Cinque Terre

বিপ্রদাস ভট্টাচার্য

০৯ মে , ২০২১


সংগীতশিল্পী

সংগীত বিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা


রবীন্দ্রনাথ : মানবতার জয়গানে

রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্র সাহিত্যের সমালোচনা করার ক্ষমতা যে ক’জন লেখকের ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এন সি চৌধুরী (নীরদ চন্দ্র চৌধুরী)। এন সি চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধর্ম সম্বন্ধে ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তত্ত¡বিদ্যায় আমার কোন অধিকার নেই। দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদের কোনো তর্ক উঠিলে আমি নিরুত্তর হইয়া থাকিব। আমি কেবল অনুভবের দিক দিয়া বলিতেছি, আমার মধ্যে আমার অন্তর্দেবতার একটি প্রকাশের আনন্দ রহিয়াছে-সেই আনন্দ সেই প্রেম আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। আমার বুদ্ধিমন আমার নিকট প্রত্যক্ষ এই বিশ্বজগত। আমার অনাদি অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যৎ পরিপ্লুত করিয়া বসিয়া আছে। এ লীলা তো আমি কিছুই বুঝি না কিন্তু আমার মধ্যেই নিয়ত এই এক প্রেমের লীলা’। এর উত্তরে এন সি চৌধুরী লিখেন, ‘ইহা অনুভূতির কথা, ভক্তির কথা, তর্কের কথা তো নয়ই, এমন কি বুদ্ধি বা জ্ঞানের নয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান বা গদ্য রচনা হইতে ভক্তি সম্বন্ধে তাঁহার কোন স্পষ্ট উক্তি পাওয়া যাইবে না’। 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সে আজি বিশ্বের মাঝে মিশিছে পুলকে/ সকল আনন্দে আর সকল আলোকে/ সকল মঙ্গল সাথে।’ 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সকল বাণীর মধ্যেই মানবতার এক বিশাল ছায়া ফেলে রেখেছেন। যিনি সত্যকে জীবন দ্বারা উপলব্ধি করেছেন। কি গদ্য কি পদ্য সবখানেই জীবনের পূর্ণতার সাধনা। পরিপূর্ণ অস্তিত্বের দ্বারা অখন্ড সত্যের সাধনা। মানুষের মন ও জ্ঞানের যে একাত্মতা কবি তা অনুভব করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন,‘খন্ডতার মধ্যে কদর্যতা, সৌন্দর্য একের মধ্যে; খন্ডতার মধ্যে প্রয়াস, শান্তি একের মধ্যে; খন্ডতার মধ্যে বিরোধ, মঙ্গল একের মধ্যে; তেমনি খন্ডতার মধ্যেই মৃত্যু, অমৃত একের মধ্যে। সেই এক কে ছিন্ন করলে আমরা নিজের অস্তিত্বকেই খন্ডন করবো। আর বর্তমান আধুনিকতার যুগে চলছে নিরন্তর প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার দলে যারা তারা ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সমাজবদ্ধ মানুষ তাদেরকে আটকাতে পারছে না। নদীর অবিরাম স্রোতের মতই মানুষ ছুটে চলেছে। কোত্থেকে এসেছে কী তার কর্তব্য, কী তার দায়িত্ব সে দিকটা ভুলে বসে আছে। প্রতিযোগিতার ধারা বজায় রাখতে মানুষ ক্রমশই খন্ডিত হয়ে পড়ছে। স্নেহ ভালবাসা এখন কৃত্রিমতায় ভরে আছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অন্তর থেকে তা উপলব্ধি করেছেন। তিনি বার বার মানুষের হৃদয়কে জাগাতে চেয়েছেন। পৃথিবীখ্যাত যে ক’জন কবি সাহিত্যিক মানতবার আদর্শকে গভীরভাবে দেখেছেন তার মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ। শেলী, কীট্স্,  হুগো, শেক্সপীয়ার, দান্তেসহ অন্যান্য খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকগণ প্রায় একই পথের যাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও শেলী, কীট্স্ ও কালিদাসের তুলনামূলক আলোচনায় সাহিত্যিক গবেষক প্রমথনাথ বিশী উল্লেখ করেন, ‘বৈষ্ণব কবিদের অপেক্ষা শেলীর প্রভাব রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার কাব্যে অনেক বেশি। বৈষ্ণব কবিদের সহিত রবীন্দ্রনাথের শিল্প ধর্মের মাত্র ঐক্য ছিল, বৈষ্ণব কবিতার অন্তরঙ্গের সহিত তিনি নিবিড়ভাবে অন্তরঙ্গতা করিতে পারেন নাই। কিন্তু শেলীর সহিত তাঁহার ঐক্য গভীরতম।’ শেলীর কাব্যে মানব ও প্রেম যেভাবে মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠেছে ঠিক সে ভাবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও ধরা দিয়েছে। শেক্সপীয়ারের টাইমস অব এথেন্স নাটকে ও জীবন চরিতাবলী স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। টাইসন মনের দুঃখে বলতে লাগলো ‘মানুষের হৃদয় হীনতা দেখে তুমি এখনো চুপ করে আছো ধরিত্রীমাতা। তোমার বুকে যে সম্পদ নিহিত আছে তাতে বিশ্বের জীবকূল প্রতিপালিত হয়। আবার এই গর্ভ থেকেই অহংকারী অত্যাচারী মানুষ প্রসূত হয়। এবার তুমি কুটিল সাপ, বিষাক্ত ব্যাঙ আর অন্ধ বিষময় এমন কীটপতঙ্গের জন্ম দাও যাদের পৃথিবীর মানুষ ঘৃনা করে। তোমার এই উর্বর শস্যসম্পদশালিনী বক্ষ থেকে আমি শুধু একটি শিকড়ই চাই। তোমার এ গর্ভে অকৃতজ্ঞ মানুষকে যেন আর ধারণ করো না। তার থেকে বাঘ, ভালুক, সাপ ও ড্রাগন প্রভৃতি হিংস্র প্রাণীর জন্ম দাও।” সমাজের অকৃতজ্ঞ মানুষের প্রতি যে ঘৃণা ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের নাটকে খোঁজে না পেলেও গদ্য ও কাব্যে খোঁজে পাওয়া যাবে। একথা স্বীকার্য শেক্সপীয়ারের নাটকে কর্মময় মানবজীবনের যে দ্ব›দ্ব চিত্র, জীবনযুদ্ধে আত্ম প্রতিষ্ঠার দুর্জয় শক্তি দেখা যায় রবীন্দ্র নাটকে তা একইভাবে ফুটে ওঠেনি। তবে উভয়ই মানব চরিত্রকে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেছেন। বিচিত্র জীবনদর্শন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। 

রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে জমিদারী দেখাশুনায় ব্যস্ত ছিলেন তখন তাঁর মত অতি সাধারণ এক মানুষকে পেয়ে কৃষকরা জমিদারের আসল চেহারা ভুলে গেল। ধনী কর্কশ মেজাজের জমিদারের পক্ষে গাঁয়ের সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। এতে কৃষক ও প্রজাকূলের সাথে জমিদারের দূরত্ব থাকতো বেশি। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গাঁয়ের লোকের সুখ দুঃখের কথা সহৃদয়তা বারে বারে রবীন্দ্রনাথকে দুখি মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এখানকার প্রজাদের ওপর বাস্তবিক মনের স্নেহ উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে, এদের কোনো রকম কষ্ট দিতে আদপে ইচ্ছে করে না, এদের সরল ছেলে মানুষের মতো অকৃত্রিম স্নেহের আবদার শুনলে বাস্তবিক মনটা আদ্র হয়ে ওঠে। যখন তুমি বলতে বলতে তুই বলে ওঠে যখন আমাকে ধমকায় ভারি মিষ্টি লাগে’। রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের ভালবাসতেন। তাঁর জমিদারী খাতায় একপৃষ্টায় কবিতার আর অপর পৃষ্ঠায় খাজনার হিসাবও পাওয়া গেছে। তাঁর ছিন্নপত্রে উল্লেখ রয়েছে-‘ভক্তি ভালোবাসা স্নেহ অযথা পরিমাণে এবং অযোগ্য পাত্রে পড়লেও তার এমন একটি আশ্চর্য সৌন্দর্য আছে, আমার এখানকার প্রজারা সেই পরিপূর্ণ ভক্তির সরলতায় সুন্দর। তাদের রেখাঙ্কিত বৃদ্ধ মুখের মধ্যেও একটি শৈশবের সৌকুমার্য আছে’। তিনি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর স্নেহটুকু গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছেন সেই কৃষকদের মাঝে। সাধারণ মানুষরা যে অল্পে সন্তুষ্ট থাকে, তাদের চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিতান্তই কম সে মর্মবাণী রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে মুক্ত এই পল্লী গ্রামের মানুষগুলো কতই আপন কতই নিরহংকারী তা রবীন্দ্রনাথের ছিন্ন পত্রাবলীতে খোঁজে পাওয়া যায়। বিশাল এক মানব দর্শন সেখানে উপস্থিত। কৃষকের কৃষিঋণ, উন্নত চাষ ব্যবস্থা, শিশুদের শিক্ষার জন্য শিশু পাঠশালা এসবই তাঁর চিন্তা চেতনা ও কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ নবযুগ প্রবন্ধে বলেন, আমি এক সময় পদ্মাতীরে নৌকোয় ছিলেম। একদিন আমার কানে এল, একজন বিদেশী রুগ্ন হয়ে শীতের মধ্যে তিন দিন নদীর ধারে পড়ে আছে। তখন কোনো একটা যোগ ছিল। স্ইে মুমূর্ষুর ঠিক পাশ দিয়েই শত শত পূণ্যকামী বিশেষ স্থানে জলে ডুব দিয়ে শুচি হবার জন্য চলেছে। তাদের মধ্যে কেউ পীড়িত মানুষকে ছুঁল না। সেই অজ্ঞাতকুলশীল পীড়িত মানুষের সামান্য মাত্র সেবা করলে তারা অশুচি হত, শুচি হবে জলে ডুব দিয়ে। জাত বলে একটা কোন্ পদার্থ তাদের আছে মানব-জাতীয়তার চেয়েও তাকে বড়ো বলে জেনেছে। যদি কারও মনে দয়া আসত, সেই দয়ার প্রভাবে সে যদি তার বারুণী¯œান ত্যাগ করে ওই মানুষটিকে নিজের ঘরে নিয়ে সেবা করত, তা হলে সমাজের মতে কেবল যে বারুণীর ¯œানের পুণ্য সে হারাত তা নয়, সে দন্ডনীয় হত, তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। তার ঘরে এসে রোগী যদি মরত তা হলে সমাজে সে বিষম বিপন্ন হয়ে পড়ত। সে মানবধর্ম সকল নিরর্থক আচারের বহু উর্ধ্বে তাকে দন্ড মেনে নিতে হবে আচারীদের হাতে। 

মানবিক মূল্যবোধের চেতনায় কবি আরো উল্লেখ করেন, ‘একজন প্রাচীন অধ্যাপক আমাকে বললেন, তাঁর গ্রামের পথে ধূলিশায়ী আমাশয় রোগে-পীড়িত একজন বিদেশী পথিককে তিনি হাটের টিনের চালার নীচে স্থান দিতে অনুরোধ করেছিলেন। যার সেই চালা সে বললে, পারব না। তিনিও লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করলেন যে, তিনিও সমাজের দন্ডের ভয়েই তাকে আশ্রয় দিতে পারেন নি। অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যসাধন শাস্তির যোগ্য। তিনি হোমিওপ্যাথি জানতেন, পথের ধারেই তাকে কিছু ওষুধপত্র দিয়েছিলেন। আরোগ্যের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় রাত্রে শিলাবৃষ্টি হল ; পরদিন সকালে দেখা গেল, সে মরে পড়ে আছে। পাপপুণ্যের বিচার এত বড়ো বীভৎসতায় এসে ঠেকেছে। মানুষকে ভালোবাসায় অশুচিতা, তাকে মনুষ্যোচিত সম্মান করায় অপরাধ। আর জলে ডুব দিলেই সব অপরাধের স্খলন। এর থেকে মনে হয়, যে অভাব মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো অভাব সে প্রেমের অভাব। সে প্রেমের অভাবকে হৃদয়ে নিয়ে আমরা যাকে শুচিতা বলে থাকি তাকে রক্ষা করতে পারি, কিন্তু মনুষ্যত্বকে বাঁচাতে পারিনে। 

আশা করি, দুর্গতির রাত্রি-অবসানে দুর্গতির শেষ সীমা আজ পেরোবার সময় এল। নবীন যুগ এসেছে। আর্যে-অনার্যে একদা যেমন মিলন ঘটেছিল, শ্রীরামচন্দ্র যেমন চন্ডালকে বুকে বেঁধেছিলেন, সেই যুগ আজ সমাগত। আজ যদি আমাদের মধ্যে প্রেম না আসে, কঠিন কঠোর নিষ্ঠুর অবজ্ঞা মানুষের থেকে মানুষকে দূর করে রাখে তবে বাঁচব কী করে। রাউন্ড টেবিলে গিয়ে, ভোটের সংখ্যা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে? পশুর প্রতি আমরা যে ব্যবহার করি মানুষকে যদি তার চেয়েও অধম স্থান দিই তবে সেই অধমতা কি আমাদের সমস্ত সমাজেরই বুকের উপর চেপে বসবে না?’ 

কবিগুরুর লেখনী বিশ্লেষণ করলে এটাই সুস্পষ্ট দেখা যায় যে, মানবতার জয়গান গেয়েছেন তিনি। মানুষ তার মানবিক ধর্মকে জাগিয়ে তুলে সৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য উদ্দেশ্য সাধনে এগিয়ে যাবে, এটিই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন।