Cinque Terre

শামস শামীম

২৪ এপ্রিল , ২০২০


কবি, সাংবাদিক


এখন হাওরে নারী ও শিশু

হাওরে হলুদ ধানের ঢেউ মনে দোলা দিলেও শান্তি নেই চাষীদের মনে। সাড়ে তিন লাখ চাষী পরিবারের ক্ষেতের প্রায় ৯০ ভাগ ফসল পেকেছে। কিন্তু শ্রমিক নেই ধান কাটার। কালবৈশাখি ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাত আতঙ্কের মধ্যে মহামারি করোনায় আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই স্থানীয় শ্রমিকরাও আসতে ভয় পাচ্ছেন। এই অবস্থায় কৃষকরা কষ্টের ফসল মাঠে ফেলে রাখতে চাননা। হাওরের পাকা ধান গোলায় তুলতে পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশুরাও এখন হাওরে নেমেছে। করোনার ভয় তাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। 

দেখার হাওরের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখলাম, পুরুষের সঙ্গে সমানতালে মাঠে কাজ করছেন নারী ও শিশু। পুরুষরা ধান কাটলেও নারীরা মেশিনে মাড়াই, খড় নাড়া, ধানখলা তৈরি, ধান শুকানোসহ নানা কাজ করছেন। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা। শুধু চাষী পরিবারের নারীরাই নন শ্রমজীবী নারীরা কাজে নেমেছেন হাওরে।

কৃষকরা জানান, বৈশাখী মওসুমে ধান কাটার সময় হাওরের চাষী পরিবারের নারী পুরুষ সাধারণত বাড়িতে থাকেন না। পুরুষরা হাওরের ভিতরে ধান কাটার কাজ করেন। নারীরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই ধান মাড়াই, গবাদিপশুর জন্য খড় সংগ্রহ, ধান শুকানো, খলাঘর তৈরিসহ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিবারের পুরুষদের সহযোগিতা করেন। অনেক নারী পরিবারের পুরুষের সঙ্গে হাওরের কান্দায় সাময়িক তৈরি খলাঘরেও অবস্থান করেন। কৃষক পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্র ও শ্রমজীবি পরিবারের নারীরাও শ্রমিক হিসেবে হাওরে নেমে কাজ করতে দেখা গেছে। 

দেখার হাওরের কান্দিগাও গছিলাড়া কান্দায় গিয়ে দেখি, স্কুল পড়–য়া সন্তান নিয়ে ধানখলায় কাজ করছেন কিষাণী গুলজাহান বেগম। তার স্বামীও পাশে হাওরে শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করছেন। ধানখলা তৈরির পাশাপাশি তিনি মাড়াই মেশিনে ধানের মুঠোও এগিয়ে দিচ্ছিলেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করছিল স্কুলপড়–য়া ছেলে রিপন মিয়া।

গুলজাহান বেগম বলেন, পরতিবারই হিলে পাইন্যে ধান নেয়। সুদে ঋনফিন আইন্যা ধান লাগাইয়া পোষেনা। আমরার এইন আর কুন্তা ছিননইন্যা করিই বাপদাদার হিকানো কৃষি খাজ করইন।

খেতো ধান পাইক্যা রইছে। কিন্তু খাটবার মানুষ পাইনা। এখন আর বেফারি আয়না। আর ইবার করোনার লাগি খেউ নামতো ছায়না। ইতার লাগি খয়েকজন খামলা জোগার কইরা এখন ফুয়াফুরুতা লইয়া আউরো নামছি। (প্রতি বছরই বন্যায়-শিলায় ধান নষ্ট হয়। সুদে ঋণ এনে ধান লাগিয়ে আর পোষাচ্ছেনা। আমার স্বামী আর কিছু জানেননা বলেই বাপদাদার শিখানো কৃষিকাজই করেন। ক্ষেতে ধান পেকে আছে। কিন্তু কাটবার মানুষ নেই, শ্রমিক আসেনা। কয়েকজন শ্রমিক জোগাড় করে এখন ছেলে মেয়ে নিয়ে নিয়ে হাওরে নেমেছি।)

ঝাউয়ার হাওরের কালিপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ২০-৩০ জন নারী কাজ করছেন। কেউ খলাঘর প্রস্তুত করছেন। কেউ ধানমাড়াই মেশিনে কাজ করছেন। কেউ ধানের খড় ও ধান শুকানোর কাজও করছেন। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে স্কুল পড়–য়া সন্তানরাও।

কালিপুর গ্রামের কিষাণী মরিয়ম বিবি ধানখলা প্রস্তুত করছিলেন পরিবারের আরেকজন নারীকে নিয়ে। মরিয়ম বিবি বলেন, ‘পুত ও আর পুতের বাপে গ্যাছে ক্ষেতে ধান কাইটতো। আমি অন্নে খলা লেফাফোছা করতাছি। ধানফান না তুলতে পারলে আনা খাইয়া মইরতে অইব বাবা। ইতার লাগি রইদ্যের মাইঝেও বাড়িত্যে আউরো আইছি। (ছেলে আর ছেলের বাবা গেছে হাওরে ধান কাটতে। আমি এখন ধানখলা লেপতে এসেছি। ধান না তুলতে পারলে না খেয়ে মরতে হবে বাবা। এজন্য রোদের মধ্যেও বাড়ি থেকে হাওরে এসেছি।)

ওই কৃষক পরিবারের নারীর কাছ থেকে একটু আগানোর পরই দেখা গেল শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন কালিপুর গ্রামের শ্রমজীবী নারী রুনা বিবি, বানিজা বিবি, শিল্পি বেগম, রোকসানা বেগম, গুলবিবিসহ কয়েকজন। তারা হাওরে মাড়াই মেশিনে ধান ভাঙ্গানো, ধান বস্তায় ভরে বহন করা ও গবাদিপশুর জন্য ধানের খড় শুকাতে রোজগার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসেছেন। এই নারীরা জানালেন সরকার করোনার কারণে প্রবল শ্রমিক সংকট দেখা দেওয়ায় শ্রমিকদের যে ত্রাণ সহায়তায় আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তাতে তাদের কারো নাম নেই। 

দিনমজুর গুল বিবি জানান, তার স্বামী হাওরে ধান কাটতে নেমেছেন। তিনি এসেছেন গৃহস্থের ধান ভাঙ্গানো, শুকানো, খড় নাড়ার কাজে। স্বামী স্ত্রী দিনমজুরি করে যা পাবেন তা দিয়েই ৬ সন্তানের মুখে আহার জোগাবেন। স্বামী স্ত্রী দু’জনই হাওরে কাজে নামলেও তাদের কেউ সরকারি সহায়তা পাননি। তার সঙ্গে হাওরে কাজে নামা অন্য নারীরাও কোন সহায়তা পাননি বলে জানান তিনি। 

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে জেলার হাওরে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির মধ্যে এ পর্যন্ত ৫ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশে গত বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত বাইরের জেলার ৩ হাজার ৯০৪ জন শ্রমিক ধান কাটতে এসেছেন। বাইরের জেলার আরও সাড়ে ৮ হাজার শ্রমিক বিভিন্ন হাওরে ধান কাটতে আসবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে ১৭ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত হাওর এলাকায় ভারী বর্ষণের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এই সময়ে হাওরে প্রায় ২২০ মি.মি. বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন বলেন, হাওরের ধান পেকে গেছে। চাষীর সঙ্গে তাদের পরিবারের লোকজনও মাঠে নেমেছে। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশে এবার বাইরের জেলা থেকেও প্রায় চার শ্রমিক হাওরে এসেছে। আরও সাড়ে ৮ হাজার শ্রমিক আসার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনার কারণে শ্রমিক সংকটের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে আছেন হাওরের চাষীরা জানান তিনি। তিনি আরও জানান, পুরো ফসল গোলায় ওঠলে সুনামগঞ্জের হাওর থেকে এ বছর প্রায় ১০ লাখ মে.টন চাল পাওয়া যাবে। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অর্ধেকের বেশি উদ্ধৃত্ত থাকবে।