Cinque Terre

নূরুল হুদা নাঈম

০৩ মার্চ , ২০২১


নাক, কান, গলা ও হেড-নেক বিশেষজ্ঞ সার্জন,

পরিচালক, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচি,

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


‘সবার জন্য শোনার যত্ন’ : সচেতনতা জরুরি

বিশ্ব শ্রবণ দিবস ৩ মার্চ। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “Hearing Care For All” “সবার জন্য শোনার যত্ন”। বিষয়টি আসলেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মধ্যে যারা স্বাভাবিক শুনি তাদেরও কানের যত্ন নিতে হবে উচ্চ শব্দ এড়াতে হবে, হেড-ফোন ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। যারা কানে কম শোনেন তাদের তো সেবা ও যত্ন দুটোই নেওয়া অবশ্যম্ভাবী। 

কম শোনার রোগীদের জন্য বিভিন্ন সার্জারীর পাশাপাশি হিয়ারিং এইড দিয়ে সাহায্য করা সম্ভব। জন্মগতভাবে বধির বা মারাত্মক বধিরদের জন্য যুগান্তকারী আবিষ্কার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট। আনন্দের বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশেও এ অপারেশন সফলভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে এবং এ বছরই আমাদের সিলেট ওসমানী মেডিকেলে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম শুরু হবে। 

কান মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। শোনা এবং ভারসাম্য রক্ষা ছাড়াও সৌন্দর্য বর্ধনে কানের ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বে গড়ে ৪৭ কোটি মানুষ কানে কম শোনা সমস্যায় ভোগেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব জুড়ে ৯০ মিলিয়নের থেকে বেশি মানুষ শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ অংশই শিশু। বাংলাদেশেও এর সংখ্যা মোটেও কম নয়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক কানে কম শোনার সমস্যায় ভোগেন। ইদানিং আমাদের যুব সমাজ বিশেষ করে ইয়ার-ফোন বা হেড-ফোন ব্যবহারের ফলে কানে শোনার সমস্যায় ভোগছেন অনেক বেশি। এমনকি কানে শো শো আওয়াজ সমস্যা নিয়েও অনেকেই আসেন। কানে না শোনার অক্ষমতা এক বা উভয় কানে হতে পারে। সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করলে কানে কম শোনার এসব সমস্যা বেশিরভাগই প্রতিরোধ করা যায়। 

শ্রবণ প্রক্রিয়া : মানব দেহের কানের তিনটি ভাগ রয়েছেবহি কর্ণ, মধ্য কর্ন এবং অন্ত কর্ন। বহি কর্ণ শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দাকে vibrate করে।  মধ্য কর্ণ : মধ্য কর্নের হাড়কে vibrate করে শব্দ তরঙ্গকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্ত কর্ণের তরলে পৌঁছায়। অন্ত কর্ণ : কক্লিয়াতে অবস্থিত অর্গান অব কর্টির সংবেদী লোম কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে ইলেক্ট্রিকেল ইমপালস এ পরিনত হয়ে অডিটরি নার্ভের মাধ্যমে ব্রেইনে যায় এবং আমরা শুনি।

কানে কম শোনার কারণ : বহি কর্ণের প্রদাহ-কানে ময়লা জমে যাওয়া, কানে খৈল বা ওয়াক্সের সঙ্গে ধুলাবালি জমা, ভাইরাল ইনফেকশন। মধ্যকর্নের সমস্যাÑকান পাকা রোগ, পর্দায় ছিদ্র, মধ্যকর্নে পানি-পুঁজ-রক্ত জমে যাওয়া, হাড়ের জোড়ায় সমস্যা, ফুট প্লেইট শক্ত হয়ে যাওয়া (অটোস্কে¬রোসিস)। 

অন্ত কর্নের সমস্যা : জন্মগত বধিরতা, কানে যে কোন টিউমার বৃদ্ধি পেতে থাকলে, কানের অভ্যন্তরে হিয়ারিং সেল নষ্ট হয়ে গেলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে, অটোটক্সিক ঔষধ যেমন-এমাইনোগ্লাইকোসাইড, জেন্টামাইসিন ফিউরোস্যামাইড (ল্যাসিক্স), এন্টিক্যান্সার, এন্টিটিউবারকুলার ড্রাগ অথবা  অ্যাসপিরিনের বেশি মাত্রা খেলে। 

 

আপনি কম শুনছেন কি? 

শ্রবণ শক্তি হ্রাস পাচ্ছে কিনা তা প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় না। তাই নিচের কোন উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। যেমনঅন্য মানুষের কথা ভালো করে বুঝতে পারছেন না, বিশেষ করে হৈচৈ পূর্ণ জায়গায়। বারবার কথা পূণরাবৃত্তি করতে অনুরোধ করছেন। টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে শুনতে হয়। ফোনে কথা শুনতে কষ্ট হয়। অন্যান্য মানুষের কথার শুনার জন্য গভীরভাবে মনোযোগ দেওয়া লাগে এবং গভীর মনোযোগের কারণে কিছুক্ষণ পরে ক্লান্তি লেগে যায়। যে কোন কারণে শ্রবণ শক্তি হ্রাস পেলে সাধারনত এই উপসর্গগুলো দেখা দেয়। তবে সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শে, সার্জারী বা হিয়ারিং এইড এই সমস্যা কমানোর ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করতে পারে। কিছু কিছু শিশুর জন্ম থেকে শ্রবণ শক্তি কম থাকতে পারে। এটাকে কনজেনিটাল হিয়ারিং লস বলা হয়। কনজেনিটাল হিয়ারিং লস পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থাকলে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে শিশু জন্মের সময় যথেষ্ট অক্সিজেন না পেলে অথবা মানসিক আঘাত পেলেও এটা হতে পারে। নবজাতক জন্ডিসের কারনেও শিশুর শ্রবণ শক্তি হ্রাস পেতে পারে। এক্ষেত্রে নবজাতকের শোনার কিছু টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। উন্নত বিশ্বে বাচ্চা জন্মের পর এসব টেস্ট করার সুবিধা থাকে।

কানে কম শোনা কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় : 

টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা, শিশুদের শ্রবণক্ষমতা স্ক্রিনিং করা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ন্যাশনাল হিয়ারিং স্ক্রিনিং অন্তর্ভূক্ত করা। হিয়ারিং ডিভাইস এবং থেরাপি সহজলভ্য করা। স্বাস্থ্য সেবা দানকারীদের প্রশিক্ষিত করা। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রন, অটোটক্সিক ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার। অযথা ম্যাচের কাটি, মুরগির পালক, মাথার ক্লিপ, কচুর ডাটি, কটনবাডস এগুলো দিয়ে কানে খোঁচাখোঁচি না করা। কানে যাতে পানি না যায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে কান পরিষ্কার না করানো। উচ্চ আওয়াজ এড়িয়ে চলছে শব্দটি কতজোরে তা দেখুন। যেমন-কানাকানি-৩০ ডিবি, কথোপকথোন-৬০ডিবি, ব্যস্ত ট্রাফিকে-৭০-৮৫ ডিবি, মোটরবাইক-৯০ ডিবি, হেডফোনের মাধ্যমে পূর্ণ ভলিউমে গান শোনা-১০০-১১০ ডিবি। হেড ফোন ব্যবহার করার সময় নয়েজ ক্যানসেলিং ইয়ার ফোন ব্যবহার করুন। ৬০% এর উপরে ভলিউম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। উচ্চ আওয়াজ এ কার্যক্রমের সময় নিজের শ্রবণ শক্তিকে রক্ষা করতে হবে। শিশুদের কানে শোনার পরীক্ষা কখন করতে হবে নিয়মিত।  যেমন-১মাস সময়ের মধ্যে পরীক্ষা, ৩মাস সময়ের মধ্যে রোগ নির্ণয় এবং ৬ মাসের মধ্যে চিকিৎসা করতে হবে। 

কানে কম শোনা সমস্যার প্রতিকার :

মুখ বন্ধ করুন এবং হাতের দুই আঙ্গুল চেপে ধরুন। অর্থাৎ এই অবস্থায় নাক বা মুখ কোন বাতাস ঢুকছে না বা প্রবেশও করছে না। এবার নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ার মতো করে চাপ দিন। কিন্তু নাসারন্দ্র দিয়ে বাতাস বেরুতে দেবেন না। দেখবেন শব্দের ‘পপ’ শব্দে বন্ধ কান খুলে গেছে। তবে খুব জোরে শ্বাস ছাড়ার মতো করে বাতাসের চাপ দেবেন না। এতে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রথমবার কাজ না হলে কয়েকবার চেষ্টা করতে পারেন। ডাক্তারের পরামর্শে দ্রæত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সার্জারী বা এসিস্ট ও ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত অন্তত বছরে একবার কানের শোনার টেস্ট করে রাখা।

বিশ্ব শ্রবণ দিবসে সবাই শোনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে কানের যথাযথ যতœ নেবেন এই প্রত্যাশা।