Cinque Terre

নিলুফা আক্তার

১৮ অক্টোবর , ২০২২


অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
রাসেলের সুতীব্র চিৎকার : নিরাপদ হোক শিশুর বেঁচে থাকা

ছাড়পত্র কবিতায় নবজাতকের জন্মগত অধিকার এবং নিরাপদ পৃথিবীর দাবি জানিয়েছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন-

‘যে শিশু ভুমিষ্ঠ হল আজ রাতে

তার কাছে খবর পেলুম

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকার।’

রাসেলও সুতীব্র চিৎকার, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে ব্যক্ত করেছিল তার জন্মগত অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, হ্যাঁ নিরাপদ পৃথিবীর অধিকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু লড়াই করে আদায় করেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানো মাটি ও মানুষের যৌক্তিক দাবি। বাংলাদেশে নামক ভূ-খন্ড নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এর সেই কালোরাতে স্বাধীনতা বিরোধী দেশদ্রোহী মীরজাফরদের হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার, দেশনায়ক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার, অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান দেশরত্ম দুই কন্যা। স্বপরিবারে শহীদ হয়ে তিনি দেশপ্রেমের চরম মূল্য দেন। এই নিষ্ঠুরতার এখানেই শেষ নয়। নৃশংস জানোয়াররা অবুজ রাসেলকে তার অস্তিত্বের সর্বস¦ বাংলাদেশ নামক সেই রক্তাক্ত ভুলুন্ঠিত মানচিত্র প্রদক্ষিণ করিয়ে, সবশেষে মায়ের কোলে আছড়ে পড়া শিশুটির হৃদপিন্ডের অসীম সম্ভাবনাকে বুলেটের আঘাতে ঝাঝরা করে ফেলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সেই ক্ষমতাহীন ভয়ঙ্কর রাতের নির্মম অসহনীয় বেদনার সমাধি, আজ সুদীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে বাঙালি বহন করে চলছে। বেঁচে থাকলে আজ বাংলার উজ্জ¦ল নক্ষত্র রাসেল সোনা ৫৮ তম জন্মদিন পালন করে ৫৯ বছরে পা রাখত। হয়ত সে পিতার মতই এদেশের আপামর জনগণের কান্ডারি হত। হয়ত জননেত্রী শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী হয়ে দেশের মানুষের পাশে থাকত অনুক্ষণ।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, জন্মেছিস যখন দাগ রেখে যা বিষ্ময়কর এই ছোট্ট মানুষটাও পৃথিবীতে এসেছিল দাগ রাখার জন্যই। ১০ বছর নামক সময়ের সীমানায় আবদ্ধ জীবন তারই স্বাক্ষর দেয়। রাসেলের প্রিয় হাসু আপা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণে অনেক ক্ষুদ্র-বৃহৎ-মহৎ তাৎপর্যপূর্ণ চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হয়। এই চিহ্ন অনন্ত প্রত্যাশার দিকেই বার বার তর্জনী তুলে। যাকে বাংলার মাটি ও চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু তার স্বল্প সময়ের জীবনের উজ্জ্বল প্রতিভার অমূল্য ইতিহাসখন্ড একটি চিরঞ্জীব নক্ষত্রের মত প্রজন্ম পরম্পরা আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। বাংলার মাটির সন্তান বঙ্গবন্ধু মাঠিঘেষা মন ও মনন, মাটির মানুষের সঙ্গে যাপিত জীবনের আদর্শিক আবহে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের ’বঙ্গবন্ধু ভবন’ তার প্রিয় হাসু আপার কক্ষে জন্ম নেওয়া, হাঁটি হাটি পা পা করে বেড়ে ওঠা রাসেলের নিষ্পাপ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কোন না কোন কোন ভাবে বিষ্ময়কর সাহস, সততা, বিনয় আর নানা শিষ্ঠাচার ভেতের দিয়ে অতিবাহিত। বিচিত্র অনুভবে আপ্লুত হই, প্রণিত হই এই ছোট্ট মানুষটার এতো মানবিকবোধ, দেশপ্রেম, সাংগঠনিক ক্ষমতাসহ শিষ্টাচারের নানা পাঠ আতস্থ করলো কেমন করে? বিস্মিত হই না যখন বাঙালি জাতির পিতা, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূ-খন্ডের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাস্তবায়নের ¯্রষ্টা বঙ্গবন্ধু জীবন ও কর্মেও দিকে তাকাই। পূর্ববঙ্গ তথা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি মাটিকণা, শস্যদানা, জীবজন্তু পশু-পাখি আর মানুষের প্রতি তাঁর ছিল পরম মমতা, চরম দায়িত্ববোধ। আপোষহীন দায়বদ্ধতার জন্য বার বার তিনি কারাবরণ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, পারিবারকে মৃত্যুঝুকিতে ফেলেছেন কিন্তু ভয় পাননি,আশাহত হন নি। শেখ রাসেল নামক ছোট্ট মানুষটাতো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি অবিস্মরনীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানেরই আত্মজ। সুতরাং পিতার অসাধারন বীজমন্ত্র সন্তান শেখ রাসেলের রক্তস্রোত বিদ্যমান এটাই সত্য।

রাসেলের নামকরণের স্মৃতিচারণ করে আমাদের ছোট রাসেল সোনা গ্রন্থে জননেত্রী লিখেছেনÑ

আব্বা ব্রার্ট্র্যান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন।

মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যায় যে, নিজের ছোট ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখেন।

(হাসিনা, শেখ; আমাদের ছোট রাসেল সোনা, বাংলা শিশু একাডেমি, ১৭ মার্চ ২০১৮; পৃ.১৯)

বলা হয়,ব্যক্তির জীবনে নামের প্রভাব অনিবার্য। ছোট্ট মানুষটার আরও আরও ছোট জীবনের দিকে তাকালে এর অফুপন্ত সত্যতা প্রমাণিত হয়।

ছোট্ট মানুষটা জাতির পিতা ছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না, বাবা যেমন তার সন্তানকে অষ্টপ্রহর নিজের কাছে রাখতে চায়, রাসেলও ঠিক তেমনি বাংলার মানচিত্র সমান পিতাকে তার ছোট্ট বুকটা দিয়ে সারাটাক্ষণ আগলে রাখতে চাইতো।

জননেত্রী স্মৃতিচারণ করেছেন-

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি প্রায় তিন বছর আব্বা গণ-অভ্যুন্থানের মধ্য দিয়ে যখন মুক্তি পান। তখন রাসেলের বয়স চার পার হয়েছে। .. .. .. এর মধ্য ওর একটা জিনিস আমারা লক্ষ্য করলাম, খেলার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পরপরই আব্বাকে দেখতে আসত। আব্বা নিচে অফিস করতেন। আমরা তখন দোতলায় উঠে গেছি। ও সারাদিন নিচে খেলা করত। আর কিছুক্ষণ পর পর আব্বাকে দেখতে যেত। মনে মনে বোধ হয় ভয় পেত যে, আব্বা বুঝি আবার হারায়। (প্রগুক্ত, পৃ.২৫)

অন্যত্র স্মৃতিচারণ করেছেন- ’রাসেল আব্বাকে ছায়ার মত অনুসরণ করত। আব্বাকে ছাড়াতে চাইত না।’ (প্রগুক্ত, পৃ.৩৩)

বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে ১৯৬৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিচারণ করে প্রিয় পুত্র রাসেলের কথা বুকভরা বেদনা নিয়ে লিখেছেন-

দুই বৎসরের ছেলেটা এসে ’আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দেবো? ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ওতো বুঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম তোমার মার বাড়ি তুমি যাও,আমার বাড়ি আমি থাকি। আবার দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা ওর দূর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে?! (রহমান,শেখ মুজিবুর; কারাগারের রোজনামচা; বাংলা একাডেমি, মার্চ ২০১৭,ঢাকা, পৃ.২৪৯)

পিতার অদর্শনে অবিরাম কান্নারত পুত্রের কান্না থামাতে মা বাধ্য হয়ে ছেলেকে বলে, তাকে আব্বা ডাকতে। তারপর কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা হলেও ছোট মানুষটা মা কে বার বার আব্বা বলে সম্মোধন করে। আব্বাকে বাড়ি নেওয়ার জন্য আর বায়না ধরে না। জাতির পিতা গভীর বেদনার সুপ্ত প্রকাশ-আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।( প্রগুক্ত, পৃ.২২১) পিতা –পুত্রীর দিনলিপির মধ্য দিয়ে বাবা-ছেলের অমৃতসম ভালোবাসার বেদনাভরা মুহূতৃগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হয়ত ছোট্ট রাসেলের মনে চেতনা- অবচেতনে জাগ্রত হয়েছিল এই অনুভূতি যে,বাবা যেমন তার তেমনি গোটা দেশটারও।

বাবার সবকিছু তার পছন্দের। পোশাকে-আশাক, কথা বলা,বসার ধরন, হাঁটা চলা- সব। আসলে গোটা বাবাটাই তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। তাই তো ছায়াসঙ্গি হয়ে থাকতে চাইত। হয়ত আজ রাসেল বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর শুধু কায়ারুপই নয়, পিতার সবচেয়ে প্রিয় দেশটাকে ভালবাসত পিতার মত করেই। তাঁর আর্দশেই প্রতিভূ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার অসমাপ্ত কর্ম সম্পাদনে অমিত সাহস আর বিশ্বাসী জননেত্রীর পাশে দাঁড়াত।

 দেশ ও জাতির চরম সংকটকালীন পরিস্থিতিতে ছোট্ট মানুষটির কর্মকান্ডে আমরা বার বার চমৎকৃত হই-

যদিও এই ছোট্ট মানুষটার কন্ঠস্বর পুলিশের কানে পৌঁছাত না,কিন্তু রাসেল হরতালের কথা বলবেই। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হরতাল হরতাল বলে চিৎকার করত। শ্লোগান দিত জয়বাংলা। (প্রগুক্ত,হাসিনা,শেখ; পৃ.২৫)

বাংলার সর্বশ্রেষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিবাহীর সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ’ছোট মানুষটা’। অভিহিত শেখ রাসেল। জন্মেই যেন তার পিতার মুক্তি মন্ত্রণা তার রক্ত মাংস মেদ মজ্জা শিরা উপশিরা অপ্রতিরোধ্য ভাবে মিশে গিয়েছিল। তাই তার বেঁচে থাকা এই ক্ষুদ্র শৈশব জীবনটা অসীম হয়ে ওঠে,যখন দেখি তার ছেলেবেলা শুধুমাত্র শিশুদের জীবন না হয়ে প্রতিটি কাজে বার বার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মহীরুহ পিতার আদর্শ, দেশপ্রেম, মানবিকতা, দায়িত্বশীলতা সহ গুনাবলীর প্রকাশ। এখানেই রাসেল আর শিশু থাকে না হয়ে ওঠে পরিনত মানুষ এর সম্ভাব্য রুপ।পিতার অঙ্কুরিত বীজকণা। তাই ভাইকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিমতের দ্বিমত পোষণের অবকাশ থাকে না-

ওর সব কিছুই ছিল ব্যতিক্রম। অত্যন্ত মেধাবী তার প্রমান অনেকবার পেয়েছি। চলাফেরা বেশ সাবধানী কিন্তু সাহসী ছিল। সহসা কোন কিছুতেই ভয় পেতনা। (প্রগুক্ত, পৃ.১৭)

অন্যত্র বলেছেন-

কাপড় চোপড়ের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তার নিজের পছন্দ ছিল। তবে একবার একটা পছন্দ হলে তা আর ছাড়তেন না। ওর একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। নিজের পছন্দে ওপর বিশ্বাস ছিল। খুব স্বাধীন মত নিয়ে চলতে চাইত। ছোট মানুষটার চরিত্রের দৃঢ়তা দেখে অবাক হতে হতো। বড় হলে সে যে বিশেষ কেউ একটা হবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। (প্রগুক্ত, পৃ.৩৬)

অথচ হায়েনাদের নির্মমতায় খুন হয়ে গেল তার অপার সম্ভাবনা।

বঙ্গবন্ধুর গভীর দেশপ্রেম, অসাধারণ নেতৃত্ববোধ, সাংগঠনিক ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে ছোট্ট রাসেলের মন ও মস্তিষ্কে ক্রিয়াশীল ছিল। তাই তো সে শিশুদের স¦াভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে অনেক ব্যতিক্রম ছিল। খেলাধূলার ভেতর দিয়ে কিছু জানার শেখার জানানোর শেখানোর এক স্বাভাবজাত প্রবণতা তার ছিল। তখন তার বয়স সাত কি আট। জননেত্রী স্মৃতিচারন করেছেন-

টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়িতে গেলে তার খেলাধূলার অনেক সাথী ছিল। গ্রামের ছোট ছোট অনেক বাচ্চাদের জড়ো করত।তাদের জন্য ডামি বন্দুক বানিয়ে দিয়েছিল। সেই বন্দুক হাতে তাদের প্যারেড করাত। প্রত্যেকের জন্য খাবার কিনে দিত। রাসেলের খুদে বাহিনীর জন্য জামা-কাপড় ঢাকা থেকেই কিনে দিতে হতো। নাসের কাকা রাসেলকে এক টাকার নোটের বান্ডিল দিতেন। খুদে বাহানীকে বিস্কুট লজেন্স কিনে খেতে টাকা দিত। প্যারেড শেষ হলেও তাদের টাকা দিতো। (প্রগুক্ত, পৃ.৩৬)

মহান রাষ্ট্রনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজ রাসেল পিতার জীবন ও কর্মের ভেতর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জীবন চেতনে অবচেতনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে লালন করত। হরতাল, মিছিল,মিটিং, গৃহবন্দিজীবন কারাবাস আর মুক্তিযোদ্ধদের বীরগাঁথা তার ছোট্ট জীবনটাতে ছেঁয়ে ছিল। বড় দুই ভাই যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলে রাসেলের সকল আগ্রহের কেন্দ্র ছিল মুক্তিযোদ্ধের গল্প শোনা। খুদে বাহিনীকে ডামি বন্দুক দিয়ে ট্রেনিং প্রশিক্ষক রাসেল ছিল জাতির পিতার ভবিষ্যত কর্ণধার। তার স্বপ্ন ছিল আর্মি অফিসার হওয়ার। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল সেই স্বপ্ন। 

একজন পরিনত মানুষের মত তীব্র দুঃখবোধকে লুকিয়ে রাখা, কষ্টকে বুকে চেপে নিশ্চুপ থাকার মত বিষ্ময়কর শক্তি ছিল এই ছোট মানুষটার। কে জানে কোথা থেকে সে এতো শক্তি পেত? ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ সেই ক্ষমাহীন কালোরাতের পরের দিন ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। পাক সরকারের নির্দেশে তিনি কারারুদ্ধ হলেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মেজ ছেলে শেখ জামাল আর কনিষ্ঠ পুত্র আদরের রাসেলকে নিয়ে গৃহে অন্তরীণ হলেন। দুর্বিষহ সেই সময়ে ছোট্ট মানুষটার মানসিক অবস্থার স্মৃতিচারণ করেন জননেত্রী-

মনের কন্ঠ কী ভাবে চেপে রাখব আর কী ভাবেই বা ব্যক্ত করবে? চোখের কোণে সবসময় পানি। যদি জিজ্ঞাসা করতাম কি হয়েছে রাসেল? বলত চোখে ময়লা। ঐ ছোট্ট বয়সে সে চেষ্টা করত মনের কষ্ট লুকাতে। (প্রগুক্ত, পৃ.২৭)

এই অবুঝ শিশুর ব্যথাকে ধারন করার আশ্চার্য ক্ষমতা দেখে প্রশ্ন জাগে রাসেল কী তবে বঙ্গবন্ধুর-ই-প্রতিমূর্তি? হ্যাঁ তাই-ই। সেই ক্রান্তিকাল থেকে বঙ্গবন্ধু যেমন অমিত সাহস অসহনীয় সহিঞ্চুতায় তাঁর বিশাল বুক দিয়ে সামলে রেখেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের মাটি ও মানুষকে ; ছোট রাসেলও যেন তেমনি তার ছোট হৃদপিন্ডে লুকিয়ে রেখেছিল প্রানপ্রিয় পিতাকে না দেখার গভীর বেদনা, গৃহে অন্তরীণ জীবনের সকল যন্ত্রনা।

আজ বিশ্বজুড়ে প্রানিহত্যার যে আন্দোলন চলছে সেই প্রাণকে রক্ষার এক বিস্ময়কর অব্যক্ত আকুতি তার ছিল। কবুতরের মাংস না খাওয়া। মাছকে নিধন না করা এ এক নীরব প্রতিবাদ তার। জননেত্রী স্মৃতিচারণ-

রাসেলকে কবুতরের মাংস দিলে খেত না। এতো ছোট বাচ্চা কী ভাবে টের পেত কে জানে ! ওকে আমরা অনেক ভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিলেও খেত না। মুখ ফিরিয়ে নিত, শতচেষ্টা করেও কোনদিন কেও ওকে কবুতরের মাংস খাওয়াতে পারে নি।(প্রগুক্ত, পৃ.২৭)

বাড়িতে পোষা কবুতরগুলোকে রাসেল খাবার খাওয়াতো তাদের সঙ্গে খেলত। তবে কী রাসেলের ছোট মনে প্রশ্ন জেগেছিল রক্ষক কী করে ভক্ষক হয়? খেলার সাথীকে মেওে ফেলা যায় কি? যায় না।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ^র। আমাদের রাসেল ছিল ঈশ্বরের সেবক জীবের রক্ষক। মানুষ নামক তথাকথিত হিংস্র জানোয়াররা তার অমিত সম্ভাবনার ছোট্ট প্রাণটা কে স্তব্ধ করে দিল। মানব ইতিহাসের মানচিত্রে চিরকলের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করে দিল মানুষে এবং মানবতার সংজ্ঞার্থ।

জননেত্রী অন্যত্র স¥ৃতিচারণ করেছেন- 

রাসেলের মাছ ধরার খুব শখ ছিল। কিন্তু মাছ ধরে আবার ছেড়ে দিত।(প্রগুক্ত, পৃ.১২)

ছোট্ট মানুষটা কী বুঝতো প্রাণ বেঁচে থাকার জন্য নিধনের জন্য নয়। হত্যা যে মহাপাপ । প্রাণের প্রতি তার গভীর ভালবাসা অথচ পশুরা তার প্রাণটাকে নির্মমভাবে কেড়ে নিল।

জাতির পিতা শ্রেণিহীন শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক আদর্শ বীজকণা রাসেলের রক্ত মজ্জায় লীন ছিল। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা মামলায় যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রাখা হয় তখন ছোট মানুষটার বুকভরা অপার বেদনা নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। সেই সংকট সময়ের স্মৃতিচারণ করেন জননেত্রী-

রাসেল কে সময় দিতে পারি না বেশি। আম্বিয়ার মা সবসময় দেখে রাখত। এমনি খাবার খেতে চাইত না। কিন্তু রান্নাঘরে যখন সবাই খেত তখন ওদের সাথে বসত। পাশের ঘরে লাল ফুল আঁকা থালায় করে পিঁড়ি পেতে বসে কাজের লোকদের সাথে ভাত খেতে পছন্দ করত। (প্রগুক্ত, পৃ.২৩)

ইউনির্ভাসিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মেধাবী রাসেল যেমন সাহসী ছিল তার প্রখর স্মরণশক্তি। পুলিশকে দেখে ও পুলিশ কাল হরতাল, কিংবা জয় বাংলা বলতে যেমন সে ভয় পেত না, তেমনি পাকিস্তানী সেনাদের অস্ত্র পরিষ্কার দেখতেও তার ভয় লাগত না। সে শুনে শুনে অনেক অস্ত্রের নাম মুখস্থ করে ফেলেছিল। ওলা পিঁপড়া ছোট্ট মানুষটাকে কামড়ে দিলে, সে পিঁপড়ার নাম দেয় ভুট্টো। রাষ্ট্রীয় পরিবারের সন্তান রাসেল কী তবে জানত ভুট্টো’র নির্মমতার কথা? তাই হয়ত ওলা পিঁপড়া তার কাছে ভুট্টো’র মত নির্মম মনে হয়েছিল।

রাসেলে শিষ্টাচার অনুসরণযোগ্য। এতোটুকু রাসেল অতিথির আপ্যায়ন করতে ভালোবাসত। শিক্ষকের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্মৃতিচারণ করে জননেত্রী বলেছেন-

প্রতিদিন শিক্ষিকাকে দুটো করে মিষ্টি খেতে হবে। আর মিষ্টি খেলে সে পড়বে। কাজেই শিক্ষিকাকে খেতেই হতো। তা ছাড়া সব সময় তার লক্ষ থাকত শিক্ষিকার যেন কেনো অসুবিধা না হয়।(প্রগুক্ত, পৃ.৩২)

বঙ্গবন্ধুর দেশ ও দশের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধের অঙ্কুরোদমের রাসেলের অন্তরেও প্রস্ফুটিত ছিল। জননেত্রীর স্মৃতিচারণ-

এর ওপর শুরু হলো এয়ার রেইড। আক্রমনের সময় সাইরেন বাজাত। রাসেল ও ব্যাপারে খুবই সর্তক ছিল। যখনই সাইরেন বাজাত বা আকাশে মেঘের মত আওয়াজ হতো। রাসেল তুলা নিয়ে এসে জয়ের কানে গুজে দিত। আমরা বলতাম তোমার কানেও দাও।(প্রগুক্ত, পৃ.২৯) 

পিতার মতই অন্যের প্রতি ভালোবাসা,গভীর দায়িত্ববোধের ছাপ তার স্বভাবে সুস্পষ্ট ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ছোট রাসেল সোনা শীর্ষক স্মৃতিগ্রন্থে প্রিয়তম ভাইকে কোথাও শিশু হিসাবে নয় বরং ছোট্ট মানুষ হিসাবে সম্মোধন করেছেন। তাঁর এই অভিবাদন যথার্থ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। দশ বছর বয়সী এই বিস্ময়কর বালকের, তারও চেয়ে সংক্ষিপ্ত জীবনের কর্ম ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে শেখ রাসেলকে নিদ্বির্ধায় শিশু উর্ধ্বে অপার সম্ভাবনাময় একজন মানুষ হিসেবে আজ আমি অভিহিত করবো। সে সম্ভাবনা বিশ্বাসঘাতকদের বুলেটের আঘাতে ইতিহাসকে। উচ্চকিত হয়ে আছে ছোট্ট মানুষটার মুখ নিঃসৃত একটি দেশ ও জাতির মুক্তির শ্লোগান জয় বাংলা।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। বিষ্ময়কর প্রতিভার ইঙ্গিত নিয়ে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল সেই অসাধারন ছোট মানুষাকে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তার প্রতিভার আলোকে দ্যুতি ভবিষ্যত শিশুদের পথ নির্মাণের কর্ণধার হতে পারে সহজেই।

জাতির পিতা সোনার বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ তরুন প্রজন্মের যথার্থ নেতৃত্বের বড্ড অভাব। আমি তরুন প্রজন্মকে আহবান করবো তারা যেন বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পুত্র জননেত্রীর আদরের ছোটভাই ’ছোট মানুষ’ শেখ রাসেলের জীবন থেকে পাঠ নিয়ে এই অভাব পূরণে এগিয়ে আসে। তার মত বেদনাকে আত্মস্থ করার দীক্ষা নেই। রাসেলের শিষ্টাচার,দেশপ্রেম, জীবেপ্রেম, সাংগঠনিক ক্ষমতাসহ নানা গুনাবলিকে চর্চা করে,জীবনে প্রয়োগ করে অপার সম্ভাবনাময় এক একজন ’শেখ রাসেল’ হয়ে ওঠে।

বাংলার আলোকিত ছোট্ট মানুষ শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্মদিনের স্মরণ-উৎসব অসহনীয় বেদনার কিন্তু জননেত্রীর আমরাও শোককে শক্তিতে পরিণত করবো। বিষ্ময়কর বালক রাসেলের হাতে গোনা দশ বছরের জীবনের চেয়েও সংক্ষিপ্ত জীবন পাঠ করে নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হবো। পথচলার বিচিত্র অধীতি ঠিক খুঁজে পাবো এ আমার বিশ্বাস। আজ ১৮ অক্টোবর জাতির পিতার সর্বকনিষ্ঠ প্রিয়তম পুত্র, শেখ রাসেলের ৫৮ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধা-স্মরণ ’দীপ্ত জয়োল্লাস অদম্য আত্মবিশ্বাস’ এ প্রাণিত হয়েই বলছি, জীবন অফুরান, জীবনের মূলে আছে অকারণ আনন্দ। আসুন এই ক্রান্তিকালে আমরা সবাই যে যার মত সুন্দর প্রতীতির উল্লাস খুঁজে নেই। একটু একটু করে বিশ্বাস জমিয়ে জমিয়ে আত্মবিশ্বাসের শক্ত ভিত নির্মান করি। পৃথিবীর জন্য,সবাই সবার জন্য ভালোবাসা লালন করি, পালন করি, ধারন করি। অফুরন্ত আনন্দোল্লাস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ’সোনার বাংলা’ ছোট্ট মানুষ শেখ রাসেলের জয়বাংলা’র সকল অশুভ নাশ করি এবং শুভোবোধের সৃজনে সমবেত হয়ে কাজ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবায়ন করি।


এএফ/০১