Cinque Terre

বিপ্রদাস ভট্টাচার্য

২৮ অগাস্ট , ২০২১


সংগীতশিল্পী

সংগীত বিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা


নজরুলের স্বদেশ চেতনা

মানব মুক্তির কথা শৃঙ্খল মুক্তির কথা, ধ্বনিত করে নজরুল স্বদেশের গান রচনা করলেন। দাসত্ব আর বন্দীদশার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন চিত্তে মানুষের জাগরনী গান গাইলেন নজরুল। অগ্নিঝরা বাণী, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুললো মানুষকে। স্বদেশের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর স্নেহ-মমতায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল মানুষ। নজরুলের স্বদেশের গান একদিকে যেমন মুক্তির গান অন্যদিকে স্বদেশ রক্ষার গান। বিদেশী শাসকেরা যে অবদমন নীতি করেছিল স্বাধীনতা প্রিয় মানুষকে স্তব্ধ করার জন্য অত্যাচার করেছিল, তার বিরুদ্ধে নজরুল বিপ্লবী চেতনায় জেগে উঠলেন। স্বদেশ রক্ষার আন্দোলনে দেশ মুক্তির মন্ত্রে গেয়ে উঠলেন। ‘‘জাগো অনশন বন্দী জগতের যত ভাগ্যাহত’’। নজরুল সমাজের সাধারণ মানুষকে অভয়বাণী শোনালেন, বন্ধন মুক্তির আকুলতা জেল প্রাচীরের কঠিন দেয়াল যেন ভেঙ্গে পড়লো। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিন, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’’। স্বদেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে তাঁর দৃপ্ত চেতনাগুলো গানে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সত্যবাণী উচ্চারণ করে সমাজের সচেতন মানুষকে দায়িত্ব নিতে বলেছেন। নির্যাতিত মানুষকে ডাক দিয়েছেন ‘‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখী ঝড়’’। দেশাত্মবোধ মানুষের চেতনাকে প্রখরতা দিয়েছিল। বিপ্লবী চেতনাকে গতিময় করেছিল। স্বদেশ প্রেমে বিভোর হয়ে তিনি বললেন ‘‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’’। এদেশের সভ্যতা এদেশের আচার আমাদের অহঙ্কার তাই তিনি গর্ববোধ করে শোনালেন ‘‘এই মাটি এই কাঁদা মেখে, এই দেশেরই আচার দেখে, সভ্য হলো নিখিল ভুবন দিব্য পরিপাটি’’।

নজরুলের মাত্র নয় বৎসর বয়সে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ফলে সংসারের দারিদ্র আরও চরমে উঠে। কঠোর দারিদ্র ও সাংসারিক বিশৃঙ্খলার জন্য তাঁর স্বাভাবিক পড়াশুনা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। তিনি গ্রামের মক্তবে পড়াশুনা শুরু করেন। তাঁর মেধা ও জ্ঞানপিপাসা বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। কথকতা, কীর্ত্তনম, যাত্রাগান, মৌলবীর কোরাণপাঠ তিনি গভীর আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন ও বাউল, সুফী, সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। অল্প বয়স হতেই নজরুলের মধ্যে কবিপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। আর্থিক উপার্জনের প্রয়োজনে তিনি লেটো গানে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন।

কিছুদিন পর তিনি বর্ধমান জেলার মাথরুণ হাইস্কুলে ভর্তি হন। এর পর আসানসোলে আব্দুল ওয়াহেদ নামে এক ব্যবসায়ীর রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে চাকরিতে বহাল হন। সারাদিন কাজের পর যে অল্প সময় তিনি পেতেন  সে সময়টাও তিনি পড়াশুনা বা সাহিত্যচর্চায় কাটাতেন। সেই সময় তাঁর গান-বাজনায় আকৃষ্ট হয়ে আসানসোলের দারোগা রফিউদ্দীন আহমেদ তাঁহার পৈতৃক বাড়িতে (ময়মনসিংহ) নিয়ে যান এবং হাইস্কুলের ফ্রি ছাত্ররূপে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করেন। পরে তিনি পুনরায় রাণীগঞ্জে শিয়ারশোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তাঁর মেধার পুরস্কার হিসাবে রাজবাড়ি হতে মাসিক সাত টাকা বৃত্তি ও নিখরচায় পড়াশুনা এবং হোস্টেলে থাকবার সুযোগ পান। এভাবেই তাঁর বাল্য জীবনে নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ ছিল।

১৯২১ সালের ১৮ নভেম্বর নজরুল কুমিল্লায় আসেন এবং ওঠেন প্রমীলাদের বাসায়। সেখানে পৌঁছেই ‘বন্দনা গান’ নামে একটি গান লেখেন, যা পরে ‘বিজয় গান’ নামে সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে তিনি ‘নিশীথ-প্রীতম’ ও ‘বিজয়িনী’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী তখন হরতাল চলছে। কুমিল্লায় একটি মিছিলে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে তিনি সরকারবিরোধী গান গেয়েছেন, মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তরুণদের জন্য ‘জাগরণী’ নামে একটি নতুন কোরাস গান লিখে দিয়েছিলেন। সেই গান রচনা ও প্রচারের দায়ে একরাত তাঁকে থানায় আটকে রাখা হয়।

নজরুল প্রথমবারের মতো ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ১ মে, কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে। তিনি সেই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘চরকার গান’ এবং এর সঙ্গে ‘শিকল-পরা ছল’ ও ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গানগুলো গেয়ে শোনান। এ-সময়ে ঘনিষ্ঠতা জন্মে কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালের ১০ মার্চ তিনি ফরিদপুরের মাদারীপুর আসেন। মাদারীপুরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মিলনের তৃতীয় অধিবেশনে ‘ধীবর’ বা ‘জেলেদের গান’ শীর্ষক “আমরা নিচে পড়ে রইবো না আর” উদ্বোধনী গান হিসেবে পরিবেশন করেন। গানটি অবশ্য কৃষ্ণনগরে বসে লেখা। সেই সম্মেলনে কুমিল্লা থেকে আগত রাজনৈতিক নেতা বসন্তকুমার মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী নারীনেত্রী হেমপ্রভার সঙ্গে পরিচিত হন। নজরুল তখন হেমপ্রভাকে নিয়ে একটি দেশাত্মবোধক গান ‘কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া’ রচনা করেন। নিজের নির্বাচনী প্রচারের কাজে নজরুল আবারো ফরিদপুরে আসেন একই বছরের ৩ নভেম্বর। এবার তিনি ওঠেন কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে। সেখানে বসে কবি স্বদেশের চেতনায় অনেক লেখা উপহার দেন।

নজরুল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পার্টির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। মুজফফর আহমদ উল্লেখ করেন, ১৯২৬ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভ্য ছিলেন। কিন্তু নজরুলের সাহিত্যকর্মে কংগ্রেস বা কংগ্রেসের নেতা গান্ধীর কোনো প্রভাব নেই। যদিও একবার নজরুলের সঙ্গে হুগলিতে গান্ধীর দেখা হয়েছিল এবং নজরুল গান্ধীর আগমন উপলক্ষে গান ও কবিতা লিখেছিলেন, তবু নজরুল বিশ্বাস করতেন, চরকা ও খদ্দরের মারফতে দেশে স্বাধীনতা কোনো দিন আসবে না।” এভাবে নজরুলের একটা বড় রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়। বড় বড় রাজনৈতিক দল ও নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নজরুল ব্রিটিশ সরকার ও তার প্রশাসনের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই ধরা পড়েছিল।

ভারতে মুসলিম লীগ গঠিত হলেও সরাসরি মুসলিম লীগের সঙ্গে নজরুল জড়াচ্ছেন না। যদিও নজরুল সাহিত্যকর্মের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইসলামি গজল, সংগীত, হামদ, নাত ইত্যাদি। এমনকি নজরুলের অনেক কবিতায় রয়েছে কোরান, হাদিসের সরাসরি প্রভাব এবং অনেক কবিতা রয়েছে ইসলাম ও মুসলিম জাতি প্রসঙ্গে। অথচ নজরুল কোনো সময়েই মুসলিম লীগের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হননি। আবার সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি না করলেও কমিউনিজম বা সাম্যবাদ সম্পর্কে নজরুলের দেখা যাচ্ছে অগাধ আকর্ষণ। আসলে নজরুলের জীবন সংগ্রামের সঙ্গেই জড়িয়েছিল সাম্যবাদ এবং সাম্যবাদী আদর্শের সংগ্রাম। তিনি নিজে ভাগ্য বিড়ম্বিত ছিলেন। ছিলেন মজলুম। এর বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম তাঁকে সাম্যবাদী আদর্শে প্রোথিত করেছিল। তারপরও আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি কিছু অনুসন্ধান করা যেতে পারে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, ।

‘‘... 

ধূমকেতু’তে লিখতে গিয়ে নিজের প্রচন্ড আবেগের স্রোতে

সে নিজে ভেসে গেল। সে যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে

তোলার চেষ্টা করবে স্থির করেছিল তার সেই বিবেককে সে

লাল পোশাক পরে, লাল কালিতে লিখে এবং মাঝে মাঝে

লাল নিশানের কথা বলে ঠিক রাখছিল।’’

কমিউনিস্টদের বিখ্যাত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ সংগীতের বাংলায় প্রথম অনুবাদক হন নজরুল ইসলামই। নজরুল এর নাম দেন ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’ :

জাগো-

জাগো অনশন বন্দী উঠরে যত

জগতের লাঞ্চিত ভাগ্যহত ।।...

এই ‘অন্তর ন্যাশনাল-সংহতি’ রে

হবে নিখিল মানব জাতি সমুদ্ধত।।