Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

০৭ জুন , ২০২১


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


শিক্ষাব্যবস্থা : দুর্যোগে-দুর্গমে

দেও-দানবের  ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে  গোখরা সাপের  মতো কোভিড়-১৯ বার বার ছোবল মারছে মানব জাতির ব্রহ্মতালুতে। তার ভয়াবহতায় দিক হারা সবাই; দাপুটে শক্তিধর রাষ্ট্রের অর্থ-বিত্তের রস পড়ছে চোয়ে-চোয়ে। স্থবির পৃথিবী। এমন দশা বিগত সোয়াশ বছরে হয়নি। স্প্যানিশ ফ্লু, প্লেগ প্রভৃতি সভ্যতাকে ক্ষত-বিক্ষত করলেও বিশ্বায়নের যুগের করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা ভিন্নমাত্রায় চিন্তার অবকাশ রয়েছে। ইতোমধ্যে তাবৎ দুনিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধঅর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নানা উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরাও আমাদের শিক্ষা, ব্যবসা, প্রবাসী আয় ইত্যাদি ধরে রাখার অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রায় বছর দিনের মাথার প্রতিরোধক টিকার আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু যোগ-বিয়োগের অংক যেন তাড়াতাড়ি মিলছে না। তবে প্রত্যাশা, অসংখ্য লোকক্ষয়ের পরও করোনা মানুষের কাছে পরাজয় বরণ করবেই। দেখতে দেখতে চীন থেকে উৎপত্তি হয়ে এই ক্ষিপ্র গতির ভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকা পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাকে প্রতিরোধের জন্য আমাদের প্রস্তুতিও কম ছিল না। বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের সরকার সুচিন্তিতভাবে  ১৬ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন। পরে শিক্ষার্থীদের সুস্থ রাখা ও জীবন রক্ষার জন্য সংগত কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ছে। কখন যে এই নীরব মানব ধ্বংশলীলা শেষ হবে তা বলাও মুশকিল। এরুপ পরিস্থিতিতে ‘শিক্ষা’য় অর্জিত গতি ধরে রাখা ও শিক্ষার্থীর বিকাশের পথ খোঁজা একান্ত জরুরি বিষয়। বড়ধরণের বিপর্যয়কালীন সময়ের শিক্ষা ব্যববস্থা সচল রাখা ও ছাত্রদের বইমুখি করার প্রক্রিয়াকে ‘আপদকালীন শিক্ষা’ বলা যেতে পারে। এই শিক্ষার ধরণ এবং  বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিক সময়ের মতো হবে না। শিক্ষার্থীদের সুস্থ রাখা ও শিক্ষার কৌশল সমান্তরালবর্তী হলে ভালো হয়। একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ও নানা উপায়ে স্থবির সময়ে জন্য শিক্ষার চাকা সচল রাখা যেতে পারে।

যে কোনো রাষ্ট্র বা ভূখণ্ড প্রকৃতি বা মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়লে শিক্ষার ক্ষয়-ক্ষতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই ধরনের বিপর্যয় স্বল্পকালীন, মধ্যম সময়ের জন্য; অথবা দীর্ঘ মেয়াদিও  হতে পারে। যেমন বন্যা ও পরবর্তী অবস্থা, জলোচ্ছ্বাস কিংবা ভূমিকম্পের বিপর্যয় ভিন্ন ধরণের। অন্যদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ বা আন্তঃদেশীয় কলহের ধরণ লণ্ডভণ্ড শিক্ষা ব্যবস্থা আলাদা প্রকৃতির। বর্তমান  কোবিড-১৯-র একেবারে আলাদা। সে কার শরীরে লুকিয়ে থাকে বুঝার উপায় নেই; আবার দ্রুত ছড়ায়। এটা এখন দীর্ঘ মেয়াদি বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। বিপর্যয় দীর্ঘ মেয়াদি হলে শিক্ষার্থী বা প্রজন্মের ভবিষ্যত অনেকটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। শিক্ষার জীবন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের শিখনের মাত্রাও কমে যায়। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হাতে-কলমে বা বাস্তব শিক্ষা যেমন হয় না; তেমনি মিথষ্ক্রিয়াও সৃষ্টি হয় না। অভিজ্ঞতার ভাড়াল থাকে অপূর্ণ। শিশু/ শিক্ষার্থীগণ একটি জায়গায় বেশিদিন আটকা/আবদ্ধ থাকলে অথবা চলা ফেরা না করলে তাদের মানসিক, শারীরিক ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতায় স্থবিরতা চলে আসে। শিশুদের নৈমিত্তক রুটিন দীর্ঘমেয়াদি বন্ধ বা ব্যহত থাকলে পড়ালেখায় তারা মন বসাতে পারে না। ্এমতাবস্থায় বিশেষত শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায় কাঁধে নিয়ে ও আন্তরিক হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা একান্ত দরকার। তাদের নানা পরামর্শ দেওয়া যায়। ডিপ্রেশন/মনোবৈকল্য যাতে না হয় সে জন্য কনসাল করা আবশ্যক।  কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম অনেক শিশুর ওজন বাড়ছে, ঘুম বাড়ছে এবং মোবাইল আসক্তি আরো বেড়েছে।  আমাদের মতো দেশে বাসা/বাড়িতে শিশুবান্ধব পরিবেশ ও আনন্দ দেওয়া অনেক কঠিন। ফলে তারা নিজেদের মতো করে বয়স ভেদে আনন্দ খোঁজে। আমার পাশের ঝুঁপড়ির অষ্টম শ্রেণিতে ওঠা মেয়েটা বিয়ে করেছে স্ব-ইচ্ছেতে। অভিভাবকের সায় ছিল। তারা দীর্ঘ দিন ধরে বই খুলছে না। আয় কমে যাওয়ায় অনেক শিশুরা কাজে যাচ্ছে। ফলে আমাদের অনেক ভাবতে হবে। শিশু/শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ রক্ষার পথ বের করতে হবে। আমরা দুটো বিষয় চাইবোÑপ্রথমত শিশু/শিক্ষার্থরা যেন নিরাপদ থাকে; দ্বিতীয়ত তার পড়াশুনা যেন সচল রাখে বা পাঠ্যবইয়ের সাথে সম্পর্ক থাকে। শিক্ষক/ সচেতন সমাজহিতৈষীরা আন্তরিক হলে তথ্য প্রযুক্তির যুগে এগুলো অবশ্যই সম্ভব। তবে শতভাগ আশা করা যায় না। স্থান ভেদে ভিন্নতা থাকলেও কোনো না কোনোভাবে শিশুদের সঙ্গে অন্তত পনের দিন বা মাসে-দুই মাসে একবার যোগযোগ রক্ষা করা যায়। স্কুলে রয়েছে ছাত্র বিগ্রেড, অভিভাবক সমিতি, ম্যানেজিং কমিটি। আবার প্রায় এলাকায় রয়েছেন সমাজহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষানুরাগী এবং ক্রীড়া, সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্লাব। এই সকল কমিটি কিংবা সংস্থার লোকজনের মাধ্যমে শিশুদের সাথে ব্যক্তিগত খবর ও পড়াশোনার খোঁজ রাখা গেলে শিশুরা চাঙা হবে। তার মানস সংগঠন শক্তিশালী হবে এবং বুঝবে যে প্রতিষ্ঠান তাঁকে ভালোভাসে। যোগাযোগ ভিন্নভাবে  হতে পারেÑ যেমন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, কমিউনিটি রেডিওর ‘শিক্ষা প্রোগ্রাম’শিশুর মতো করে চালু করা  ইত্যাদি। অভিজ্ঞতায় বলছে যে ‘সিসিমপুর’, মিনা’ কার্টুন শিশু শিক্ষা ও সচেতনতায় কার্যকর  অবদান রেখেছিল। ইকরি, হালুম, মিনা ইত্যাদি চরিত্র তারা ভুলেনি। মোবাইল অ্যাপে এধরনের কাহিনি তৈরি করা যায় না? বর্তমানে সকল স্কুলে শিশু/শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের মোবাইল নাম্বার রয়েছে। স্কুলের শিক্ষক ও বিভিন্ন কমিটির সদস্যরা  মোবাইল নম্বর ভাগাভাগি করে এলাকাভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে পারেন। অনেক স্কুলের ফেইসবুক পেইজ রয়েছে। আমার পরিবারে দুইজন হাইস্কুলের শিক্ষার্থী রয়েছে। দেখলাম দীর্ঘদিন তাদের স্কুল থেকে যোগাযোগ করা হয়নি। অনেক পরে একজনের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এইচ এস সি শিক্ষর্থীদের কাজ দেওয়া উপেক্ষিত থাকে। তখন দেখেছি অভিভাবকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওয়ার্কশিট সংগ্রহ করতে। শিক্ষকরা নানা মিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নানা উপদেশ দিতে পারেন। এসএমএস পাঠানো এখন কঠিন ব্যাপার নয়। ‘আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠান’এর মতো  এখন ‘ঘরে  থেকে  পড়ি বেশি’ জাতীয় আকর্ষণীয় শ্লোগান তৈরি করা যায় না? অনেক এনজিওদের সহায়তা নেওয়া যায়। যেমন ক্ষুদ্র ঋণের কর্মীরা তাদের সেন্টারে যায়। কিছুকিছু টিকা সেন্টার চালু আছে। এই কর্মীদের মাধ্যমে শিক্ষার ম্যাসেজ দেওয়ার পথ আছে। গরীর/ প্রান্তিক সমাজের সাথে বা দুর্গম এলাকায় তারা যোগাযোগ করতে পারেন। গ্রামেও এখন অধিকাংশ শিশু পড়ার সময় কমিয়ে গেইম খেলছে। কম সংখ্যক অভিভাবকই গৃহ শিক্ষক রাখছেন। কিছু শিক্ষক এখন আবার ব্যাচে পড়ানো শুরু করেছেন। ওই শিক্ষকদের একাংশ আবার আত্মকেন্দ্রিক হয়। ‘নিজের বুঝ ষোল আনা বুঝেঅন্যের সমালোচনা করে; কিন্তু ক্লাসে ঝিমায় অনেক। একটি স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়  উদ্যোগ নিলে অন্তত ৮৫% শিশুর সাথে পরোক্ষ যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব। ছাত্র বেশি হলে এসএমএস দিয়ে যোগাযোগ করা কঠিন নয়। বিশেষত হাওর, চর, চা-বাগান, পাহাড়ি এলাকায় কমিউনিটি সর্দার/ পেশাজীবী সংগঠন/অভিভাবকদের কাজে লাগানো যায়। আপদকালে সবচেয়ে অসচেতন পরিবারের শিশুরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে বেশি। কারণ সে পরিবারের শিশুরা অনেক কিছু ভুলে যাবে। ওদের দেখিয়ে দেওয়ার/ সহায়তা করার লোক নেই। আমাদের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা বর্ণমালা শব্দ পঠন লিখন সহজে ভুলে যায়।  

কর্মচঞ্চল শিশুর গতি ঠিক রাখতে অনলাইনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দরকারযেমন কবিতা আবৃত্তি গান করা, অভিনয় দেখানো ইত্যাদি। ফলে মনোবৈকল্য কমবে। আবার অবস্থাভেদে গল্প লেখা, কবিতা/ ছড়া বা বিজ্ঞানের কিছু লিখতে দিয়ে প্রতিযোগিতা  করা কঠিন নয়। তাহলে শিশুদের  সুকুমারবৃত্তির চর্চা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে হয়তো  ৫০ ভাগ পরিবার বা তারও কম সাড়া পাওয়া গেলে ক্ষতি কী? সরকার ‘আপদকালীন শিক্ষা ফান্ড’ করতে পারেন। তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং মনিটরিং থাকলে উপকার বেশি হবে। মাঝে মধ্যে শিশুদের/শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষকরা দল করে, ভাগাভাগি করে শিশু/শিক্ষার্থীদের কথা শোনাতে পারেন। হাজার-হাজার ছাত্রের বেলা এসএমএস ছাড়া অবশ্য গতি নাই। মূল কথা হলো শিশু/শিক্ষার্থীর সাথে একটু যোগাযোগ রাখাÑ উপদেশ দেওয়া। গ্রামাঞ্চলের শিশুদের হয়তো দৌড়াদৌড়ি করার  খোলা জায়গা থাকে কিন্তু  শহরের গৃহবন্দি শিশুরা আরো আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। শিশুদের অনলাইনে বলা যায় যে তারা যেন কাগজ/পাতা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে শেখে। যেমনঘড়ি, চশমা, ফুল, ফল ইত্যাদি। শিশুদের শিশুতোষ ম্যাগাজিন, বই পড়তে উৎসাহিত করার সুয়োগ আছে। এও বলা যে, যার যার বাস্তবতায় গাছের চারা রোপন, অভিভাবকদের সাথে ছাদকৃষি করা বা গাছে পানি দেওয়ার কাজে সাহায্য করতে ইত্যাদি। ২০২০ সালে কড়া লক ডাউনের পরপর অর্থাৎ আগস্ট-সপ্টেম্বর মাসে কয়েকটি শিশু সংগঠন মৌলভীবাজার জেলা শহরে এরূপ কার্যক্রম হাতে নিয়ে অনেক সুফল পেয়েছে। অভিভাবকরা তাদের সাহায্যও করেছে। গত ২০ সালের শেষ দিকে স্কুলগুলো শিশুদের অ্যানাইনমেন্ট দিয়ে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। অধিকাংশ অভিভাবক চায় তার শিশু /শিক্ষার্থী যেন বই, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে।

আমাদের অভিজ্ঞতা: আমাদের প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি এই অস্বাভাবিক সময়ে ফিল্ড পর্যায়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বারবার অনলাইন ভিত্তিক মিটিং করে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস নিতে শুরুতে প্রাণিত করেছেন। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি [নেপ, ময়মনসিংহ] করোনাকালীন সময় ৩৫,০০০ হাজার ডিপি এড প্রশিক্ষণার্থীর লেখা পড়া চালু রাখার জন্য ২১ এপ্রিল ২০২০ সালে কার্যক্রম গ্রহণ করে ক্লাসের গাইড লাইন তৈরি করে। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নেপ কর্তৃপক্ষ ৬৭ টি পিটি আই-এ একযোগে ‘ঘরে বসে ডিপি এড অনুশীলন কার্যক্রম’ পরিচালনার নিমিত্তে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস নেওয়ার জন্য ১০ মে ২০২০ সালে আদেশ জারি করেন [স্মারক নম্বর: ৩৮.৪১৮.০০০০.২০১০.১২৫৩] । অনলাইনে আপদকালীন ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা নতুন করে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে প্রস্তুতি নিতে থাকি। অনলাইনে কিংবা মোবাইলের নানা অ্যাপে অনেকেই অদক্ষ ছিলাম। নিশ্চয় আমার মতো আরো আছেন। কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল আমরা অনেকটা দক্ষ হয়ে ওঠেছি। ক্রমে ভিডিও/ পাওয়ার পয়েন্ট প্রজেন্টেশন, অনলাইনে বই খুলে পড়ানো , কাজ দেওয়া ও আদায় এবং গ্রæপ ওয়ার্ক করা সবই হচ্ছে। এক সময় ভয় কেটে যায়। আমাদের প্রায় ২০৪ জন প্রশিক্ষণার্থীকে  চারটি  সেকশনে ভাগ করে নিয়মিত রুটিন মোতাবেক ক্লাস নিয়েছি। ক্লাসে মূলত সারাংশ আলোচনা ও ঘরে বসে লেখার কাজ বেশি দিয়েছি। প্রশ্নোত্তর, আলোচনা এবং অভিজ্ঞতা পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে। এভাবে কর্তৃপক্ষের দৃঢ়তা ও উৎসাহে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ, বিষয়ভিত্তিক অ্যাসাইমেন্ট প্রদান ও গ্রহণ এবং সংশোধন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ইমো, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস্অ্যাপ, ইমেইল ব্যবহার করেছে। আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চল, চা-বাগান, পাহাড়টিলা এবং হাওরাঞ্চলে বসবাসরত প্রশিক্ষণার্থীরা সবচেয়ে বেশি নেট সমস্যায় ভুগেছে। কেউবা নেটের জন্য প্রতিদিন দূরের সুবিধাজনক জায়গায় চলে গেছে। কেউ উঠেছে গাছে, কেউ গেছে টিলার ওপর। তবুও ক্লাস করা চাই। শিক্ষার্থীরা যখন ক্লাসের গুরুত্ব অনুভব করবে এবং বুঝবে যে সে পিছিয়ে পড়বে তখন কোনো না কোনোভাবে ক্লাসে যোগদান করতে চাইবে। অথবা যোগাযোগ করবেই। সেই শিক্ষার্থীদের কষ্টের ভিডিও আমরা দেখেছি। তখন বুঝতে পেরেছি  থেমে থাকা মানুষের স্বভাব নয়। তাকে চলার পথ দিতে হয়। অনলাইনক্লাসে অজিত কুমার পাল [হাতিয়াবাগ চা-বাগান, জুড়ি উপজেলা] নামে এজকন প্রশিক্ষণার্থী-শিক্ষক প্রতিদিন গাছে চড়তে দেখেছি। পরে  খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে দুর্গম অঞ্চলে থাকে, তাই নেট সমস্যা। এই এলাকায় পরে আমি ঘুরে সেই বাস্তবতা অনুভব করেছি। এভাবে চা বাগানের সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলের দুর্গামণি বুনারজি [চাম্পারায় চা-বাগান, কমলগঞ্জ], সীমা তাঁতীর [উদনাছড়া চা-বাগান, শ্রীমঙ্গল] আগ্রহের কাছে সব প্রতিকূলতা হার মেনেছে। দুর্গামণি অনেক দূর হেঁটে গিয়ে চা-বাগান ফ্যাক্টরির কাছে বসতো। সীমা তাঁতিকে পাহাড়ে দেখে একবার বর্ডার গার্ড চ্যালেঞ্জ করে বসে। পরে আমাদের এক সহকর্মীকে তাঁরা মোবাইল করে নিশ্চিত হয় যে, সে নেট পাওয়ার জন্য ক্লাস করতে সীমান্তে টিলায় যায়। অথচ এই তিনজন চা-বাগান পরিচালিত স্কুলের শিক্ষক (দুইজন বেসরকারি)। আমার মনে হলো আমাদের প্রাথমিক স্কুল, কিন্ডারগার্ডেন স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় আরো দ্রæততার সাথে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নানামুখি কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারেন। অনেক জায়গায় দায়সারা কাজও হচ্ছে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এসএসসি পরীক্ষর্থী কিংবা এইচ এসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সাথে স্কুল কর্তৃপক্ষের/শিক্ষকের যোগাযোগ রাখা খুব জরুরি বলে মনে করছি। আমার ঘরের যে ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষা দেবেতার স্কুল কর্তৃপক্ষ [শিক্ষকগণ] কোনো দিন খোঁজ খবর নেয়নি। একজন শিক্ষককে যোগাযোগ না করার কারণ জিজ্ঞাস করলে একপাহাড় অজুহাত দিলেন। কিন্তু পাহাড়কে কীভাবে অতিক্রম করতে হবে তার ইংগিত বলেননি। দু’চার জনকে জানি যে ছোটখাটো ভাগা নিয়ে  ঠিকই বাসায় পড়াচ্ছেন। যদিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেতন  দেওয়া ও ফরম নেওয়ার জন্য ফেইনবুক গ্রুপে/ এসএম এসে বার্তা পাঠিয়েছেন। কিন্তু অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে বড় দেরিতে। আমরা মনে করি শিক্ষকতা পেশায় দায়িত্ব অনেক। আপদকালীন সময়ের শিক্ষার মৌলবিষয়গুলো কীভাবে, কতটুকু, কখন, কী মাধ্যমেম দেওয়া সমম্ভÑ তা নিয়ে সমন্বিত চিন্তার অবকাশ রয়েছে।

এখন মনে হচ্ছে সর্বস্তরের শিক্ষকদের নতুন করে আপদকালীন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, প্রদান কৌশল সহ শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনলাইনে সেমিনার/ আলোচনা/ প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। এখন একটা চেলেঞ্জিং টাইমঅদৃশ্য যুদ্ধের মতো; তবে বিজয় অর্জন করা চাই, চাই-ই। আমরা যেন নিজের বিবেক ও জাতির কাছে জবাবদিহিতা বাড়াই। মনে রাখতে হবে ঘরে বসেও শিক্ষার কাজ চালানো যায়। এই বিপদকাল একদিন শেষ হবে। কিন্তু যদি রেখে যায় অনুর্বর একটা প্রজন্ম ; তবে তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে। আমরা আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন প্রায় ৪০০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে নিয়ে নিয়মিত ক্লাস করছি। উপস্থিতিও আশানুরূপ। এই কঠিন কাজ বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান সবাইকে নিয়ে টিমওয়ার্কের মতো পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অর্গানগুলো থাকবে মনিটরিংয়ের দায়িত্বে। আপদকালীন শিক্ষায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার অর্জন ধরে রাখা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা ঝরে পড়ার হার, বাল্য বিবাহ বাড়বে। প্রচুর শিশু বর্ণ পরিচয় সাবলীল পঠন ভুলে যাবে। আসুন এই সংকটকালে সবাই মিলে শিশু/শিক্ষার্থী/ দেশের জন্য কাজ করি।