Cinque Terre

মোহাম্মদ আলী

০৯ নভেম্বর , ২০২১


কলামলেখক
বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুল ও প্রাসঙ্গিক কথা

আদালতের রায়ে ভূমিখেকো চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেল বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুলের জমি। সংবাদটি ভীষণ স্বস্তির। চালিবন্দরস্থ বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুলের ভূমির স্বত্ব দাবি করে দুই ব্যক্তির আনীত ভিত্তিহীন মামলাটি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আপীল ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারক শায়লা শারমিন কর্তৃক গত ৩১ অক্টোবর প্রদত্ত রায়ে খারিজ হয়ে যায়। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনীত সরকারের আপীল ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করে বাদীদের মূল মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। 

বসন্ত কুমার দাস সিলেটের এক কৃতি সন্তান। তিনি বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অকুতোভয় সেনানী ছিলেন। তিনি এজন্য জেল খেটেছেন। জননেতা হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। জীবনে তিনি কোনো দিন কোনো নির্বাচনে হারেননি। ১৯৩৭ সালে আসাম বিধান সভা স্থাপিত হলে তিনি তার প্রথম স্পীকার নির্বাচিত হন এবং একাধারে ১৯৪৬ সালের ১১ই মার্চ পর্যন্ত স্পীকার ছিলেন। পরে তিনি আসাম রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশ ভাগের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন সভায় বিরোধী দলীয় নেতা ও পরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী ও সর্বশেষে তিনি ফিরোজখান নূন মন্ত্রী সভায় কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা ও শ্রম মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রথম এশীয় সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। 

দেশের এই খ্যাতনামা ব্যক্তির বাড়ি ছিল সিলেট শহরের চালিবন্দর এলাকায়। ১ একর ৭৩ শতক আয়তনের এ বাড়িটিতে তিনি থাকতেন এবং তিনি আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বলে এখানে তাঁর চেম্বার ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তিনি সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন এবং সিলেট আইনজীবী সমিতির জন্য যে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় সে বরাদ্দ গ্রহিতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা। 

বসন্ত কুমার দাস চিকিৎসার জন্য ১৯৬০ সালের শেষের দিকে ভারতের কোলকাতা যান এবং বিভিন্ন ধরণের অসুখে আক্রান্ত হন। তিনি কোলকাতায় তার পুত্রের বাসায় ১৯৬৫ সালের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শত্রু সম্পত্তি আইন চালু হলে তার চালিবন্দরস্থ বাড়িটি শত্রু সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয়। বসন্তবাবু চিকিৎসার্থে ভারত যাওয়ার সময় তাঁর জুনিয়র আইনজীবী প্রয়াত সুধীরেন্দ্রনাথ অর্জুনকে এ বাড়িতে রেখে যান, যিনি অনেক ঝড় ঝঞ্জার মোকাবিলা করে সম্পত্তিটি রক্ষা করেন। 

বসন্ত কুমার দাস অসুস্থাবস্থায় থাকাকালে তার এদেশের সম্পত্তি জনহিতকর কাজের জন্য দান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন বলে চিঠিপত্রে জানিয়েছিলেন। সে প্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে এই বাড়িতে সিলেটের বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবী ব্যক্তিদের উদ্যোগে তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসন ও বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় সমূদয় অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্থ নিয়ে বসন্ত শিশু একাডেমী (বিশিকা) নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চারতলা দালান নির্মিত হয় এবং নাম পরিবর্তন করে ‘বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুল’ নামকরণ করা হয়। অবশ্য সড়ক প্রশস্থকরনের জন্য সরকার ৫০ শতক জমি অধিগ্রহ করে, বাকি জমি স্কুলেরই থাকে।    

এই ভূমি গ্রাস করার জন্য বিমল কুমার দাস ও নির্মল কুমার দাস নামে দুই ব্যক্তি বসন্ত কুমার দাসের ভাগিনা বলে দাবি করে। তাদের বক্তব্য ছিল বসন্ত কুমার দাস ১৯৮৫ সালে এদেশে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁর এক বোন ছিলেন। সেই বোনের ছেলে তারা। তাই তারা ভাগিনা হিসেবে বর্তমানে এ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এই মর্মে এ সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয়। ফলে তারা সম্পত্তির মালিক দাবী করে একটি দেওয়ানী মামলা করে। ওই মামলায় বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুল স্বেচ্ছায় বিবাদী শ্রেণিভুক্ত হয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করা অবস্থায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন জারি হওয়ার পর ওই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয়ে গেজেট প্রকাশিত হলে ওই দেওয়ানী মামলা আপনা আপনি অকেজো হয়ে পড়ে। 

কিন্তু ওই দুই ভাই নতুন ছক আঁকেন। তারা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইনের আওতায় স্থাপিত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। তাছাড়া স্কুলকে পক্ষভুক্ত না করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন ট্রাইব্যুনালে ২০১২ সালের ৩২৭ নম্বর মামলা করেন এবং স্কুল কমিটির অজ্ঞাতে ১৯২০ সালে একটি ডিগ্রিও হাসিল করে নেন। 

এতে সরকার পক্ষ থেকে রীতি অনুযায়ী আপীল দায়ের করা হয়। আপীল দায়েরের পর বিষয়টি স্কুল কমিটি জানতে পারলে সাবেক সাংবাদিক সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী তবারক হোসেইনকে বিষয়টি জানালে তিনি স্কুলের সম্পত্তিটি ভূমিখেকোদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। তাই তিনি এ সম্পত্তি ভূমিখেকোদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর মাধ্যমে বসন্ত কুমার দাসের মৃত্যুর পর ১৯৬৫ সালের ২৩ শে জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় গৃহীত শোক প্রস্তাবের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করেন। তা’ছাড়া স্কুলে সংরক্ষিত ১৯৬৫ সালের ২৩শে জানুয়ারি প্রকাশিত জনশক্তি পত্রিকার কপি, অন্য একটি মামলার আরজি জবাবের জাবেদা নকলসহ বিভিন্ন মূল্যবান দলিল সংগ্রহ করে অর্পিত সম্পত্তির সরকারি আইনজীবী আব্দুল কুদ্দুসকে অতিরিক্ত সাক্ষ্য প্রদানের জন্য তাকে স্বাক্ষী মানার অনুরোধ করলে, তিনি তন্মর্মে দরখাস্থ করেন। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আপীল আদালতের তৎকালীন মাননীয় বিচারক তা মঞ্জুর করেন। এ সময় সিলেট জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী প্রশান্ত কুমার পালও এ ব্যাপারে সহায়তায় এগিয়ে আসেন। 

আদালতের দেওয়া তারিখ অনুযায়ী গত ১৮ই মার্চ অ্যাডভোকেট তবারক হোসেইন সাক্ষ্য প্রদান করেন এবং মূল্যবান দলিলাদি পেশ করেন। তাকে ২২ ও ২৩ মার্চ দুই দিন জেরা করা হয়। তারপর করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে আদালতের কাজ কিছুদিন বন্ধ হয়ে পড়ে। পরে গত সেপ্টেম্বর মাসে আপীলের যুক্তিতর্ক শুনানী শেষ হয়। গত ৩১ অক্টোবর (৩১/১০/২০২১ ইং) আপীল আদালত রায়ের জন্য তারিখ রাখেন। সে অনুযায়ী প্রদত্ত রায়ে আদালত আপীল মঞ্জুর করেন এবং বিমল-নির্মলদের মামলা খারিজ করে  দেন। ফলে বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুলের সম্পত্তিটি ভূমিখেকোদের হাত থেকে রক্ষা পায়। 

উল্লেখ্য যে, যদিও মামলার বাদী ছিল বিমল কুমার দাস ও নির্মল কুমার দাস কিন্তু তারা কোনোদিন আদালতে আসেননি। তাদের বাড়ি নবীগঞ্জ উপজেলায়। বিশ্বনাথ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. আজমল আলী, ওসমানীনগর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের সিরাজ উদ্দীন তাদের পক্ষে আম-মোক্তার হিসাবে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং আদালতে সিরাজ উদ্দীন বাদীগণের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা ভূমিখেকো একটি শক্তিশালী চক্র ওই দুইজনকে শিখন্ডি হিসেবে ব্যবহার করে ভূয়া কাহিনীর অবতারনা করে এ মামলাটি দায়ের করে। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলের এ ভূমি গ্রাস করা। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। রক্ষা পেল বসন্ত কুমার দাসের স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যালয়টি।