Cinque Terre

মো. জেদান আল মুসা

২৯ অক্টোবর , ২০২২


পুলিশ সুপার (ইন্টেলিজেন্স এন্ড ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়, সিলেট
কমিউনিটি পুলিশিং : সেবার নতুন দ্বার


পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ এই সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ভূমিকা অপরিসীম। পুলিশের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমেই সমাজে বিরাজ করে শান্তি-শৃঙ্খলা। আইন-নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে কাজ করতে হয় পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। একজন নাগরিকের কাছে বিপদের সময় সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল থানা পুলিশ।

পুলিশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জমিদারদের উত্তরাধিকারী পুলিশ ব্যবস্থা মূলত ব্রিটিশ শাসনের শুরু পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। ১৭৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর লর্ড কর্ণওয়ালিস পুলিশ বাহিনীকে একটি কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করান। এর ফলে জমিদারদের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রাখার প্রবণতা দূর হতে থাকে। তৎকালীন ভারত উপমহাদেশকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রত্যেক জায়গায় একজন দারোগা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৬১ সালে পার্লামেন্টে পুলিশ আইন পাশ হয়। এটি ছিল ব্রিটিশ কলোনীয়াল আইন। এর ফলে পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবায় পরিবর্তে শাসকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে পুলিশের কার্যক্রম। উপনিবেশ আমলে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিলো মূলত: মানুষকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য, জনগণের বন্ধু হওয়ার জন্য নয়। জনগণ পুলিশ থেকে চায় সেবা আর নিরাপত্তা। পুলিশের প্রধানতম কাজ হলো মানুষকে সেবা দেওয়া, তাদের সহযোগিতা করা, নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের আলোকে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে এদেশের দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় জনগণের প্রত্যাশা ও মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই প্রশাসন চালিত হয়। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীও জনগণের মতামত ও প্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দায়িত্ব পালন করে। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের কাজের সফলতা আশা করা যায় না। একটি উদার ও গণতান্ত্রিক সমাজে বসবাসের নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠিকে পুলিশ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ ব্যবস্থাপদের সামনে মাত্র দুটি কৌশল উন্মুক্ত থাকে। এদের মধ্যে একটি হল জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আইন প্রয়োগ করা অন্যটি হল কমিউনিটি পুলিশিং। কৌশল দুটির একটি অন্যটির সম্পূর্ণ বিপরীত নয় বরং একই পদ্ধতির পুলিশিং কার্যক্রম।

আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থার মূল কথা হলো, ‘পুলিশই জনতা এবং জনতাই পুলিশ’। রবার্ট পিলের গণমুখী পুলিশিং এর মূলনীতি হতেই মূলত কমিউনিটি পুলিশিং এর ধারণা আসে। পুলিশের কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করে এবং জনগণের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করলে পুলিশের কাজে যেমন সফলতা আসবে এবং এর ফলে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা সৃষ্টি হবে যা পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখে। শুধুমাত্র কার্যকর কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার মাধ্যমেই এটি নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা একেবারেই কম বিধায় পুলিশের একার পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরাধীরা বা যারা অপরাধ করে তারা আামাদের সমাজেরই একটা অংশ সেহেতু জনসাধারণের সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই পুলিশ অপরাধ প্রতিরোধ বা নিবারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও অক্টোবর মাসের শেষ শনিবার সারাদেশে পালিত হবে কমিউনিটি পুলিশিং ডে। দিবসটির এরারের ¯েøাগান ‘কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মূলমন্ত্র, শান্তি-শৃঙ্খলা সর্বত্র’। বাংলাদেশের প্রতিটি থানা ও জেলাতে ২৯শে অক্টোবর একযোগে পালিত হবে দিবসটি। এটি জনগণের সঙ্গে পুলিশের মিলনমেলাও বটে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহে ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন ‘একটা কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন জনগণের পুলিশ’। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের পুলিশ হওয়ার আহব্বান জানিয়েছিলেন।  কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাই হলো জনতার পুলিশ।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নে তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করছেন। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পুলিশ সক্রিয় অংশীদার। নিরবিচ্ছিন্ন এই উন্নয়ন টেকসই করার লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার আন্তরিকতা, দক্ষতা পেশাদারিত্বের সহিত নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা-আধুনিকরন আর ভাবমূর্তির উপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সমুন্নত রাখার প্রয়াসে কমিউনিটি পুলিশিং একটি শক্তিশালি আধুনিক দর্শন বা মতবাদ হিসেবে পরিচিত। বর্তমান বাংলাদেশে সামজিক, আর্থ-সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ  ও নিবারণের লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং একটি সফল পুলিশিং ব্যবস্থা। এটি একটি দল নিরপেক্ষ ও স্বেচ্ছাসেবী পুলিশিং ব্যবস্থা। এই পুলিশিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। মাদক, জুয়া , কিশোর অপরাধ, পারিবারিক কলহ, আর্থিক লেনদেন, জমি-জমা, বখাটেপনা, স্কুল কলেজে মেয়েদের উত্যাক্ত করা, গুজব, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, শিশু পাচার, শিশু শ্রম, মানব পাচার ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে কমিউনিটি পুলিশিং র্কাযক্রম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।

কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে কমিউনিটি ও পুলিশের যৌথ অংশগ্রহণে সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে অপরাধ ভীতি কমানো, অপরাধ সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান এবং অপরাধ প্রতিরোধ বা নিবারণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাছাড়াও জঙ্গীবাদ দমন ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে কমিউনিটি পুলিশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে কমিউনিটি পুলিশিং এর মাধ্যমে  ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে একই ছাতার বন্ধনে আবদ্ধ করে সম্প্রীতির সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিতে হবে।


এএফ/০১