হতে না হতেই ইতিহাসের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে ১৯৭১-য়ের স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে এবং  দীর্ঘ নটি মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

১৯৫২-র একুশের শহিদেরা হয়ে উঠেছেন আজ বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার পাহারাদার। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউলদের ভাষার জন্য আত্মদান পেয়েছে অনন্য স্বীকৃতি। তাই বলা যায়, একুশে ফেব্রæয়ারি আমাদের গৌরবের দিন। একুশের কোনও সীমান্ত নেই। এ এমন এক প্রেরণার দিন, যার অস্তিত্ব পুরো বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত, সব মানুষের কাছে উজ্জ্বল এবং চির ভাস্বর।