Cinque Terre

বিপ্রদাস ভট্টাচার্য

০৮ অগাস্ট , ২০২১


সংগীতশিল্পী

সংগীত বিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা


বাংলার বর্ষা ও রবীন্দ্রনাথ

প্রকৃতির সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ রবীন্দ্রনাথ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। সৃষ্টি করেছেন প্রেম ও প্রকৃতির গান। আবার প্রার্থনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও রেখেছেন। আহ্বান যখন করেছেন তখন পূজা, প্রকৃতি, বিচিত্র বিশ্ব, স্রষ্টা কোনো কিছুকেই বাদ দেননি। এক এক রূপে এক একটিকে আহ্বান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শ্রাবণসন্ধ্যা প্রবন্ধে বলেন- 

‘আজ কেবলই মনে হচ্ছে এই যে বর্ষা, এ তো এক সন্ধ্যার বর্ষা নয়। এ যেন আমার সমস্ত জীবনের অবিরল শ্রাবণধারা। যতদূর চেয়ে দেখি, আমার সমস্ত জীবনের উপরে সঙ্গীহীন বিরহসন্ধ্যার নিবিড় অন্ধকার-তারই দিগ্-দিগন্তরকে ঘিরে অশ্রান্ত-শ্রাবণের বর্ষণে প্রহরের পর প্রহর কেটে যাচ্ছে ; আমার সমস্ত আকাশ র্ঝ র্ঝ করে বলছে, ‘কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিনরাতিয়া।’ কিন্তু তবু এই বেদনা, এই রোদন, এই বিরহ একেবারে শূন্য নয়-এই অন্ধকারের, এই শ্রাবণের বুকের মধ্যে একটি নিবিড় রস অত্যন্ত গোপনে ভরা রয়েছে ; একটি কোনো বিকশিত বনের সজল গন্ধ আসছে, এমন একটি অনির্বচনীয় মাধুর্য-যা যখনই প্রাণকে ব্যথায় কাঁদিয়ে তুলছে, তখনই সেই বিদীর্ণ ব্যথার ভিতর থেকে অশ্রæসিক্ত আনন্দকে টেনে বের করে নিয়ে আসছে। 

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির বেলায় ঋতুগুলোকে নব নব রূপে আহ্বান করেছেন। যেমন করে করেছেন গ্রীষ্মের পর বর্ষা। বর্ষার আগমনীতে কবি বলে ওঠেছেন, ‘ওই আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌর ভর ভসে, ঘন গৌরবে নব যৌবনা বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসা।’ রহস্যময়ী এই প্রকৃতি বাংলাদেশের মানুষকে করে তুলেছে ভাব-ব্যাকুল সৌন্দর্য পিয়াসী। ঘন গৌরবে নব যৌবনা বর্ষা তার শ্যাম গম্ভীর সরসা রূপ নিয়ে আসে। ধরনীতে বহে পূর্ণ তৃপ্তির বিন্দু জল। বর্ষার আগমনে পৃথিবী হয় শীতল। পিপাসু বৃষ্টিহীন ধরণী অফুরন্ত পানি পেয়ে তৃপ্ত হয়। কবি বর্ষার এ আগমনীতে উদ্বেলিত হয়ে বলে ওঠেন, এসো শ্যামল সুন্দর, আনো তব তাপহরা, তৃষাহরা সঙ্গ সুধা।” 

রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে দিগি¦জয়ী যোদ্ধার মতো দেখেছেন। গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়াকে ঐশ্বর্যের পূর্ণতায় ভরে তোলে। বর্ষা আমাদের মনের গভীরে বিপুল তরঙ্গ সৃষ্টি করে। আপন মনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ‘এই সকাল বেলার বাদল আঁধারে। আজি মনের বীনায় কী সুর বাঁধারে।’ ঝরো ঝরো বৃষ্টি কলরোলে, তালের পাতা মুখর করে তোলে এই বর্ষা। তার মমতাময়ী রূপ প্রকৃতিকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে তেমনি আমাদের হৃদয়কেও আচ্ছন্ন করে তোলে। তাঁর সঙ্গে প্রাণের কাঁপন যেন এক তালে মেতে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি কবি, আমার গান কবিতার গান। আমি বাঙালি, বাঙালির চিত্ত সাহিত্যিক। বাঙালি কীর্তন লিখেছে। তার যে আখর দিয়েছে সেটা কথার তান। বাঙালি কথায় গান বলবে, বাণী প্রধান গান। বাণী অর্ধনারীশ্বর হবে-সেই তো বাঙালির স্বধর্ম। আমি তো তাই করেছি। আমি বাণীতে যে সুর পরিয়েছি সেইটি যেন থাকে। গীতবিতান (১৩৭৭ সংস্করণ) অনুযায়ী বর্ষার একশো চৌদ্দটি গানের তালিকা পাওয়া যায়। 

গীতবিতানের দ্বিতীয় সংস্করণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘গীতবিতান যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন সংকলন কর্তারা সত্বরতার তাড়নায় গানগুলির মধ্যে বিষয়ানুক্রমিক শৃঙ্খলা বিধান করতে পারেননি। তাতে কেবল যে ব্যবহারের পক্ষে বিঘœ হয়েছিল তা নয়, সাহিত্যের দিকে থেকে রসবোধেরও ক্ষতি করেছিল। সেই জন্যে এই সংস্করণে ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে গানগুলি সাজানো হয়েছে। এই উপায়ে সুরের সহযোগিতা না পেলেও পাঠকেরা গীতিকাব্যরূপে এই গানগুলির অনুসরণ করতে পারবেন।’ রবীন্দ্র সৃষ্ট বহু রচনাকে সাধারণে নিছক কবিতা বলে জানলেও কবির বহু গ্রন্থে বহুবার সেগুলি সুর তালের উল্লেখের দ্বারা অভ্রান্তভাবে গীত রূপে ও নির্দিষ্ট, সেই গানগুলি গীতবিতানে স্থান পেয়েছে (গীতবিতান - পৃ: ৯৭২)। 

বর্ষার মাঝে কেমন একটা নিঃসঙ্গ বেদনার ভাব লুকিয়ে আছে। নিভৃত মনের অজানা জগৎকে আন্দোলিত করে। সুর আসে ভাবার্থের অসীম রূপকে উদঘাাটন করতে। যিনি কখনও গান করেননি তিনিও বর্ষার রুনুঝুনু ছন্দে আপন মনে গেয়ে ওঠেন। আনন্দে দুঃখে, মিলন চিন্তায়, যে কোনো নিবিড় অনুভূতিতে রবীন্দ্রনাথের গান অন্তরকে স্পর্শ করে। তাঁর সব কীর্তি মুছে গেলেও তাঁর গান অমর হয়ে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ শ্রাবণসন্ধ্যা প্রবন্ধে বর্ষার অপরূপ ব্যাখ্যায় বলেন-,‘আজ শ্রাবণের অশ্রান্ত ধারাবর্ষণে জগতে আর যত-কিছু কথা আছে, সমস্তকেই ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে। মাঠের মধ্যে অন্ধকার আজ নিবিড়-এবং যে কখনো একটি কথা কইত জানে না, সেই মুক আজ কথায় ভরে উঠেছে। অন্ধকারকে ঠিকমতো তার উপযুক্ত ভাষায় যদি কেউ কথা কওয়াতে পারে, তবে সে এই শ্রাবণের ধারাপতনধ্বনি। অন্ধকারের নিঃশব্দতার উপরে এই র্ঝ র্ঝ কলশব্দ যেন পর্দার উপরে পর্দা টেনে দেয়, তাকে আরও গভীর করে ঘনিয়ে তোলে, বিশ্বজগতের নিদ্রাকে নিবিড় করে আনে। বৃষ্টিপতনের এই অবিরাম শব্দ, এ যেন শব্দের অন্ধকার।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, কথা জিনিসটা মানুষেরই, আর গানটা প্রকৃতির। কথা সুস্পষ্ট এবং বিশেষ প্রয়োজনের দ্বারা সীমাবদ্ধ, আর গান অস্পষ্ট এবং সীমাহীনের ব্যাকুলতার উৎকন্ঠিত। সেইজন্যে কথায় মানুষ মনুষ্যলোকের এবং গানে মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মেলে। এইজন্যে কথার সঙ্গে মানুষ যখন সুরকে জুড়ে দেয়, তখন সেই কথা আপনার অর্থকে আপনি ছাড়িয়ে গিয়ে ব্যাপ্ত হয়ে যায়-সেই সুরে মানুষের সুখদুঃখকে সমস্ত আকাশের জিনিস করে তোলে, তার বেদনা প্রভাতসন্ধ্যার দিগন্তে আপনার রঙ মিলিয়ে দেয়, জগতের বিরাট অব্যক্তের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বৃহৎ অপরূপতা লাভ করে, মানুষের সংসারের প্রাত্যহিক সুপরিচিত সংকীর্ণতার সঙ্গে তার ঐকান্তিক ঐক্য আর থাকে না। 

তাই নিজের প্রতিদিনের ভাষার সঙ্গে প্রকৃতির চিরদিনের ভাষাকে মিলিয়ে নেবার জন্যে মানুষের মন প্রথম থেকেই চেষ্টা করছে। প্রকৃতি হতে রঙ এবং রেখা নিয়ে নিজের চিন্তাকে মানুষ ছবি করে তুলছে, প্রকৃতি হতে সুর এবং ছন্দ নিয়ে নিজের ভাবকে মানুষ কাব্য করে তুলছে। এই উপায়ে চিন্তা অচিন্তনীয়ের দিকে ধাবিত হয়, ভাব অভাবনীয়ের মধ্যে এসে প্রবেশ করে। এই উপায়ে মানুষের মনের জিনিসগুলি বিশেষ প্রয়োজনের সংকোচ এবং নিত্যব্যবহারের মলিনতা ঘুচিয়ে দিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন সরস নবীন এবং মহৎ মূর্তিতে দেখা দেয়। 

রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আজ এই ঘনবর্ষার সন্ধ্যায় প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারের ভাষা আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলতে চাচ্ছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করবে বলে আমাদের দ্বারে এসে আঘাত করছে। আজ যুক্তি তর্ক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ খাটবে না। আজ গান ছাড়া আর কোনো কথা নেই। তাই আমি বলছি, আমার কথা আজ থাক্। সংসারের কাজকর্মের সীমাকে, মনুষ্যলোকালয়ের বেড়াকে একটুখানি সরিয়ে দাও, আজ এই আকাশভরা শ্রাবণের ধারাবর্ষণকে অবারিত অন্তরের মধ্যে আহ্বান করে নাও-শ্রাবণ সন্ধ্যা-রবীন্দ্রনাথ।

মানব মনের বিরহ, উদাসীন্য নিয়ে গড়া বর্ষার গানগুলো ভাবপ্রবন মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় অসীমের মাঝে। যেন পার্থিব জগতকে দূরে ঠেলে কল্পলোকে অবস্থান নেয়। কাজল ধোয়া প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যায় মন। প্রকৃতি এসে নিবিড় চিত্তে বাসা বাঁধে মনে। তখন সবচেয়ে কাছের বন্ধু, নিঃস্বার্থ প্রেমিক হয়ে উঠে প্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথ তখন বলে উঠেন ‘দূরের পানে মেলে আঁখি, কেবল আমি চেয়ে থাকি, পরাণ আমার কেঁদে বেড়ায় দূরন্ত বাতাসে।’ প্রকৃতির এই বিস্ময়কর রূপকে রবীন্দ্রনাথের মতো করে কোনো কবি দেখেছেন কি না বলা কঠিন। প্রকৃতির রহস্যময়ী রূপকে মনে হয় একমাত্র রবীন্দ্রনাথই সার্থকভাবে দেখেছেন। তাই তো তাকে প্রকৃতির কবিও বলা যায়।