Cinque Terre

মো. জেদান আল মুসা

২০ নভেম্বর , ২০২২


পুলিশ সুপার (ইন্টেলিজেন্স এন্ড ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়, সিলেট
সন্ত্রাসবাদের নতুন রূপ জঙ্গিবাদ: সচেতনতা ও করণীয়


বুৎপত্তিগত বিচারে ‘জঙ্গ’ থেকেই জঙ্গি শব্দের উদ্ভব। শব্দটি মূলত ফার্সী ভাষার- যার অর্থ যুদ্ধ বা লড়াই। সে হিসেবে ‘জঙ্গি’ অর্থ সাধারণভাবে যোদ্ধা বা লড়াকু। জঙ্গিবাদ বলতে বোঝায় একটি উগ্রপন্থি গোষ্ঠী যারা যুদ্ধ বা সহিংসতার মাধ্যমে সব কিছু আদায় করতে চায়। সন্ত্রাসবাদের নতুন রূপই হলো জঙ্গিবাদ। বর্তমান বিশের অনেক দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি প্রধান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সমস্যা। জঙ্গিবাদের ফলে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে এক ধরণের সংশয় প্রকাশ পায়। সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠিবিশেষকে কেন্দ্র করেই নয়, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকেও অনেক সময় আতংকগ্রস্ত করে রাখে। বেতার- টেলিভিশনের সংবাদ ও পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে এবং এতে নিরপরাধ মানুষ ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অনেক ক্ষেত্রেই আত্মঘাতী বোমার মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে থাকে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের কোন সুনির্দিষ্ট জীবনদর্শন নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও আতংকগ্রস্ত করে পার্থিব সম্পদ অর্জন, ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, যারা সরাসরি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত এবং হত্যা, খুন ও বোমা হামলা চালিয়ে থাকে তারা নিজেরাও জানে না কি উদ্দেশ্যে তারা এ কাজটি করছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ধর্ম সম্পর্কে সত্যিকারের জ্ঞানের অভাব বা অজ্ঞতা, দুর্বল ঈমান ও তাকওয়ার অভাব, চারিত্রিক বিভিন্ন ক্রটি, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার লোভ, ভিন্নমতালম্বীদের উপর অকথ্য নির্যাতন, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, বেকারত্ব, দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ইত্যাদি। এটি অস্বীকারের উপায় নেই যে, বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। অনেক সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন ধর্মের নাম ব্যবহার করে থাকে। অথচ এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না। মদীনা সনদের মাধ্যমের ইসলাম সর্বপ্রথম সন্ত্রাস ও হানাহানি প্রতিরোধ করে। মদীনায় বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী, দল ও উপদলের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ-সম্প্রীতি প্রতষ্ঠা এবং প্রচেষ্টায় একটি লিখিত চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়- যা ইতিহাসে ‘মদীনার সনদ’ নামে খ্যাত। মদীনা চুক্তি পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদীনা সনদের একটি ধারায় উল্লেখ ছিল যে, মদীনায় রক্তক্ষয় এবং সীমালঙ্গন নিষিদ্ধ করা হলো। ইসলামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। কাউকে বিনা বিচারে হত্যার বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার সতর্কবাণী হচ্ছে :কেউ কাউকে নরহত্যার অপরাধ ব্যতীত হত্যা করলে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করলো। আর কেউ কারো প্রাণ বাঁচালে সে যেন গোটা মানবজাতিকে বাঁচালো (সূরা মায়িদা, আয়াত :৩২)। ফিতনা বা সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ফিতনা বা সন্ত্রাস হত্যার চেয়েও ভয়াবহ (সূরা বাকারা, আয়াত:১৯১)। অন্যান্য পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ যেমন: বাইবেল, বেদ, গীতা ও ত্রিপিটকেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

সন্ত্রাসীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিনা দ্বিধায় তার মুসলিম ভাইকেও হত্যা করে থাকে। বিশেষ করে যখন তারা বোমা হামলা চালায় তখন যাচাই-বাছাই করে না কে ভালো কে খারাপ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে ব্যাক্তি কোন মু’মিন ব্যক্তিকে জেনে-বুঝে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। তাতে সে থাকবে চিরদিন (সুরা-নিসা, আয়াত:৯৩)। শুধু মুসলিমকে হত্যা করাই নয়, অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধ চলাকালেও বৃদ্ধ, মহিলা ও শিশু হত্যা ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে শিশু হত্যার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে হযরত আল-আসওয়াদ ইবনে সারী (রা) বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (সা) বলেন, খবরদার তোমরা শিশুদের হত্যা করো না।  বয়ঃবৃদ্ধদের হত্যা না করার বিষয়ে ইমাম আবু দাউদ হযরত আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত হাদীসে মহানবী (সা) বলেন, তোমরা বয়ঃবৃদ্ধ লোককে হত্যা করো না, হত্যা করো না দুগ্ধপায়ী সন্তানকে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকেও না, কোন মহিলাকেও না। তোমরা দয়াপরবশ হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ দয়ার্দ্রদের ভালোবাসেন (আবু দাউদ)।

সন্ত্রাসীরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আত্মঘাতী বোমা হামলা, আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ দ্বারা বিভিন্ন কৌশলে মানুষকে হত্যা করে থাকে। যুদ্ধের সময়েও নির্বিচারে মানুষ হত্যা যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে কোনভাবেই ইসলাম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে সমর্থন করে না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবন বিপন্ন হয়, রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হয়, বৈদেশিক বানিজ্যে ব্যঘাত ঘটে এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়। সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদেরকে সরকার ও রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন, একটি পর্বত যদি অপর একটি পর্বতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বিদ্রোহী পর্বকতকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা চূড়ান্ত পর্যায়ে কখনই বিজয়ী হবে না। বরং তাদের শেষ পরিণতি ইহকালে লাঞ্চনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি । এ ব্যাপারে মহানবী (সা) বলেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে বিষয়ে বিচার করা হবে তা হচ্ছে খুন অর্থাৎ হত্যাকাণ্ড (নাসঈ)।


বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে

সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড সমগ্র বিশ্বের জন্যই একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর কোন দেশই এদের জঘন্য হামলা ও কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপদ নয়। ইসলামের ভাবমর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করে ইসলামকে একটি জঙ্গিবাদী ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার লক্ষে ইসলামী লেবাসে ইসলামের শত্রুরা নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম সর্ম্পকে অত্যাধিক আবেগপ্রবণ ও অশিক্ষিতি ব্যক্তিদের তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। আল্লাহর রহমতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এ অবস্থা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের এই দেশও জঙ্গিবাদীদের টার্গেট থেকে মুক্ত নয়। যখনই তারা সদম্ভে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্ট করেছে তখনই জনগণের সম্মিলিত সোচ্চার প্রতিবাদের কারণে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এদেশের জনগণ যেমন দেশপ্রেমিক তেমনি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মের শাশ্বত শিক্ষার আলোয় আলোকিত। বিভিন্ন ধর্মের জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে উদারনৈতিক সহমর্মিতা, সহাবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরমত সহিতার সুদৃঢ় বুনিয়াদ। ফলে জঙ্গিবাদীরা কখনই এদেশে সংগঠিত হতে পারেনি। তাছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনীও এ ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি মোকাবেলায় বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর রোল মডেল। অনেক উন্নত দেশ জঙ্গি প্রতিরোধে বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে, আইন প্রয়োগ করে এসব অপতৎপরতা সমূলে বিনাশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার উন্মেষ ঘটানো। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এটাই শ্রেষ্ঠপ্রাপ্তি। শত শত বছরের শোষণ-শাসন, লাঞ্ছনা-গঞ্ছনার শিকার বাঙালিরা ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃপ্ত নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হানাদার-বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। এদেশের মানুষের সাহস, শৌর্য ও বীরত্বের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আল বদর, আল সামস ও রাজাকাররা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালেই ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার উন্মেষ ঘটানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্প্রীতির সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯ ও ৪১ এ সকলের সমঅধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসোপানে অবস্থান করছে। বর্তমানে আমাদের  মাথাপিছু আয় প্রায় ২৮২৪ ডলার। জাতির পিতার সোনর বাংলা গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমস্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ভিশন-২০৪১ ঘোষণা করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পুলিশ ও সক্রিয় অংশীদার। নিরবিচ্ছিন্ন এই উন্নয়ন টেকসই করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাঁর আন্তরিকতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সহিত নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের নামে বাংলাদেশের এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কোনোভাবে ব্যাহত করা যাবেনা। আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক ও সমুন্নত রাখার পাশাপাশি জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। 

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ অন্যায়-অবিচার, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তুলেছে। এদেশের মানুষ যেমন কোমল, প্রয়োজনে তেমনি ইস্পাত কঠিন। দেশের মানুষ ও মাটি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অমর বাণী-“আমাদের সবচেয়ে বড় দুটি মূল্যবান সম্পদ-একটি হচ্ছে এদেশের সোনার মাটি, অপরটি হচ্ছে এদেশের সোনার মানুষ। এই সোনার মাটি ও সোনার মানুষকে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।”

আসুন, আমরা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করি এবং  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার নিমিত্তে মানবতার চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যাই, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। সন্ত্রাস নয়, ইসলামে মানবতাবাদী স্লোগানকে উজ্জীবিত করি। 


এএফ/০৭