Cinque Terre

ফয়সল আহমদ চৌধুরী

১৫ মে , ২০২১


চেয়ারম্যান

বারাকা ফ্যাশন লিমিটেড


জান্নাত দেখতে হলে আল আকসা দেখে নাও

 

গত কয়েক সপ্তাহের বিভিন্ন ঘটনাবলি মনকে বিচলিত করেছে।মুসলমানদের দ্বিতীয় কাবা আল-আকসাতে ইসরাইলি দখলদারদের নগ্ন হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে পবিত্র মসজিদ।নামাজরত মুসল্লিদের উপর বর্বরোচিত জঘন্য হামলাতে মুসলমানসহ সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিশ্ব বিবেক আজ নিরব। আশার কথা যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম প্রধান দেশ এই বর্বরোচিত ও জঘন্য ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বপরিবারে এই পবিত্র স্থান দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল।ওই সময় ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের সাথে ছোটখাট সংঘর্ষ ও টেনশন চলছিল।পরিচিতজনরা বারণ করেছিলেন এই সময় না যাওয়ার জন্য কিন্তু মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে পরিবার নিয়ে Ansary international নামে একটি Tour group এর সাথে লন্ডন হিত্রো থেকে প্রথমে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পৌঁছালাম। পৌঁছতে কিছুটা দেরী এবং বিশেষ করে রাত হয়ে যাওয়াতে তেমন কিছুই আর দেখা হলো না। রাতের খাবার শেষ করে মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড একটা হোটেলে আমরা রাত কাটিয়ে দেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলতেই মনের মধ্যে একটা পুলক অনুভব করলাম, পাহাড় আর সমতলে ঘেরা আম্মান শহরের শ্বেত শুভ্র ঘরগুলোকে ছবির মতো মনে হচ্ছিল।

আল-আকসা মসজিদের সামনে লেখক।

 

সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা ভ্রমণ  দলের সবাই ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনে বেরুলাম। প্রথমে আমরা জর্ডানের আর্কিয়লজিকেল মিউজিয়াম দেখতে গেলাম, সেখানে পুরাতন সভ্যতার অনেক নিদর্শন এবং ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। তারপর আমরা রওয়না দিলাম আসহাবে কাহাফ দেখার উদ্দেশ্যে । সেখানে পৌঁছাতেই আমাদের জোহরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেলে আমরা গুহার পাশের মসজিদে নামাজ আদায় করে নিলাম। কোরআন শরিফে সুরা কাহাফের বর্ণনায় বলা হয়েছে কোনো এক সময় কয়েকজন ধর্মপ্রাণ লোক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল।তখনকার রাজা নিজেকে খোদা মনে করতো তাই এই ঘটনায় রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে ঐ লোকদের হত্যার জন্য সৈন্যদল পাঠায়। সৈন্যরা ওই ছয় জন লোককে ধাওয়া করলে তারা একটি কুকুরসহ ঐ গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে তখন মহান আল্লাহতালাতার অলৌকিক ক্ষমতাবলে ঐ ছয়জনকে ঘুম পাড়িয়ে দেন এবং কুকুরটিও গুহার মুখে পাহারারত অবস্হায় ঘুমিয়ে পড়ে। তিনশত নয় বৎসর পর তাদের ঘুম ভাংগে। ঘুম থেকে জেগে উঠে তারা মনে করেছিল একটু আগে ঘুমিয়েছিল তাই তারা খাবারের জন্য মুদ্রা নিয়ে বাজারে গেলে ঐ মুদ্রা দেখে লোকজন আশ্চর্য হয়ে যায় তারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করে ৩শ বৎসরের পুরানো মুদ্রা তারা কোথায় পেল। তখন তারা বিষয়টি বুঝতে পেরে গুহাতে ফিরে আসলে তারা সেখানেই মারা যায়। এদেরকে সবাই seven sleepers নামে ডাকা হয় বলে কথিত আছে।

আল্লাহতালা কিয়ামতের নিদর্শন হিসাবে এই জায়গাটি সংরক্ষিত করে রেখেছেন। গুহাতে এখানো তাদের হাড্ডি সংরক্ষিত আছে। গুহার ভিতর প্রবেশ করার পর স্থানীয় একজন খুব সুন্দর সুরা কাহাফ তিলাওয়াৎ করে ঘটনার সুন্দর বর্ননা দিলেন। গুহা দর্শন শেষ করে আমরা দুপুরের খাবার সারলাম। তারপর ডেডসি এর জর্ডানের অংশ একটু দূর থেকে দেখলাম। সময় কম থাকায় পানিতে নামা হলো না।

ইচ্ছে ছিল পুরাতন সভ্যতার নিদর্শন এর নগরী পেট্রা দেখার কিন্তু সময়ের অভাবে তা আর হয়ে উঠল না।তাই সন্ধ্যার পর আমরা জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ইসরায়িলি বর্ডারে অনেক জটিল ইমিগ্রেশন শেষ করে পবিত্র নগর জেরুজালেম এসে পৌঁছালাম। তিনটি বড় ধর্মের জন্য পবিত্র নগর এই জেরুজালেম এক পাশেই হুদিদের ইবাদতের স্হান Western Wall আরেক পাশে খৃস্টানদের Mount Olive , Bethlehem আর মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বায়তুল মুকাদ্দেছ, মাসজিদুল আল আকছা।প্রাচিন শৈল্প কার্য্য দিয়ে নির্মিত এই মসজিদ দেখলে প্রাণ জুডিয়ে যায়।জেরুজালেমের যেকোন জায়গা থেকে তাকালে পবিত্র আল- আকসার ডোম অবরক এর সোনালী অংশ চোখে পড়ে। শহরকে মনে হয় যেন  অপূর্ব কোন সুন্দরী রমনী গলায় স্বর্নের হার পরে আছে।

আমাদের Tour Leader ছিলেন মৌলানা আবু সাঈদ আনসারী। তিনি আমাদের অত্যন্ত সুন্দরভাবে মসজিদের ইতিহাস বর্ননা করলেন অসংখ্য নবী রাসুলদের নিদর্শন রয়েছে এই মসজিদে হযরত সুলাইমান( আ:), হযরত মুসা(আ:), হযরত ঈসা ( আ:), হযরত ইব্রাহিম (আ:), দাউদ (আ:)সহ অসংখ্য নবী রসুলদের পদধুলিতে এই পবিত্র মসজিদ ধন্য। এই জায়গা থেকেই আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ স: পবিত্র মেরাজে গমন করেছিলেন তার সকল চিহ্ন এখনো বিদ্যমান।এখনেই ১,২৪,০০০ পয়াগম্বরদের নিয়ে মেরাজের রাতে মহানবী (স:) নামাজ আদায় করেছিলেন। যে ছবি দেখে আমরা মসজিদুল আকছা মনে করতাম সেটা আসলে মুল মসজিদ নয় সেটাকে বলা হয় Dome of the Rock আর এর ভিতরের পাথরখন্ডের উপর দাঁড়িয়েই আমাদের মহা নবীজি ব্রাইল এর সাথে সাত আসমানে গমন করেছিলেন। মূল মসজিদটি তা থেকে আরো কয়েকশ গজ দূরে।সেই পাথর এখনো যেভাবে ছিল সেই অবস্হায় বিদ্যমান আছে।

আল-আকসাতে আমরা নামাজ আদায় করে মনটা পরিতৃপ্ত হল।তারপর বিশাল মসজিদ এলাকা ঘুরে ঘুরে ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ দেখতে লাগলাম।

সুলাইমান (আ:) আল্লাহর নিকট ৩টি দোয়া করেছিলেন তার মধ্যে ১টি ছিল যারা আল্ আকসা উদ্দেশ্য করে জিয়ারতে এসে সালাত আদায় করবে তাদের পূর্ববর্তি সকল গুনাহ মাফ হবে।মসজিদটি কবে নির্মিত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায়নি তবে রসুলুল্লাহ ( স:) হাদিস মোতাবেক কাবা ঘর নির্মিত হওয়ার ৪০ বৎসর পর তা নির্মিত হয়। দুইবার তা পূন: নির্মিত হয় একবার হযরত সুলাইমান (আ:) এর সময় এবং পরবর্তিতে সালাউদ্দিন আইঊবি যখন ক্রসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করেন।

জেরুজালেম এ রয়েছে বিভিন্ন নবী ও সাহাবীদের বহু নিদর্শন, আমরা গাইডসহ বিভিন্ন স্হান পরিদর্শনে বের হলাম পথিমধ্যে মাউন্টওলিভ এবং হযরত সালমান ফারসি (রা:) মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে হেবরনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। হেবরনের বেশিরভাগ অংশ ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রনে। আমরা ওখানে হযরত ইব্রাহিম (আ:) মাজার জিয়ারতে গেলে দেখলাম মসজিদের একাংশই হুদিদের অপরাংশ মুসলমানদের। জানতে পারলাম ১৯৬৯ সালে ইসরাইলি সেনারা আতর্কিত মসজিদে হামলা চালিয়ে প্রায় ২৬ জন মুসল্লিকে হত্যা করে তারপর তা দুইভাগে বিভক্ত করা হয়।পথিমধ্যে অনেক ফিলিস্তিনিকে ভিক্ষা করতে দেখলাম।যাদের একদিন ঘর বাড়ি সব ছিল আজ তারা সহায় সম্বলহীন। আর তাছাডা বিগত কয়েক সাপ্তাহ ধরে পরিস্হিতি খারাপ থাকায় তাদের ব্যাবসাবাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। তাই সবাই মিলে কিছু একটা শপিং করলাম তাদের একটা দোকানে। তারপর আমরা গেলাম খৃষ্টান অধ্যুষিত হযরত ঈসা (আ:) এর জন্মস্থান বেতলেহামে।  সুন্দর পরিপাটি এলাকা বেশীর ভাগ চার্চ এই এলাকাতে মুসলিম ও খৃস্টানদের মধ্যে একটা ভালো সম্প্রতি রয়েছে সেখানে “Jerusalem always be Palestine’s eternal capital” লেখা ব্যানার দেখা গেল ঐ এলাকাতে ।Xmas এবং new year থাকাতে অনেক বিদেশীরা Bethlehem এসেছেন তাই অনেক ভীড় ঠেলে আমরা চার্চ এর ভিতরে ঢুকতে ঘন্টাখানেক সময় লেগে গেল তারপর আমরা ঈসা (আ:) জন্মস্থান এর অনেক নিদর্শন দেখতে পেলাম। একটা কথা না বললেই নয় সাধারন মুসলিম, খৃষ্টান, এবং ইহুদিদের মধ্যে এক ধরনের সহাবস্থান স্পষ্ট।তবে মুসলমানদের এই আবাস ভূমিই হুদিরা যেহেতু জোরপূর্বক দখল করেছে তাই তাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের তীব্র ক্ষোভ বিদ্যমান রয়েছে।আর ইসরাইলি সৈন্যদের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সতর্ক অবস্হান সকলের মনে ভীতির সঞ্চার করে। সকালে পবিত্র আল আকছা মসজিদে গিয়ে উমরাহ করার ঊদ্দেশ্যে ইহরাম পরিধান করে পবিত্র মক্কা নগরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। পথি মধ্যে আমরা মুসা (আ:) এর মসজিদ এবং কবর জিয়ারত শেষে Jericho নামে প্যালেস্টাইন অধ্যুষিত একটি এলাকাতে যাই। সে জায়গার রাস্তায় এখনো বিগত কয়েকদিনের আন্দোলনের চিহ্ন বিদ্যমান, রাস্তার প্রবেশদ্বারে একটি বিরাট চাবী রাখা আছে, ফিলিশ্তিনিরা এখনো বিশ্বাস করে একদিন যে ঘর ফেলে চাবী নিয়ে এসেছিল। একদিন তারা অবশ্যই ফেরত যাবে, এভাবে ৭০ বৎসর পার হয়েছে তবুও তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি এখনো তারা চেয়ে আছে একদিন হয়ত সালাউদ্দিন আইইবির মত কেউ এসে দখলদারদের বিতাড়িত করে তাদের মাতৃভূমি তাদেরকে ফিরিয়ে দিবে। জেরিকোতে দপুরের খাবার শেষ করে ডেডসি বা মৃত সাগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ডেড সি নামকরনের কারণ হল এই সাগরে কোন প্রাণী বাস করতে পারে না এর সঠিক কারণ না জানা গেলেও মৌলানা আনসারী যিনি বহু ভাষায় দক্ষ এবং ইতিহাস সম্পর্কে যার ভালো ধারণা তিনি বললেন অনেকের ধারণা সমকামিতার কারনে আল্লাহলুত (আ:) আমলে সমস্ত জনপদকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আর ঐ সময় এই ডেডসি এর সৃষ্টি হয়েছিল।ডেড সি তে যাওয়ার পর দেখলাম সমুদ্রের পানি খুবই লবনাক্ত এবং ঐ পানিতে কোন কিছুই ডুবে না, অনেকে সি থেকে কাদা মাটিও লবন সংগ্রহ করলেন তাতে নাকি চর্ম রোগের উপশম হয়।ডেড সি থেকে সরাসরি ইসরাইলি বর্ডারে চলে আসলাম, আসার সময় যেভাবে ঝামেলা করে তারা বের হতে তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি।বর্ডার পার হয়ে যখন জর্ডানে চলে আসলাম মনের মধ্যে মিশ্র একটা অনুভুতি কাজ করতে লাগল, হাজারো নবী রসুলদের স্মৃতি বিজড়িত জেরুজালেম ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না আবার বায়তুল্লাহ তোয়াফ এর জন্য মন পড়ে আছে।আল আকছাতে গিয়ে মনে হয়েছে এখানে না আসলে জীবনে একটা অপূর্ণতা থেকে যেত মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আল্লাহ সেই সুযোগ আমাদেরকে দিয়েছেন।

ভ্রমণকালে আল আকসার সামনে লেখক।

 

আলহামদুলিল্লাহ পৃথিবীব্যাপী এত সতর্কতা সত্ত্বেও হাজার হাজার মুসল্লিরা আল আকছা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবী থেকে আসে।মুসলমানরা ইহুদীদের চোখ রাঙানিতে ভীত নয়। আল আকসা আমাদের; আমাদেরই থাকবে, রসুল (স:) বলেছেন জান্নাত দেখতে হলে আল আকসা দেখ।আমাদের ফিলিস্তিনি গাইড বললেন আমরা যখন আল আকসা জিয়ারতে আসি তখন তারা মনে সাহস পান। তাদের মনে হয়, তারা একা নন পৃথিবীর সকল মুসলিম তাদের সাথে আছেন।

আমার স্থির বিশ্বাস, একদিন জেরুজালেম মুক্ত হবে এবং ফিলিস্তিনিরা ফিরে পাবে তাদের আবাসভূমি। দখলদার ইহুদিদের কাছ থেকে আল- আকসা মুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ ।