Cinque Terre

কামাল চৌধুরী

১৫ অগাস্ট , ২০২২


প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্যসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী স্লোগান

ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ১৯৭৬ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময়ের বাংলাদেশ ছিল এক আতংকিত জনপদ। পচাত্তরের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, গৌরব সবকিছু তখন ভূলুণ্ঠিত। সামরিক শাসক এবং হত্যাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি জেঁকে বসেছে জাতির ঘাড়ে। শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতিকেউ কথা বলার সাহস করছে না। এমনই এক ভয়াল সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বঙ্গবন্ধুর এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জমা হয়েছিল হৃদয়ে। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না এই হত্যাকাণ্ড। বুকের ভেতর তীব্র প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল, প্রতিবাদী হয়ে উঠছিল মন। কিন্তু সময় প্রতিকূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘাতকরা তৎপর- ছাত্রদের মধ্যেও তারা পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেছে প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে তখন কয়েকটি চায়ের দোকান ছিল। এর মধ্যে শরিফ মিয়ার দোকানটি ছিল সবচেয়ে জমজমাট। কারণ এখানে ষাটের দশকের কবিরা আড্ডা দিতেন। তার পাশেই ছিল গফুর মিয়ার দোকান। আমরা সত্তরের দশকের তরুণ কবি-লেখকেরা গফুর মিয়ার দোকানে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু থাকতাম ফজলুল হক হলে। প্রতিদিন সকালে কলাভবনে এসে যোগ দিতাম আড্ডায়- সারাদিন চা সিগারেট, এককাপ চা কয়েকজনে ভাগ করে খাওয়া, এভাবেই সময় যাচ্ছিল। আমাদের আড্ডায় তখন সমসাময়িক কবি-লেখক ছাড়াও অগ্রজ লেখকরাও যোগ দিতেন মাঝে মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাঁরা প্রত্যেকেই গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন বাংলা বিভাগের ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মোহাম্মদ হায়দার আলী। হায়দার ভাই আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। থাকতেন হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলে। তিনি এক সময় ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সব সময় পাজামা পাঞ্জাবি পরে থাকতেন। সত্যিকারের একজন ত্যাগী ও সাহসী নেতা ছিলেন তিনি। হায়দার ভাই পরবর্তীতে ভাঙ্গা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এখন প্রয়াত। কবি জাফর ওয়াজেদ আমার অত্যন্ত প্রিয়বন্ধু; ঢাকা কলেজে আমরা ছিলাম সহপাঠী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাফর ভর্তি হয় বাংলা বিভাগে। জাফর ১৯৭৮ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। পরের বছর সে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়। 

১৯৭৭ সালের শেষদিকের ঘটনা। তারিখটা আজ আর মনে নেই। আমি আর জাফর ওয়াজেদ আড্ডা দিচ্ছিলাম গফুর মিয়ার দোকানে। আলোচনা করছিলাম বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে কী করা যায়। সে সময়ে আমার মাথায় একটা চিন্তা আসেএকটা স্লোগান লিখলে কেমন হয়! এই ভেবে আমি লিখলামমুজিব লোকান্তরে/মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’ স্লোগানটি। জাফর স্লোগানটা পছন্দ করল। আমরা ঠিক করলাম স্লোগানটি হায়দার ভাইকে দিতে হবে। কারণ, হায়দার ভাই ছিলেন চিকা মারায় (দেয়াল লিখন) ওস্তাদ। সে দিনই লেখাটি হায়দার ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, সুন্দর করে স্লোগানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লিখে দিন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে হায়দার ভাইয়ের ঝকঝকে হাতের লেখায় ফুটে উঠল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী স্লোগান

‘মুজিব লোকান্তরে

মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে।’

পরবর্তী সময়ে স্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৯ সালের ছাত্রলীগের সংকলনের নাম করা হয় মুজিব লোকান্তরে মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব বাহলুল মজনুন চুন্নু। পরে স্লোগানটি ‘এক মুজিব লোকান্তরে /লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরেএভাবেও প্রচার লাভ করে। আজ যখন ভাবি, সেই দুঃসময়ের সাহসী এ কাজের কথা, তখন আবেগে উদ্বেলিত হই। কবিতার আবেগ আমাকে প্রবলভাবে সাহসী করে তুলেছিল। হত্যার বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ঘাতক কবলিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাবার এই দুঃসাহস আজও আমার অহংকার। 


এএফ/০৫