Cinque Terre

হামিদ মোহাম্মদ

২৪ নভেম্বর , ২০২১


প্রাবন্ধিক
সিলেটে হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হক বড় লেখক। তিনি গত ১৫ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। তবুও ‘ছিলেন’ শব্দটিও লিখতে পারিনি। কেননা, তিনি আছেনটাই মূলত সত্যÑজ্বলন্ত, দীপ্যমান। তিনি ‘নাই’ বা ছিলেন লেখার সাহস অন্তত আমার নেই। এর পর, ‘বড়’ শব্দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো শব্দ আমি খুঁজে পাইনি। তাঁর সম্পর্কে এ শব্দটি-ই আমি শ্রেষ্ঠ ভেবেছি। মনে করি এই ভালবাসা-ই তাঁর একান্ত প্রাপ্য।

জন্মেছিলেন বর্ধমানে। বর্ধমান আমাদের ভাগে পড়েনি, পড়েছে ভারতে কিন্তু বর্ধমান তাকে আটকাতে পারেনি, তিনি আমাদের ভাগে পড়েছিলেন। বাংলাদেশকে ভালবেসে বড় হয়েছেন, যৌবন থেকে শেষবধি এই ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন আমাদের। তাই, বাংলাদেশে ‘তাঁর জীবন’ ছিল জীবন্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন দর্শনশাস্ত্র। ভয়ানক মিতভাষী, কিন্তু আড্ডা দিতেন, আড্ডাবাজ লোক। মানুষের সংস্পর্শে সময় কাটাতে ভালবাসতেন, ছুটে যেতেন যেখানেই মানুষ তাঁর খোঁজ নিতেন, সেখানে।

সিলেট ছিল তাঁর এমনি এক ভালবাসার  জায়গা। বেশ কয়েকবার এসেছেন সিলেটে। প্রথম এসেছেন ১৯৯৫ সালে এপ্রিল মাসে। সিলেটে ১৮ এপ্রিল ছিল দেশবরেণ্য কবি  শামসুর রাহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অতিথি ছিলেন তিনি। উঠেছিলেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে। থেকেছেন কয়েকদিন। তাঁর বন্ধুসারথি শিক্ষক ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী তখন ছিলেন এ শিক্ষাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যলয়ে প্রায় আধডজন উজ্জ্বল গুণী শিক্ষক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা স্বজন। তাদেরই আলো-করা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর আগ্রহের স্থান। তাই, আয়োজকদের অনুমতি নিয়েই তিনি মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে ওঠা সিলেটের তখনকার এই ক্যাম্পাসে মন জুড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাই, বন্ধু-সতীর্থদের সান্নিধ্যলাভ থেকে বঞ্চিত হতে চাননি। 

সিলেটের লেখক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মীরা এ সময় প্রত্যক্ষ করেন অজস্ত্র স্বপ্নভরা একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে। মানুষের ভিড়ে সিলেটে কাটান আড্ডা দিয়ে। ঘুরে দেখেন সিলেটের অলিগলি, প্রবাসীদের ঘামেভেজা নগরী। শিশুর সারল্যে ভরা প্রাণোজ্জ্বল হাসান আজিজুল হক মানুষকে কতটা আপন হতে পারা বা  ভাবা যায়, তা শিখিয়ে যান সেদিন। তবে কাক্সিক্ষত শামসুর রাহমান সংবর্ধনা অনুষ্ঠান তখন অনুষ্ঠিত হয়নি। মৌলবাদীদের বিশৃঙ্খলার মুখে পরিত্যাক্ত হয় আয়োজনটি। এ লজ্জা নিয়েও সিলেটবাসী হাসান আজিজুল হককে পূর্ণ মর্যাদায় আতিথ্য দিয়েছেন। 

এরপর ২০১২ সালে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে আসেন  সিলেটে। তাঁকে সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে এ সময় নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। ৯ মার্চ সিলেট নগরের শাহী ঈদগাহর সন্নিকটে বালুচর পাহাড়টিলা বেষ্টিত নয়নাভিরাম সবুজ প্রকৃতির কোলে নবনির্মিত সিলেট শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের গুণীজনরা। জনাকীর্ণ আয়োজনে এসেছিলেন ও বক্তব্য রেখেছিলেন কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ। সংবর্ধিত অতিথি হাসান আজিজুল হককে সিলেটবাসী সেদিন অন্তরছোঁয়া ভালবাসামÐিত মানপত্র প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যলয়ের তখনকার উপাচার্য শিক্ষাবিদ ও সংবর্ধনা  কমিটির সভাপতি প্রফেসর মো. সালেহ উদ্দিন। সংবর্ধনা আয়োজক কমিটির সচিব ছিলেন কবি শুভেন্দু ইমাম এবং যুগ্ম সচিব ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী মইনুদ্দিন আহমদ জালাল ও লোকসাহিত্য গবেষক সুমনকুমার দাশ। সংবর্ধনা উপলক্ষে কবি শুভেন্দু ইমাম সম্পাদিত একটি স্মারক সংকলন বের হয়। এতে লিখেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ শিবনারায়ন রায়-‘হাসান আজিজুল হক-এর ‘সক্রেটিস’ ও ‘চালচিত্র খুঁটিনাটি’। দেবেশ রায় লিখেনÑ‘হাসান ভাই, আমার যে ডাকতে ভালো লাগে’। সাধন চট্টোপাধ্যায় লিখেনÑ‘একটি ভুখÐের জন্ম’। আসাম থেকে তপোধীর ভট্টাচার্য লিখেনÑ‘হাসান আজিজুল হকের নিজস্ব উপনিবেশ’। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে হাসান ফেরদৌস লিখেন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ: ফিরে দেখা’। কবি জফির সেতু লিখেন ‘হাসানের দেশ, হাসানের মানুষ’। কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা লিখেন ‘দ্রোণার্য হাসান আজিজুল হক’। এছাড়া প্রাককথন লিখেন সম্পাদক কবি শুভেন্দু ইমাম। এই সংকলনটি ভারত ও বাংলাদেশে প্রশংসিত হয়। প্রাককথনে শুভেন্দু ইমাম লিখেনÑকথাসাহিত্যিক কায়েস আহমদ এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনÑ‘ ক্ষমাহীন বিশ্বের স্থপতি’। 

প্রাককথনে শুভেন্দু ইমাম লিখেছেন, ‘কী ছিল হাসানের মধ্যে? আসলে তিনি কখনো চাপিয়ে দিতেন না তাঁর মত’। আরো লিখেছেন,‘ হাসান আমার এবং আমার বন্ধুদের পাঠরুচি তৈরি করতে প্ররোচিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার চিরকালের অন্যতম প্রধান গদ্যলেখক হাসান আজিজুল হক’। 

যারা-ই তাঁর কাছে ভিড়েছে, তারাই উপলদ্ধি করেছেনÑহাসান আজিজুল হক সর্বক্ষেত্রেই পাঠক সৃষ্টি করতে প্রয়োজনে তরুণদের সাথেও বন্ধুত্ব করতেন, সকলের কথা শুনতেন, বুঝবার চেষ্টা করতেন। 

এই অর্থেÑ‘ক্ষমাহীন বিশ্বের স্থপতি’ বা ‘বাংলার চিরকালের অন্যতম প্রধান গদ্যলেখক হাসান  আজিজুল হক’ এটাই প্রতিপাদ্য। গীতিকবি শেখ রানার এক  পোস্টে মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর হাস্যরস করা মন্তব্যের কথা লিখেছেন, ‘যতদিন বেঁেচ আছি, ততদিন কিছুতেই মরব না।’ হাসান আজিজুল হক এ যেন  মৃত্যুকেও শিল্প হিসেবে দেখতেন। 

তাঁর তিরোধানের পর, তাকে অনেকে সোস্যাল মিডিয়ায় তাঁর বইয়ের অসামান্য নামে বিশেষ অভিধায় ‘আগুন পাখি’ কিংবা ‘জীবন ঘষে আগুন’ বলে উল্লেখ করছেন। আসলেই এই ‘আগুন পাখি’ ৮২ বছর আমাদের পাশে ছিলেন, এখন আড়াল হয়েছেন মাত্র, নেই বলতে অনেক দেরি। জন্মেছেন ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রæয়ারি।

‘সিলেট ভূমি’ গত শতকের প্রথিতযশা দেশবরেণ্য ও বিশ্বনন্দিত  কবি সাহিত্যিকদের  সংবর্ধনা দিয়ে তার অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করেছে অতীতে। আর হাসান আজিজুল হককে সংবর্ধনা দেবে না? এ হতে পারে না। এ গøানির মালা গলায় নিতে চায় না সিলেট। এর আগে সংবর্ধিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্ধোপাধ্যায়, বিভুতিভূষণ বন্ধোপাধ্যায় ও মানিক বন্ধোপাধ্যায়। বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হককে সংবর্ধনা প্রদানের মাধ্যমে সিলেটে আরেকটি পালক যুক্ত হল ৯ মার্চ ২০১২। 

হাসান আজিজুল হক এই সফর সময়ে সিলেট থেকে আমন্ত্রিত হয়ে যান শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর সাহিত্যকৃতীর জন্য তাকে ‘ডক্টর অব ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেখানে গুণীজন দ্বারা বন্দিত হন। তৎকালিন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনাকীর্ণ সমাবেশে সম্মাননা সনদ তখন তাঁর হাতে তুলে দেন। এই সফরকালে হাসান আজিজুল হক সিলেট ও শিলচরে সাহিত্যবন্ধুদের সাথে আড্ডায়, গল্পে ও আনন্দে কাটান কয়দিন। 

২০১৪ সালে  আবার আসেন হাসান আজিজুল হক সিলেটে। এবার আসেন সিলেটের আরেক নক্ষত্র গণসঙ্গীত লেখক  ও কবি আবদুল গাফফার দত্ত চৌধুরীর স্মারক বক্তৃতামালার স্মারক বক্তা হিসেবে। বিষয় ছিল: ‘বাঙালির সংস্কৃতির খোঁজে’। এ বক্তৃতামালার আয়োজক ছিল সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। গত এক দশক যাবৎ প্রতি বছর এ বক্তৃতামালায় স্মারক বক্তব্য রাখেন উপমহাদেশের গুণীজনরা। 

এছাড়া আরো কয়েকবার হাসান আজিজুল হক সিলেটের মাটির টানে ছুটে এসেছেন,  সিলেটের তরুণ লেখক ও সংস্কৃকির্মীদের নিয়ে আসর পেতে আড্ডা মেরেছেন রাতদিন। সিলেট এলেই কবি শুভেন্দু ইমামের ‘বইপত্র’ নামক বইয়ের দোকানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেতেন বিরল বই। বই যেন তাঁর শান্তির বাগান। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বইয়ের আড়ং’ বিশ্ববিদ্যলয় লাইব্রেরী প্রাঙ্গনে তিনি এখন শায়িত আছেন। আজ বার বার মনে হচ্ছেÑআমাদের জন্য মাটির তলে তিনি আরেক লাইব্রেরি যেন, সাহিত্যের শিল্পনগর। সবশেষে বলতে দ্বিধা নেইÑপ্রয়াত হাসান জীবিত হাসানের চেয়ে বেশিদিন বাঁচুন।