Cinque Terre

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

২৭ সেপ্টেম্বর , ২০২১


সাংবাদিক, লেখক ও আবৃত্তিশিল্পী [email protected]
শ্রীমঙ্গল ‘পর্যটনশিল্প বিকাশের কান্ডারী’ আবু সিদ্দিক মুহাম্মদ মুসা

কিছু মানুষ থাকেন – যারা অন্য মানুষকে স্বপ্ন দেখানো কাজটি নীরবে করে যান। যারা স্বপ্ন দেখতে পারেন না, তারা বরাবরই সেই স্বপ্ন দেখানোর মানুষটির কাছ থেকে নানা রকমের স্বপ্নের রঙ দেখে সবিশ্ময়ে আনন্দিত হয়ে ওঠেন। জীবনকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে ভালোবাসতে শিখেন। সমাজের কিছু মানুষ সেই বিশেষ মানুষটির জন্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ফলস্বরূপ- সমাজ এগিয়ে যায়। আলোকিত হয় সমাজব্যবস্থা।  

আবু সিদ্দিক মুহাম্মদ মুসা তেমনি এক স্বপ্ন দেখানো মানুষ ছিলেন। চায়ের রাজধানী এবং পর্যটননগরী ‘শ্রীমঙ্গল’ ঘিরে তার স্বপ্ন দেখিয়ে যাওয়ার কাজটি ছিল আমৃত্যু। তিনি ভাবতেন সারাদেশের মানুষ শ্রীমঙ্গলের ‘শ্রী’ এর প্রতি বিস্মিত হবেই। এই শ্রী অর্থাৎ সৌন্দর্য উপভোগ করতে সপরিবারে এখানে উনারা আসবেন। কিন্তু এর জন্য আমাদের শ্রীমঙ্গলকে আরো পরিপাটি করার মাধ্যমে সুসজ্জিত করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়েই সারাবিশ্বে পর্যটননগরী হিসেবে শ্রীমঙ্গলের নাম ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। তবে এর জন্য আমাদের সবাইকে আরো যুগোপযোগী কিছু সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রয়োগগুলো ঘটাতে হবে। সেইরকম ভাবেই সম্মিলিত পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন শ্রীমঙ্গল শহরের অতি সুপরিচিত মুখ। শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সম্মানিত সভাপতি, টি হ্যাভেন রিসোর্ট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেলথ লাইন ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের পরিচালক ও উপদেষ্টা, বিশিষ্ট সমাজসেবক, নিরহংকারী  এবং দানশীল সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব‍্যক্তিত্ব।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আমি এই মহান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। সালটা ২০১৬। বাংলানিউজ এর ‘বছরজুড়ে দেশ ঘুরে’ শীর্ষক বর্ণাঢ্য আয়োজনের ভ্যানু হিসেবে নির্বাচন করা হয় পর্যটন নগরী ও চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল-কে। সে সময়ই আবু সিদ্দিক মুহাম্মদ মুসা অর্থাৎ সিদ্দিক চাচার সাথে বাংলানিউজের প্রেক্ষাপট ঘিরেই আরো বেশি ঘনিষ্ঠতা, অনেক বেশি আন্তরিকতার সূত্রপাত ঘটে। যদিও এর আগে থেকে উনার সাথে পরিবারিক পরিচয় ছিল। আমি প্রায় দু’ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলানিউজ টিম এর সহযোগিতায় ‘বছরজুড়ে দেশ ঘুরে’ এর শ্রীমঙ্গল প্রোগ্রামটি করতে সফলতা অর্জন করি। সেটি ছিল বাংলানিউজের দু’দিনব্যাপী সেই বর্ণাঢ্য বিশাল আয়োজন। মূলপর্বটি ২৪ জুলাই ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ‘বছরজুড়ে দেশ ঘুরে : সিলেটে পর্যটন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে। বেসমরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সিদ্দিক চাচার টি হ্যাভেন রিসোর্টে। এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানটি করতে বাংলানিউজের তৎকালীন এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন সহ বাংলানিউজ পুরো টিম-কে সিদ্দিক চাচা নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সেই ঋণে প্রথম আবদ্ধ হলাম। সে ঋণ থেকে আর বেরুতে পারলাম না।

সত্যিকারের একজন নম্র, ভদ্র বিনয়ী, নির্ভরযোগ্য এবং সাদামনের মানুষ ছিলেন সিদ্দিক চাচা। অহংবোধ, ঘৃণা, কটু কথা বলা কখনোই হৃদয়ে ধারণ করতেন না। সহাস্যে সবার সাথে মিশতেন। সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। অসম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন প্রতিমুহুর্ত। সামাজিক নানা কর্মকান্ডে জড়িত থেকে উদারতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। বরাবরই প্রশংসা করতেন আমার লেখালেখির। সবার সামনে ‘আমার ভাতিজা’ আমাকে বলে এতোটা আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরতেন যে, আমিই রীতিমত লজ্জা পেয়ে যেতাম।

সিদ্দিক চাচা আমাদের শ্রীমঙ্গলের নান্দনিক রিসোর্ট ‘টি হ্যাভেন রিসোর্ট’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। সেখানে বড় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেই অনুরোধ করে বলতেন - ‘একটা নিউজ করে দিও তো বাপন।’ অন্যান্যবারের মতো গত রবিবার (১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১) তারিখে উনার বিশেষ নিউজটিও বাংলানিউজে করলাম। তবে সেটি উনার সেই মনোরম, সুজ্জিত রিসোর্টের নয় –  উনার অনাকাঙ্খিত চিরপ্রস্থানের! কিন্তু আমার এ নিউজটি অন্যান্য নিউজগুলোর মতো উনি উনার জীবন্তচোখে আর দেখে যেতে পারেননি। একটু হেসে আর বলতে পারেননি - ‘নিউজটা ভালো হইছে বাপন’।... চাচা, আপনি না বললেও আমি কিন্তু আজ আপনার নিউজটি করে দিলাম!

মানুষকে 'মানুষ' জ্ঞানে ভালোবেসে বুকে টেনে নিতে সবাই পারে না। এ জন্য বড় একটি হৃদয়ের প্রয়োজন। সিদ্দিক চাচার সেটি বরাবরই ছিল। আসলে, সিদ্দিক চাচা একজনই হয়।