Cinque Terre

পার্থ প্রতিম নাথ

১০ জুন , ২০২১



চিকিৎসক সাবিরার মৃত্যু ও রূঢ় বাস্তবতা

খবর : ৩১ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, রাজধানী ঢাকার কলাবাগানের নিজ বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানের (৪৭) ক্ষত-বিক্ষত লাশ।

হত্যাকাণ্ড : কাজী সাবিরা রহমানের মৃত শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এমন আঘাত নিজ হাতে করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে পুলিশ। অনুমান করা হচ্ছে এটা হত্যাকাণ্ড।

প্রিয়জন মারা গেলে প্রাণীকূল কী করে?

শোক করে। শোকের মাতম প্রিয়জনের স্বজনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে লোকালয়ে, পাহাড়, সমুদ্র-মহাসাগরে, আকাশে-বাতাসে। মৃত্যুকালে বৃষ্টি হলে অনেকে মনে করে, মৃত্যুশোকে প্রকৃতিও মূহ্যমান। শহরাঞ্চলে প্রায়শ বৈদ্যুতিক তারে শক্ লেগে মরে যায় কোন কাক। কাকের মৃত্যুতে আশেপাশে থাকা সকল কাক জড় হয়ে কা কা রবে শোকের বন্যা ভাসিয়ে দেয়। অন্তত ঘন্টাখানেক হলেও চলে এ রোদন। প্রিয়জনের আসন্ন মৃত্যুকে প্রতিহত করার জন্যে, মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে লড়ে যায় অবলা পাখি। বাঁচাতে না পেরে কাঁদে। অবুঝ পশু গরুর চোখ থেকেও পানি ঝরে বাছুর হারানোর বেদনায়।

মানুষের প্রিয়জন হারানোর কথা। সে তো বলাই বাহুল্য। মানুষ শুধু শোক করে না। শোকের মূর্ছনার মাঝেও প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ খোঁজে। কীভাবে মরল, কেন মরল? উত্তর খোঁজে। স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ করে। আল্লাহ! তুমি আমার একি করলে? আর হত্যাকাণ্ড হলে, হত্যাকারীকে মারতে যায়। প্রতিশোধ নিতে চায়। দায়ী ব্যক্তি বা পশুর জীবন কেড়ে নিতে চায়। ভদ্রলোক, রাষ্ট্রের কাছে বিচার চায়। শোকের মাঝেই আদর করে প্রিয়জনের লাশের সৎকার করে। সবকিছুর পাশাপাশি, চলে যাওয়া ব্যক্তি কী পরিমাণ সম্পদ রেখে গেল তা খোঁজ করে। পরিষ্কার ভাষায় ছেলে মেয়েই বলবে, দুঃখ করে লাভ নেই। বিলাপ করবে, কি সুন্দর গলাটা খালি করে মা, যাচ্ছ মাটির ঘরে ,আর সোনার চেনটা ব্যাগে পুরবে মেয়ে। ছেলের বউ এগিয়ে এসে হুংকার দিবে, এ চেন আমাদের। আমার শাশুড়ির শেষ স্মৃতি চিহ্ন। যাক্ এসব কথা বাদ দিই। মানুষের কাণ্ড কারখানা প্রাণীক‚লের সবার থেকে আলাদা। পশুর চেয়েও অধম, সরি অধমোত্তম।

কাজী সাবিরা রহমানের হত্যাকাণ্ডর বিচার চাওয়ার কেউ নেই!

পুলিশ বলছে, সাবিরার পরিবার, সাবিরা হত্যাকাণ্ডের মামলার বাদী হতে রাজি হচ্ছে না। কী লাভ হল সাবিরার মানব পরিবারে জন্ম নিয়ে? কাক হলেই হয়তো ভাল হতো। রমনার কোলে একদিন মরে পড়ে থাকত। স্বজন কাকেরা অন্তত কিছুক্ষণ কা কা রোদন করত। সাবিরার স্বামী শামসুদ্দীন আজাদ রাজি হচ্ছেন না মামলার বাদী হতে। তার ডায়াবেটিসসহ শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা। সাবিরার মামাও রাজি নন বাদী হতে। কারণ তিনি ঢাকার বাইরে থাকেন, ব্যবসা আছে, ব্যস্ত। সাবিরার একমাত্র ছেলে তাজোয়ার, সে প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু সাবিরার মা নাতিকে মামলার বাদী হতে দিচ্ছেন না। কারণ, আর কয়দিন পরেই ঐ ছেলে কানাডায় যাবে ,পড়াশোনা করতে। মানুষের মত মানুষ হতে, বিদ্বান হতে যে ছেলে বিদেশ যাবে সে ছেলের হাতে সময় কই, মাতৃহত্যার বিচার চাবে।

কোথাও কেউ নেই।

মায়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার পর শুরু যাত্রা। গন্তব্যহীন অনন্ত যাত্রা। এ যাত্রায় কত মানুষ সঙ্গী হয়। মা-বাবা,ভাই-বোন, স্বামী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, শত্রু-মিত্র। কিন্তু শেষ যাত্রায় কোথাও কেউ নেই। মৃত্যু ছাড়া সকল যাত্রাই ব্যক্তির সম্মতিতে হয়।

রূঢ় বাস্তবতার কথা বললাম। সভ্য সমাজে দীর্ঘকাল হতে মানুষ মৃত্যুর এই রুদ্র রূপকে কমনীয় করতে চেয়েছে লাশের উপরে গোলাপ জল ছিটিয়ে। দেহ হতে ছিন্ন হওয়া আত্মার প্রশান্তির জন্য করেছে প্রার্থনা, ক্রন্দন, বিলাপ, হাল আমলে ফেসবুক স্ট্যাটাস। যাকে হত্যা করা হয়েছে, তার জন্য হত্যাকারীর বিচার করেছে সমাজ। আর এক্ষেত্রে পরিবারই নিয়েছে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু সাবিরার বেলায় কেন এমন হচ্ছে? সাবিরার খুনি কে তা জানতে চায় না তার পরিবার। সাবিরার পরিবারের এই আচরণকে স্বাভাবিক বলার উপায় আছে? জীবিত সাবিরার সঙ্গে তার পরিবারের মনোমালিন্য থাকতেই পারে। সে কারণে সাবিরা আলাদা থাকতেই পারেন।  শুধু এই কারণে তার জন্মদাত্রী মা, পেটের সন্তান, কেউই তার নয়। তাহলে সাবিরা কি এ পৃথিবীতেই আসেননি? সবকিছুই ভ্রম ! এই জন্ম-মৃত্যু। নাকি পাল্টে যাচ্ছে মানব আচরণ। আচরণের এই বিকৃতি কি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর্যায়ে পড়ে না? জীবিত সাবিরার কোথাও কেউ ছিল না, মৃত সাবিরারও কোথাও কেউ নেই।

মৃত সাবিরা যা বললেন ও শুনলেন :

অনেকেই বলেন, অপঘাতে মরলে তার আত্মা নাকি পরলোকে যেতে পারে না। হিন্দি সিনেমা ‘ভূতনাথ’। অপঘাতে মৃত ভুতনাথ এর অতৃপ্ত আত্মা কোথাও যেতে পারেনি। বাড়ির চারপাশে ঘুরেছে। তেমনি সাবিরার আত্মাও তার ফ্ল্যাটের চারপাশে ঘুরছে। পরিজনের এসব কাণ্ড কারখানা দেখে সাবিরা ভাবলেন, যাই, মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করি। রাতে ঢুকলেন মায়ের রুমে। বিছানার পাশে বসে জাগালেন মাকে। মা আর মেয়ে মুখোমুখি। সাবিরা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, কেন আমার এই অবস্থা? কেন আমাকে কেউ সময় দিচ্ছে না? মায়ের নির্লিপ্ত মুখ খসখসে গলায় আওয়াজ করল, জীবিত থাকতে তুমি সময় দিয়েছিলে? যুগ পাল্টেছে। এখন জীবিত ও মৃত ব্যক্তির একই অবস্থা। এখন মৃত ব্যক্তিকেও কেউ ছাড় দেয় না। সময় এখন ভার্চুয়াল। জীবিত থাকতেই লিংক, পাসওয়ার্ড জোগাড় করে রাখতে হবে। জীবিত থাকতে যে আত্মীয় পরিজনের লিংক হারিয়ে ফেলে, মরার পর সে কী করে তা আশা করে? এসেছ যখন একটি গল্প শুনে যাও। আর মনে রেখো তোমার বেলায় যা ঘটেছে তা আমাদের সবার বেলায় ঘটবে। তবে বিশ্বাস রেখো কেউ না কেউ একজন পাশে দাঁড়াবে।

গল্পটি এরকম ‘খুব সরু একটি রাস্তা দিয়ে হারকিউলিস যাচ্ছিলেন। পথে যেতে যেতে দেখলেন, পথের একধারে মাটিতে কি যেন একটা পড়ে রয়েছে। দেখতে অনেকটা আপেলের মত। খেয়ালের বশে হারকিউলিস পা দিয়ে সেটা চেপে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটা দ্বিগুন বড় হয়ে গেল। হারকিউলিস তাতে খুব রেগে গেলেন। বেশ জোরে একটা লাথি মারলেন তার ওপর এবং হাতের মুগুরটা দিয়ে এক ঘা কষালেন। ফলে জিনিসটা বেড়ে বেড়ে এত বড় হয়ে গেল যে তাতে সারা পথটা গেল আটকে।

এমন সময় দেবী এথেনা সেখানে আবির্ভূত হয়ে হারকিউলিসকে বললেন, একি করলে তুমি? তুমি না বীর ! এই যা তুমি সামনে দেখছ, এর নাম কলহ। বিরোধের পরিণাম। ওর সঙ্গে লাগতে না গেলে,ও যেমন ছিল তেমন থাকত। রাস্তা ও বন্ধ হত না।

কলহ বা বিবাধ এভাবে ছোট থেকে বড় হতে হতে কখন যে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় মানুষ তা টের পায় না। চিন্তা করে দেখ সাবিরা, স্বামীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল বলেই তোমার পুত্র হয়েছে। প্রথমে সামান্য আপেলের মত সমস্যা ছিল। পাশ কাটিয়ে গেলে আজ এ অবস্থা হত না। ঘুম ভাঙলে মা সাবিরাকে পেলেন না।

পরিশেষ : ৩ জুন ২০২১ পত্রিকার খবরে প্রকাশ চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানের মামাতো ভাই রেজাউল হাসান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে হত্যা মামলা করেছেন রাজধানীর কলাবাগান থানায়।