Cinque Terre

কুমকুম আবির

১৯ এপ্রিল , ২০২০


উদ্যোক্তা


করোনার কাল : উদ্বিগ্ন সময়

দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে লক-ডাউন চলছে। সরকার নির্দিষ্ট নিয়ম করে দিয়েছে। গণমাধ্যম প্রতি মিনিটে সচেতন করছে। এদিকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। কিন্তু বাজারে কিংবা রাস্তায় মানুষের ঢল দেখে আমাদের সমূহ বিপদের কথা ভেবে দিশেহারা না হয়ে উপায় কী। গত শনিবারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জানাজায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত বলে দেয়, এদেশের মানুষ এখনো সচেতন হননি। তাই সঙ্গত কারণেই বৈশ্বিক মহামারীর করোনার যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে ভবিষ্যৎ ভেবে আতঁকে উঠতে হয়।  

গোটা বিশ্বের তুলনায় আমরা কিছুটা হলেও ভালো আছি, এখন আর এটি বলা যাচ্ছে না। মানসিক স্বস্তির জন্য সান্ত¦না হতে পারে। কিন্তু তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে যে ভয়াবহতা হতে পারে, তা ভাবলে শিউরে ওঠার কথা। 

 সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, মানুষের অসচেতনতা। সরকারের নিষেধ সত্তে¡ও বাইরে এখনও ভীড় হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব রাখা যে কত জরুরি তা সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে পারছেন না। শিক্ষিত লোকরাও বলছেন, কিছুই হবে না। এর চেয়ে বড় বোকামী আর কি আছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ডালপালা মেলছে। এইসব রোধ করতে না পারায় আমরাই মহামারীকে ডেকে আনছি। আমরা সরকারকে যতই দোষারোপ  করি না কেনো, সরকার ক্ষমতার বাইরে কিছ্ইু করতে পারবে না। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা নিশ্চয় জানেন করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ার পর জীবন কত মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন হলো, তা হলে আমাদের কী করতে হবে? মূলত এখন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই সবচেয়ে উত্তম বলে মনে করি। যাকে বলে ব্যক্তিগত সন্তুষ্ঠি। এজন্য প্রথমেই ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। একান্ত জরুরি না হলে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। ভাবনা হচ্ছে, যারা দিন আনেন দিন খান তাদেরকে নিয়ে। ইউরোপ-আমেরিকা বা এশিয়ার ধনী দেশের নাগরিকরা ঘরে বসে থাকলেও অন্তত এক-দুইমাস পেটের চিন্তা না করলেও চলবে। বিশেষ করে তাদের সরকারের পক্ষে সে ব্যবস্থা রাখা কঠিন কিছুও নয়। বিপত্তি হচ্ছে, বাংলাদেশে সরকার বললেও সেটি নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়। এই সহজ না হওয়ার পেছনের কারণ হলো সুষ্ঠু অব্যবস্থাপনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে আগামী অন্তত দুই সপ্তাহ সকল মানুষকে ঘরে রাখতেই হবে। সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ও চিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। অনিয়ম আর চুরি বন্ধ করতে হবে কঠিন হাতে।

তবে শেষ পর্যন্ত এটি নিশ্চিত করতে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। জনপ্রতিনিধি, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন বাহিনীকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যদিও আমরা দেখেছি এ পর্যন্ত তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চিকিৎসা সেবায় যারা নিয়োজিত, এখন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

জনপ্রতিনিধিরা জানেন তাদের কোন ভোটার কেমন আছেন, কেমন থাকতে পারেন। এবার তাদের সুযোগ এসেছে, মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার, সেবা করার, কথা রক্ষা করার। 

কাজটি খুব কঠিন নয়, যদি আন্তরিকতা থাকে। প্রশাসনের উচিত নির্দিষ্ট সহায়তার জন্য নির্দিষ্ট মুঠোফোন নম্বর সবাইকে জানিয়ে দেওয়া, যেনো কেউ অভুক্ত না থাকেন। কাজটি করতে হবে নিবিড় তত্ত¡াবধানে। প্রতিটি এলাকাকে ইউনিট হিসেবে ভাগ করে নিলে, কেউ উপোস থাকার কথা নয়। 

ওষুধ, চাল, ডাল ও সবজির সরবরাহ সীমিত হলেও ক্রয়-বিক্রয় অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক বন্দোবস্ত রাখা বাঞ্ছনীয়। সে সকল স্বেচ্ছাসেবীরা মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করছেন, তাদের সহযোগিতার জন্য প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠনকে  এগিয়ে আসতে হবে। তবে এখন বড় প্রয়োজন দৈনন্দিন খাবার। তাই কথা হচ্ছে, যে যা পারেন, সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।

এই দুঃসময়ে চিকিৎসক-নার্স ও চিকিৎসাকাজে নিয়োজিত যারা আছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার সর্বাগ্রে। তাদের পিপিইসহ যাবতীয় সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ রাখতে হবে পর্যাপ্ত পরিমানে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা অত্যাবশ্যক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এরই মধ্যে আমাদেও অন্তত তিনজন ডাক্তার চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। চিকিৎসেবায় যারা নিয়োজিত তাদের অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।   

গণমাধ্যমের সংবাদে আমরা দেখেছি,  অনেক হাসপাতালে করোনারোগীদের জন্য তৈরি করলেও আইসোলেশনে রাখার মতো পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এখনো দেশের সবগুলো জেলা শহরে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়টি মানুষকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে রেখেছে।

এবার আসা যাকÑএকান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে। প্রথমেই বলেছি সরকারের একার পক্ষে এই মরণঘাতী মহামারি রোধ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় উপায়। চাকুরিজীবী স্বামী-স্ত্রী কাজে চলে যাওয়ার পর গৃহকর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কেউ কেউ এ সময়ে কাজের লোক ছাড়েননি। এখন ছুটি চলছে। তাই তাদের উচিত গৃহকর্মীর অগ্রিম টাকা দিয়ে তাদেরকেও ছুটি দেওয়া। কিন্তু সামান্য হাতের কাজ করতে হবে বলে, কাজের লোককে ছাড়ছেন অনেক গৃহকর্তী। এতে ঝুঁকিটা থেকেই গেলো। আবার টেলিভিশনে অনেক গৃহকর্মীকে বলতে শুনলাম, পরে টাকা দেবেন বলে অনেকেই দেশের বাড়ি চলে গেছেন। বিষয়টি অবিবেচকসুলভ। 

গত ১৭ মার্চ থেকে মূলত দেশের মানুষের আতঙ্কের পারদ বাড়তে থাকে। ওইদিন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। দেরিতে হলেও বিষয়টি ইতিবাচক ছিল। কিন্তু পরে, সরকারি ছুটি ও গণপরিবহণ বন্ধের বিষয়টি তালগোল পাকানো হয়েছে। এতে বহু মানুষের মধ্যে করানোভাইরাসের ঝুঁকি থেকেই গেলো। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল বিদেশিদের আলাদা করতে না পারা। বিদেশিদের হোম কোয়ারেন্টিনে যখন যেতে বলেছি, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া এ কাজটিও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন যথাযথভাবে করতে পারেনি। এর মাশুল হয়ত দিতে হতে পারে। তবু আশা করছি, কঠোর পরিশ্রম আর কঠোর নিয়মের মাধ্যমে সেটি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

করোনাভাইরাসের এই পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক বের হয়নি। একমাত্র উপায় ঘরে থাকা। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় পরিজন থেকে দূরে থাকলেও পরিবারের মানুষকে কাছে পাচ্ছি। বিশেষ করে সন্তানদের। তাই এই সময়ে বড় একটি কাজ হচ্ছেÑসন্তানদের সময় দেওয়া, পরিবারকে সময় দেওয়া। মনে রাখতে হবে, ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সাহস রাখতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। কারণ ঘরে থাকা, সচেতন হওয়া আর সরকারি নির্দেশ পালনই এখন একমাত্র পথ।