Cinque Terre

নাওয়াজ মারজান

২২ অগাস্ট , ২০২২


লেখক, ডিজাইনার
ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনিদের এত ঘৃণা করে?

মূল: মারওয়ান বিশারা ।  অনুবাদ : নাওয়াজ মারজান


ইসরায়েলকে ঘৃণা করার জন্য ফিলিস্তিনিদের যথেষ্ট কারণ রয়েছে; ইসরায়েল এমন এক ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী রাষ্ট্র যা ফিলিস্তিনিদের জন্ম ভূমির ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত। এই বসতি স্থাপন করতে গিয়ে তারা ফিলিস্তিনিদের জীবন ও জীবিকার নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছে, মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, বর্বর সন্ত্রাসীযজ্ঞ চালিয়েছে, অবরুদ্ধ করেছে, বন্দি করেছে। তবু এই নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের কেনো এত ঘৃণা? আমার কাছে এটাও যথাযথ উত্তর মনে হয় না যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওইসব ‘সহিংসতা’ বা ‘সন্ত্রাসের’ জন্য ঘৃণা করে, যা ইসরায়েলে আঘাত করেছে। হ্যাঁ, ফিলিস্তিনিরা সহিংসতা চালিয়েছে বটে, কিন্তু ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কাছে তা খুবই নগণ্য। এটা ইসরায়েল নিজেও জানে। গত সপ্তাহে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলাও তার সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে। 

আমার মনে হয়, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের এই ঘৃণার পেছনে তিনটি মৌলিক উপাদান কাজ করছে; ভয়, হিংসা ও ক্রোধ। ভয় হচ্ছে তাদের ঘৃণার প্রধান কারণ। যদিও এটা শুনতে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা তা-ই।

অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সমস্ত ভূমি দখল ও পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। এই ভয় নিছক শারীরিক বা বস্তুগত নয়, এটি অস্তিত্বগত। (সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হবার পরও যে ভয় তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।)

২০১৪ সালে ইসরায়েলি লেখক (তাল নিভ) ‘হোয়াই অল ইসরায়েলিস আর কাওয়ার্ডস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। যেখানে বিস্ময়ের সঙ্গে বলছেন, ইসরায়েল এমন একটি ‘কাপুরুষ’ সেনাবাহিনী তৈরি করেছে, যারা দূর থেকে গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে। এর চার বছর পর ২০১৮ সালে সুরক্ষিত প্রতিরক্ষার আঁচলে লুকিয়ে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনা সত্যিই অবাস্তবের মতো লেগেছে। ইসরায়েল বাহিনী ২০০৫ সালে গাজা থেকে পালিয়েছে ভয়ে। এরপর গাজার ২০ লাখ ফিলিস্তিনিদের ওপর তারা অমানবিক অবরোধ আরোপ করে।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা, ঐক্য, গণতন্ত্র, কবিতা এবং ভাষাসহ সকল জাতীয় প্রতীককে ভয় পায়। ফিলিস্তিনিদের এই প্রতীকগুলো মুছে দেওবার চেষ্টা তারা ক্রমাগত করে যাচ্ছে। পতাকা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনি নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার হারকে তারা ভীষণ ভয় পায়, যাকে তারা ‘জনসংখ্যাগত হুমকি’ বলে থাকে। ১২ বছর আগে এক ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ সতর্ক করে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের বংশবৃদ্ধি ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য ইরানের পারমাণবিক বোমার মতো হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাঁর মতে, ২০৪০-৫০ সালে ফিলিস্তিনিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারে।

ইসরায়েলের মতো গ্যারিসন রাষ্ট্রের জন্য এমন ‘ভয়’ সহায়ক (রাজনৈতিক উপাদান)। মার্কিন এক সাংবাদিক ইসরায়েলে কাটানো কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় তার বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘সরকার ভয় জাগিয়ে তোলে, যা মূলত কাল্পনিক এবং অতিরঞ্জিত। ইসরায়েল রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ এবং হুমকির মুখে থাকা ছোট একটি দেশ হিসেবে চিত্রিত করে। ভয় ঘৃণার জন্ম দেয়।’

ইসরায়েলি এক গবেষকের ভাষায়, যে রাষ্ট্র সবসময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকে সে কখনো মুক্ত হতে পারে না। কোনো অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে চালানো সামরিক মেসিয়ানিজম ও বর্ণবাদী তাৎপরতার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারে না।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর ক্ষুব্ধ। হাল ছেড়ে না দেওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ, পরাজয় না মানার জন্য ক্ষুব্ধ, সরে না যাওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ। ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল যে সমস্ত অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল, সবগুলোতে তারা জয়ী হয়েছে। আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠেছে। আরব রেজিমদের অপমানিত করে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বশ্যতা স্বীকার করেনি, আত্মসমর্পণ করেনি। উলটো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যদিও ইসরায়েল ফিলিস্তিনের এই কৃতিত্ব ও গৌরবকে সবসময় অস্বীকার করে আসছে।

ইসরায়েলের পাশে রয়েছে বিশ্বশক্তি, পকেটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পেছনে ইউরোপ, নতজানু আরব। কিন্তু ক্ষত-বিক্ষত ফিলিস্তিনিরা এখনও ইসরায়েলের সামনে তাদের মৌলিক অধিকার ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে, পরাজয় স্বীকার করে না। ইসরাইলের হাতে লেগে থাকা নিরপরাধ মানুষের রক্তের দাগ ফিলিস্তিনিদের আরও সংক্ষুব্ধ করে তুলে। বছরের পর বছর চলমান হত্যা, নির্যাতন, শোষণ ও লুণ্ঠনের উৎসবে মেতে থাকা ইসরায়েলের কাছে মাথা নত করেনি তারা। লাখ-লাখ মানুষ বন্দি করে পাশবিক নির্যাতনেও দমে যায়নি ফিলিস্তিনিরা। তাই নিজেদের টিকিয়ে রাখার উন্মত্ততায় দিনদিন অমানবিক সহিংসতা বাড়াচ্ছে ঔপনিবেশিক ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনিদের অভ্যন্তরীণ শক্তি এবং বাহ্যিক অহংকারে ঈর্ষান্বিত ইসরায়েল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ফিলিস্তিনিদের দৃঢ় মনোবল ও ত্যাগে বিস্মিত তারা। এসব সম্ভবত আজকের ইসরায়েলিদের প্রথম দিকের জায়নবাদীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইসরায়েলের দক্ষ-প্রশিক্ষিত-সশস্ত্র বাহিনীর সাঁজোয়া যানের সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ রুখে দিতে আড়াল থেকে কাপুরুষোচিত বুলেট ছুঁড়ে ইসরায়েল বাহিনী।

ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি ঈর্ষান্বিত ইসরায়েল। ভূমির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দেখে ঈর্ষান্বিত। ইহুদিদের ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনে প্রলুব্ধ করার জন্য জায়নবাদকে একটি লিগ্যাচার তৈরি করতে হয়েছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিদের ঘৃণা করে কারণ এই ভূখণ্ডকে তারা নিজেদের ভূমি মনে করে। যদিও ইতিহাস, ভূগোল ও প্রকৃতি ইসরায়েলের এই দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দেয় না। ইসরায়েল দীর্ঘকাল ধরে তার অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ধর্মতত্ত্ব এবং পুরাণকে ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এমন প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হয় না। এই ভূমিতে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের ইতিহাস প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত।

ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে চেষ্টা করছে ইসরায়েল, এমনকি রাস্তা-মহল্লা এবং শহরের নাম পরির্তন করছে। ইসরায়েলি এক ঐতিহাসিকের ভাষায়, ‘উপাসনালয়গুলো পুনঃসংশোধনের জন্য তার হুবহু ধারণা পেতে কোনো ব্যক্তিকে ১৫ শতকের শেষের দিকে স্পেন বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ফিরে যেতে হবে।’ 

ইসরায়েল ফিলিস্তিদের ঘৃণা করেজায়নবাদের ভিত্তি এর জীবন্ত প্রমাণ। ভ‚মিহীন ইহুদি জাতি পৌরাণিক দোহাই ও সন্ত্রাসী কাণ্ডের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে উপনেশবাদী বসতি স্থাপন করে। পুরো মাণচিত্র গ্রাস করে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব মুছতে ফেলতে গেলে বাঁধা প্রদান করার কারণে তাদের ঘৃণা করে। বিশেষ করে গাজায় বসবাসকারীদের প্রতি তাদের ঘৃণার মাত্রা বেশি। কারণ তারাই ইসরায়েলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রধান বাঁধা।

এই ঘৃণাচর্চাকে ইসরাইয়েল যদি এখনও মহিমান্বিত ভাবে, তাহলে ভুল করবে। ভালোবাসা সবসময় ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী। ঘৃণা ধ্বংসাত্মক, তা আরও ঘৃণার জন্ম দেয়। ঘৃণা বিদ্বেষী এবং বিধ্বংসী। ইসরায়েল ইচ্ছে করলে সবকিছু বদলে দিতে পারে। ঘৃণাকে সহনশীলতায়, হিংসাকে প্রশংসায় এবং ক্রোধকে সহানুভ‚তিতে পরিণত করতে পারে। যদি তার সহিংস অতীতের প্রায়শ্চিত্ত করার সাহস থাকে, অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়, ফিলিস্তিনিদের কষ্টের ক্ষতিপূরণ দেয় এবং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার শুরু করে। নাগরিক হিসেবে সমান মর্যাদা ও স্বভ‚মিতে তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে। ইসরায়েলের ঘৃণা ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেবে না, কিন্তু ইহুদিদের তাড়িয়ে দিতে পারে।

[ইংরেজি থেকে অনূদিত]

মারওয়ান বিশারা : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস।