Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

০৮ অগাস্ট , ২০২১


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


২২শে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা

শ্রাবণ—আমাদের সেই ‘বাইরা মাস’ ঝরো-ঝরো বৃষ্টিতে সব কিছু ভিজে থাকে। মনটাও থাকে মেঘের আবছায়ার মতো কালো, ভারী। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই ২২শে শ্রাবণ সিলেটের জনমানসে বৃষ্টি নামে। ১৯১৯ সালে কবি যখন সিলেটে আসেন—তখন তাঁকে ঘিরে যারা আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিলেন, তাদের কাছে এই দুঃসংবাদ কাম্য ছিল না। তাঁরা শ্রাবণের বৃষ্টির মতো কেঁদেছিল। কারণ তাঁদের মনোজগত বরীন্দ্র চেতনায় গড়া। শোকটা সে প্রজন্মের বেশি থাকা স্বাভাবিক। কবি প্রয়াণের সিলেটে প্রতিক্রিয়ার মাত্রা অনুভব করা যায় সমকালীন ইতিহাসের খেরো পাতায়।


৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে রবীন্দ্র প্রয়াণের খরবটি তারবার্তায় সিলেট পৌঁছে। বেতারের খবরেও বলা হয়েছিল। তখন গণমাধ্যম কম থাকায় তারবর্তাটি লোকমুখে চাউর হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সিলেটীদের আলাদা একটা টান ছিল বরাবর। ফলে বেদনাটা তারা অনুভব করে বেশি।  কবির মৃত্যু সংবাদে সাধারণ মানুষের মধ্যেও শোকের ছায়া পড়ে। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের স্থানীয় পত্রিকার সংবাদ ও স্কুল-কলেজ ম্যাগাজিনের বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে কবির অনুরাগীবৃন্দ বিষাদমনে ও গভীর শ্রদ্ধায় কবিকে স্মরণ করেছিলেন। ২২ শে শ্রাবণ ‘কবি প্রয়াণে’ প্রথম কবিতা লিখেন অচ্যুচরণ তত্ত্বনিধি [তাঁর কবিতা কোথাও ছাপা হয়েছিল কিনা যায়নি। তবে, মূল পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে রয়েছে। তাঁর দীর্ঘ কবিতায় সাহিত্য মানের চেয়ে বিয়োগ ব্যথাই মূখ্য হয়েছে। যেমন-কবিতার একটি চরণ-‘ঘোর হাহাকার রবে বসুধা ভরিল/অধৈর্য্যে অবশ প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল।’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানার্থে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, সাধারণ সচেতন মানুষ শহরের রাস্তায় শোক মিছিল করেছিল।

রবীন্দ্র প্রয়াণের খবর তড়িৎগতিতে শ্রীহট্ট জেলে পৌঁছানো হয়। ডাকসাইটের রবীন্দ্রপ্রেমী রাজনীতিকরা তখন জেলে বন্দি। কবির মৃত্যুর পর ২২ শে শ্রাবণ জেলবন্দি বীরেশচন্দ্র মিশ্র [ঢাকাদক্ষিণ ‘ঠাকুর বাড়ী ব্রতীবালক সমিতি’র উপদেষ্টা ছিলেন], অবলাকান্ত গুপ্ত, করুণাসিন্ধু রায়, প্রবোধানন্দ কর, চিত্তরঞ্জন দাস, জ্যোতির্ময় নন্দী মজুমদার, কুমুদরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ জেল আইন ভঙ্গ করে ‘রবীন্দ্র স্মরণ-সভা’ করেন। তাঁরা সবাই তখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য। ১৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধের দিন জেলের ভিতর সবাই মিলে বড় আকারে শোকসভা করেন। বিপ্লবীরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন গঠনমূলক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মুক্ত সাহিত্য স্রষ্টা ও ‘মহান জাতীয়তাদী একজন অসাম্প্রদায়িক ভারতীয়’ হিসেবে। স্থানীয় কয়েকজন বামপন্থির সাহিত্য-কর্মী রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বুর্জোয়ার গন্ধ পেলেও তাদের কাছে ‘রক্তকবরী’ ও ‘রাশিয়ার চিঠি’ প্রভৃতি অনেক মূল্যবান ছিল। শ্রীহট্ট কারাগারে কমিউনিস্ট প্রাধান্য শোক সভায় ‘রাজনৈতিক বন্দীদের পক্ষ হইতে কবির প্রতিকৃতির পদমূলে একটি রঞ্জন ও কবরীফুলের অর্ঘ্যও নিবেদন করা হইয়া ছিল।’ শোক সভায় একটি শোকপ্রস্তাব লিখে তারা গোপনে জেলের বাইরে পাঠায়। দীর্ঘ শোক প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথকে ‘দুনিয়ার নিপীড়িত ও শোষিত মানবের অকপট বন্ধু’ হিসেবে বলা হয়েছে। এই শোক প্রস্তাবটি ‘রাজবন্দীদের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শিরোনামে বলাকার প্রথম পৃষ্ঠায় ৫ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়। 

সমকালীন পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় রবীন্দ্রপ্রয়াণ উপলক্ষ্যে সিলেট শহরের গণনাট্য সংঘ, বলাকা গোষ্ঠী, ছাত্র ফেডারেশন, শ্রীহট্ট জেলা কংগ্রেস, বাণীচক্র, ব্রাহ্ম সমাজ, শ্রীহট্ট প্রগতি লেখক সংঘ, শ্রীহট্ট জেলা কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রীহট্ট স্কুল ইনস্টিটিউট, বিভূতিভূষণ লিটারেরি অরগেনাইজেশন, মুসলিম সাহিত্য সংসদ, মুরারিচাঁদ কলেজ, মহিলা কলেজ, মদনমোহন কলেজ, এইডেড স্কুল, সরকারি হাই স্কুল, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, রাজা গিরীশচন্দ্র হাই স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আলাদা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ’ বড় পরিসরে ১৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে ‘রবীন্দ্র শ্রাদ্ধ বাসর’ অনুষ্ঠান করে। সভাপতি ছিলেন মঙ্গলা সম্পাদক, কবি ও শিক্ষক  অশ্বিনীকুমার শর্মা। সংগঠনের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, তারা ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে স্মরণসভা করেছিল।

শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদের অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ছিল নিম্নরূপ [প্রচারপত্র]:

১. রবীন্দ্রনাথের গান [রেকর্ড বাজানো]

২. আবৃত্তি—শ্রীযুক্ত দিগিন্দ্রনাথ দাস, এম,এ, বিএল; হেডমাষ্টার রাজা গিরীশচন্দ্র হাই স্কুল

৩. গান—শ্রীমতি রেখা নন্দী

৪. পাঠ ‘বলাকা’ ও ‘পূরবী’ হইতে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রকুমার চৌধুরী এম,এ, বিএল

৫. রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তি রেকর্ড—‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’

৬. প্রবন্ধ—শ্রীযুক্তা আশালতা খাস্তগীর বিএ; সহ-শিক্ষিকা, সরকারী উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়

৭. গান—শ্রীযুক্তা লীলা দাসগুপ্ত, শিক্ষয়িত্রী, সরকারী উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয় ও উক্ত বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা

৮. পাঠ (গদ্য)— শ্রীযুক্ত অশোকবিজয় রাহা, বিএ

৯. গান— সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কতিপয় বালিকা

১০. যন্ত্র সঙ্গীত বিশারদ শ্রীযুক্ত কুমুদরঞ্জন গোস্বামী

১১. রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড—‘তবু মনে রেখো’। [শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদেও আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে যুক্ত অনুষ্ঠানসূচি ও কার্যবিবরণী, ১৯৪১]

‘১৭ আগস্ট [শ্রাদ্ধের দিন] রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ নিবেদন করার জন্য শ্রীহট্ট জেলা কংগ্রেস, ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে জাতীয় পতাকা অর্ধনির্মিত রাখা হয়, শোক যাত্র ও শোকসভার অনুষ্ঠান হইয়াছিল।’ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ কর্মসূচি ছিল। স্থানীয় পত্রিকা বিশেষ সংবাদ প্রচার করেছিল।

২২ শ্রাবণ [১৩৪৮] রাজাগিরীশচন্দ্র হাই স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে। ৮ আগস্ট বিদ্যালয়ে [১৯৪১] শোকসভায় গৃহীত শোক প্রস্তাবে বলা হয়,

রাজা গিরীশচন্দ্র হাই স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকগণ এই সভায় মিলিত হইয়া বিশ্বভারতের মুখোজ্জ্বলকারী বঙ্গের কৃতি সন্তান বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে গভীর শোক প্রকাশ করিতেছে। ভারত ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে তাঁহার ন্যায় প্রাজ্ঞ সম্পন্ন পথ নির্দেশকের অভাব জাতীয় দুর্দ্দেব বলিয়া বিবেচনা করেন। বিশ্ব সংস্কৃতির ভাণ্ডারে তাঁহার অমর অবদান স্মরণ করিয়া এই সভা মনে করেন তাঁহার মৃত্যুতে সমগ্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হইল।

এই শোকবার্তার কপি রাজা স্কুলের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক শান্তিনিকেতনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠানো  হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাপ্তি সংবাদের উত্তরে প্রধান শিক্ষককে লিখেন, ÔI am deeply touched by the Kind massage of  Sympathy you have sent in my bereavement and I beg of you to accept my greatful thanks.’ এখানেই শেষ নয়, রাজা গিরীশচন্দ্র হাইস্কুল ম্যাগাজিন-এ ‘হে কবি বিদায়’ শিরোনামে বলা হয়—

ভারত গৌরব রবি আজ অস্তমিত। তিনি ছিলেন ভারত ভাস্কর। তাঁহার আভা আজ চারদিকে উদ্ভাসিত করিতেছে; কিন্তু উৎস নাই। উৎসের সন্ধানে আমাদিগকে ঘুরিতে হয় নাই, আমাদের ঘরে আমরা পেয়েছিলাম এই গৌরবময় প্রতিভার উৎসকে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বকবি, বিশ্বপ্রেমিক, শুধু স্বদেশপ্রেমিক বলিলে তাঁহার অমর্যাদা হয়। [১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর, ১৯৪১]

এই স্কুল ম্যাগাজিনে রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গকৃত লেখার সংখ্যা বেশি। সিলেট টাউনের স্কুল সমূহ নিয়ে গঠিত ‘শ্রীহট্ট স্কুল ইনষ্টিটিউটে’র উদ্যোগে ১৭ আগস্ট ‘রবীন্দ্র দিবস’ পালিত হয়। ছাত্র-শিক্ষককের বিশাল সমাবেশে সভাপতিত্ব করেছিলেন আসামের শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর রবীন্দ্রঅনুরাগী শিক্ষাবিদ সতীশচন্দ্র রায়। তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ টাকা বিতরণ করেছিলেন। 

মদনমোহন কলেজ তাদের প্রথম ম্যাগাজিনে [১৯৪১] রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিল। শেষদিকে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন, লেখাও বারণ ছিল; অতপর তাঁর মৃত্যু ঘটে। ১৯৪১-৪২ সালে কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশের সময় এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের আক্ষেপের সীমা ছিল না। তারা সম্পাদকীয়তে লেখেÑ

বাঙালার শিক্ষিত জনসাধারণের সুদীর্ঘকালব্যাপী শিক্ষা ও সংস্কৃতির যিনি ছিলেন উৎস, আজ আর তিনি নাই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীর আশীর্বাদ লইয়া আমরা এই পত্রিকাখানি প্রকাশ করিতে পারিলাম না—আজ দুঃখিত চিত্তে আমরা এই কথা বারবার স্মরণ করিতেছি। বাঁচিয়া থাকিলে তিনি নিশ্চয়ই আমাদিগকে এই কাজে উৎসাহিত করিতেন এই ভরসা আমাদের আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁহার অমর বাণী বাঙালা ভারত তথা সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির পথ প্রদর্শক হইবে। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবে বাঙ্গালী জাতি ও বাংলা ভাষা জগতে যে অক্ষয় প্রতিষ্ঠা লাভ করিল, তাহাই আমাদের অপরিমেয় বিষাদের মধ্যেও সান্তনা হইয়া রহিল। [প্রকাশের তারিখ নাই]

কবির প্রয়াণ উপলক্ষে স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা সমকালীন ম্যাগাজিনে যে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছিলÑতার মধ্যে মদনমোহন কলেজ ম্যাগাজিন ছিল উত্তম। ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করেন যতীন্দ্র রঞ্জন দে ও জিতেন্দ্রমাধব দত্ত। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য। ম্যাগাজিনে রবীন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধ ছিল দুইটি—যেমন ইংরেজি সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের দান [অধ্যাপক সুশান্তকুমার চৌধুরী], রক্ত-কররী [শিবপদ চক্রবর্তী]।

সাহিত্য সংগঠন ‘বিভূতিভূষণ লিটারেরী অরগনাইজেশন’ তাদের ‘স্মৃতি’ সংকলনে কবিকে স্মরণ করেছে—

ভারতের কোন এক মহালগ্নে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, এসেছিলেন আদর্শ মানবের পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে। তাঁর আবির্ভাব ভারতবর্ষের বহু সাধনার ফল। ভারতের শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রদীপ্ত মশাল তিনি আরও দ্বিগুণ তেজে জ্বালিয়ে ধরেছিলেন—সমস্ত জগতের সমক্ষে ...। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ত্রি-কালজ্ঞ, তাই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সত্যিকারের ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যে। তিনি ছিলেন যুগের পুরোভাগে, যুগই তাঁতে অনুসরণ করেছে। তাঁর অবিনশ্বর কীর্তির আশ্বাদ তিনি পেয়ে গেছেন...। [শারদীয় সংখ্যা, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ]

রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানাদি কেবল শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি; প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলও কবি স্মরণে মেতে ওঠে। চুয়াল্লিশ পরগণার (মৌলভীবাজার) ‘পল্লী মঙ্গল সমিতি’ তাদের  শোকবার্তায় লেখে:

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের তিরোধানে বাঙ্গালার তথা ভারতের যে ক্ষতি হইল—ভারতের আকাশ হইতে যে  জ্যোতিষ্কণা খসিয়া পড়িল—তাহা যে শুধু ভারতের দুর্ভাগ্য, তাহা নহে—সারা পৃথিবীই রবীন্দ্রনাথের মহা প্রয়াণকে এক জাতীয় জীবনের মহা ক্ষতি বলিয়া ধরিয়া লইয়াছে। আমরা এই মহাপুরুষের তিরোধানে তদীয় পরলোকগত আত্মার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করিতেছি এবং শ্রীভগবান সমীপে প্রার্থনা, তদীয় আত্মার সদগতি হউক। [পল্লী মঙ্গল, ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ, মৌলভীবাজার] ]

কুলাউড়া রঙ্গিরকূল বিদ্যাশ্রমে [সর্বত্যাগী কংগ্রেসীরা থাকতেন] রবীন্দ্র প্রয়াণের খবর শোনে স্বদেশী কর্মীরা সারা দিন উপাসনা করেন। ১৭ আগস্ট বিদ্যাশ্রমের কর্মসূচি সম্পর্কে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জনশক্তি সম্পাদক নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী জানিয়েছিলেন—

গুরুদেবের মহাপ্রয়াণের সংবাদে সিলেটের বহু পরিবার রন্ধন বন্ধ করে উপবাস থাকে। আমরা খবর শুনে বেহুশ হয়ে পড়ি। পরিবারের কোনে সদস্যের যেন বিয়োগ ব্যথা। আমাদের আশ্রমে কি কান্না। সবাই মিলে উপবাস করে প্রার্থনা করেছিল। শ্রাদ্ধের দিন আরও বড় আয়োজন হয়েছিল। দরিদ্র সেবা, উপাসনা অনুষ্ঠান ছাড়াও গুরুদেব স্মরণে আশ্রমের কর্মীরা বৃক্ষরোপন করেছিল। সেদিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ সিলেটের জনসমাজের ছিলেন একান্ত আত্মজন—আমাদের শক্তির উৎস।

রবীন্দ্রপ্রয়াণ উপলক্ষে আনন্দবাজার পত্রিকা সিলেট, হবিগঞ্জ ও  মৌলভীবাজারের কিছু অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হয়। ২৭ আগস্ট ১৯৪১ সালের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়, ৯ আগস্ট শ্রীহট্ট শহরে শোক মিছিল বের হয় এবং সারদা হলে শোকসভায় সভাপতিত্ব করেন আসাম ব্যবস্থাপনা সভার কংগ্রেস দলের ডেপুটি লিডার অরুণকুমার চন্দ। সেদিন ‘সমস্ত আদালত এবং অফিস অর্ধেক সময়ের জন্য বন্ধ ছিল।’ ‘কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য শ্রীহট্টের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কতকগুলি দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।’ হবিগঞ্জের খবরে পত্রিকা লেখে—

‘গত ১৭ আগষ্ট, রবিবার হবিগঞ্জের নাগরিক ও ছাত্রবৃন্দ কর্তৃক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধ দিবস যথাযোগ্যভাবে প্রতিপালিত হয়। সকাল সাড়ে আট ঘটিকায় কবিগুরুর পত্রপুষ্পে সজ্জিত একখানি বৃহদাকার প্রতিকৃতিসহ নিঃশব্দ শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করিয়া স্থানীয় টাউন হলে সমবেত হয় এবং ছাত্র ফেডারেশন, শক্তি সঙ্ঘ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, শরীরচর্চা সমিতি, কলেজ ইউনিয়ন, সংস্কৃতি সঙ্ঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে কবিগুরুর পুণ্য-স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পিত হয়। অধ্যক্ষ দ্বিজদাস চৌধুরী, সহ-অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্র বিশ্বাস, অধ্যাপক মণীন্দ্র দত্ত, শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্র দেব (সভাপতি হবিগঞ্জ হিন্দু সভা), সুবোধ রায় (সম্পাদক পল্লীবাসী) প্রভৃতি শোভাযাত্রায় যোগদান করেন।’ [আনন্দবাজার, ২৭ আগস্ট ১৯৪১]

মৌলভীবাজারে ‘রবীন্দ্র স্মৃতি তর্পণ’ সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে—

‘গত ১৩ই ও ১৪ই ডিসেম্বর স্থানীয় আলী আমজাদ বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যথাচিতভাবে রবীন্দ্র স্মৃতির্পণ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র দেব ও প্রসন্নকুমার দেব চৌধুরী উকিল মহোদয়গণ ঐ দুই দিনের অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন। স্মৃতিতর্পণ উপলক্ষে রবীন্দ্রজীবনী সম্পর্কে প্রতিযোগিতা, রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে পরিচালকবৃন্দ ঘোষণা করেন যে, সত্বরই তাহারা মৌলভীবাজারে একটি রবীন্দ্র পরিষদ প্রতিষ্ঠা করিবেন। স্থানীয় উৎসাহী তরুণ নাগরিক শ্রীযুক্ত অমরেন্দ্রকুমার গুপ্ত মহাশয় একা এই অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যয় বহন করিয়াছেন।’ [আনন্দবাজার, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১] 

রবীন্দ্র প্রয়াণ উপলক্ষ্যে সিলেটের শক্তিশালী সাহিত্য গোষ্ঠী ‘বাণীচক্র’ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে ‘কবি প্রণাম’ নামক একটি গ্রন্থ বের করেছিল নভেম্বর ১৯৪১ সালে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেন যথাক্রমে—নলিনীকুমার ভদ্র, অমিয়াংশু এন্দ, মৃণালকান্তি দাস, সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ। তাঁরা সকলেই রবীন্দ্রপ্রেমী হিসেবে খ্যাত। রবীন্দ্র প্রয়াণের পর ‘কবি প্রণাম’ই প্রথম প্রকাশিত সংকলন হিসেবে বিবেচিত হয়। নন্দলাল বসু প্রচ্ছদ করেছিলেন। কবি প্রণামে রয়েছে ১৪টি প্রবন্ধ, ৯টি কবিতা, কবির লেখা ১৮টি চিঠি, কয়েকটি কবিতা, অপ্রকাশিত একটি কবিতা ও কিছু ছবি স্থান পায়। এছাড়াও পরিশিষ্ট অংশে রয়েছে পাঁচটি মূল্যবান প্রবন্ধ এবং সিলেটে দেওয়া কবির দুইটি ভাষণ। রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাসে ‘কবি প্রণাম’ একটি মূল্যবান সংযোজন বললে অত্যুক্তি হবে না।

মুসলিম সাহিত্য সংসদ রবীন্দ্রপ্রয়াণে শোকানুষ্ঠান করলেও তারা ৫ম বার্ষিক সাধারণ সভায় আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে [১৯৪২ সালের ৩০ জুন]। কার্য নির্বাহী পরিষদের ৬ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়—‘এই সভা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধানে গভীর শোক প্রকাশ করিতেছে এবং তাহার আত্মীয় পরিজনের সহিত আন্তরিক সমবেদনা জানাইতেছে।’ ১৯৪১ সালে রবীন্দ্র অনুরাগী শিক্ষাবিদ সতীশচন্দ্র রায়-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিল ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি-ভাণ্ডার’। এই সংগঠন কিছুদিন রবীন্দ্রচর্চায় অবদান রাখে। ‘শ্রীহট্ট রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষা কমিটি’ নামে একটি ক্ষণজীবী সংগঠন গড়ে ওঠে। কমিটির সম্পাদক ছিলেন হরেন্দ্র মোহন মজুমদার। সবচেয়ে বড় কথা কবির মৃত্যুর পর প্রথম শ্রীহট্ট বা সিলেট থেকে গুণ-মানে ও বড় আকারে প্রথম ‘কবি প্রণাম’ নামে স্মারক সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। একুশ শতকেও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কমে যায়নি। সমাজ-মনন সুস্থ রাখতে রবীন্দ্রচর্চার বিকল্প কোথায়?