Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

১৮ ডিসেম্বর , ২০২২


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


মৌলভীবাজার পিটিআইয়ে দেশ নির্মাণের করুণ-গাথা (প্রথমপর্ব)

১৯৭০ সালের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের মতলববাজী গড়িমসি এবং ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার পর ‘অগ্নিগর্ভ মার্চে’র সূচনা। যা ক্রমে তৃণমূলের স্বাধীনতাকাক্সক্ষী বাঙালিদের মনোজগতে বিষ্ফোরন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি করে। পশ্চিমারা হিসেব নিকেশ করে দেখেছে যে, আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের চেয়ে তাদের মান-সম্মানের আঘাতের বড় বিষয় ছিল-বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শঙ্কা। 

১ মার্চ থেকে মৌলভীবাজারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উড়তে থাকে। ২ মার্চ হাটবাজারে গণমিছিল ও সন্ধ্যায় মশাল মিছিল থেকে শুরু করে ৩ মার্চ হরতাল পালিত হয়। চা শ্রমিক ও জনতার পুরানো দেশীয় অস্ত্রের মিছিল দ্রোহের চ‚ড়ান্ত প্রকাশ। তার অতিরিক্ত অস্ত্রের সম্বলও ছিল না। ২৫ মার্চ বিকেলে ভৈরবগঞ্জ বাজারে পুনরায় চাশ্রমিকদের সশস্ত্র গণজমায়েত ছিল স্বাধীনতার অভিমুখে যাত্রার সোপান।

ক্রমাবনতিশীল অবস্থায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশলে তাদের অনেককে টহলে পাঠায়। কিন্তু গোপনে বিমানে করে পাকসেনাদের জড়ো করে সালুটিকর বিমান বন্দরে। বলা আবশ্যক যে, তখন সিলেটে সেনা ক্যাম্প না থাকলেও পাক সেনাদের একটি কোম্পানি ছিল সেখানে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা যে, মার্চে সিলেট বিমানবন্দরে ঘনঘন বিমান ওঠা-নামার কারণ ছিল কৌশলে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার অনন্য উপায়। মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি সীমান্তবর্তী এলাকার ডিফেন্সের জন্য অনেক সৈন্যের দরকার পড়েছিল। কারণ স্থানীয় প্রতিরোধ শক্তির চেয়ে সৈন্য সংখ্যা ছিল অনেক কম। অন্যদিকে উত্থাল মার্চের দিকে শ্রীমঙ্গল এবং তেলিয়াপাড়ার দিকে ভারতীয় গোয়েন্দা ও স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক সংগঠকদের গোপন যোগাযোগ চলতে থাকেযা আরো ঘনীভূত হয়েছিল ২৫ মার্চের পর। পাকদের কাছে এই খবর ছিল যে, চা বাগান অধ্যুষিত খেজুরিছড়া, সিন্দুরখান, আশারামবাড়ি দিয়ে সীমান্তে স্বাধীনতাকামীরা যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

২৫ মার্চ পাকসেনাদের নখর থাবা মৌলভীবাজারে তেমন একটা পড়েনি। যেমনটা পড়েছিল সিলেট শহরে। তবে পাকসেনাদের একটি দল মৌলভীবাজার শহরের দক্ষিণ প্রান্তের নির্জন বনাঞ্চলে স্থাপিত পিটিআই [প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র] ও তৎ-নিকটস্থ ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসে [কেউ বলেন র্পটন কেন্দ্র/সরকারি রেস্ট হাউস] সশস্ত্র অবস্থান নেয়। এই দুই ভবন ছিল খুব সুরক্ষিত। পিটিআই-এ ছিল প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের থাকবার হোস্টেল। ফলে এই জায়গায় নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা ছিল অনেক। তখন পিটিআইয়ের আশপাশে একমাত্র খ্রিষ্টান মিশন ছাড়া পাশে কোনো বাড়ি ঘর ছিল না। পিটিআইও পর্যটন কেন্দ্র ছিল পাশাপাশি টিলায়। দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ। পিটিআই ও রেস্ট হাউস স্থাপনের আগে এই টিলাভ‚মির নাম ছিল ’খারমার টিলা’। আগে এই টিলায় হাসপাতালের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হতো। অবশেষে সরকারি জায়গার মধ্যে ১৯৬২-১৯৬৩ সালে পিটিআই-এর বিশাল ক্যাম্পাস ও দুইটি বিশাল ভবন স্থাপিত হয় (ক্লাস শুরু ১৯৬৪ সালে)। যদিও মৌলভীবাজার কলেজ স্থাপিত হয় ১৯৫৬ সালে। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা ততটা ছিল না। যাই হোক ২৬ মার্চ মৌলভীবাজারের হাজার-হাজার জনতা মিছিল করে সান্ধ্য-আইন ভাঙে। প্রতিবাদী অসংখ্য লোকদের হাতে ছিল লাঠি। মিছিলের বিশেষত্ব ছিল যে, গ্রামীণ জনতা পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেদিন ভোরে পাক সেনা কমান্ডের নির্দেশনায় মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসক মো. আশরাফ [বাড়ি ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ]  মোহাম্মদ আজিজুর রহমানকে [১৯৭০ সালের নির্বাচিত এমপিএ] জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রথমে থানায়, পরে পিটিআই নিয়ে যায়। অতঃপর পাশের পিটিআই ও ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসে বন্দি করে পাক মেজর নির্যাতন চালায়। তাঁকে ২৭ মার্চ ছেড়ে দেয়। ২৭ মার্চ একাটুনার অঞ্চলের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মনুনদের উত্তর পারে এসে দাঁড়ায়। পাকসেনারা তখন দক্ষিণ পারে অবস্থান নেয়। এলাকার সাজ্জাদুর রহমান তাঁর বন্দুক দিয়ে দক্ষিণ দিকে গুলি করেন। পাকদের পাল্টা গুলিতে আহত হয়েছিলেন রেণু মিয়া। সম্ভবত বিশাল লোকসংখ্যা দেখে ভয়ে আর সামনে আসেনি। সেদিনও শহরে জনতার উত্তেজনা ছিল। পাকসেনাদের হাতে কয়েকজন শহীদ হয়েছিলেন। এই রাতেই পুনরায় মো. আজিজুর রহমানকে গ্রেফতার করে আরেক দফা নির্যাতনের পর তাঁকে সিলেট কারাগারে পাঠায় (২৯ মার্চ)। এই সময়ে ব্যোমকেশ ঘোষ, মতিউর রহমান, অদ্বৈত সেন অধিকারী প্রমুখ লোকদের ধরে এনে পিটিআই-এ নির্যাতন চালায়। প্রসন্নকুমার রায়কে আহত করে (২৮ মার্চ)। তেমনি গৌরাপদ দেব কানুকে ধরে নিয়ে পিটিআই-এ গুলি করে। পরে তিনি মারা যান (তাঁর মূল বাড়ি: আটগাঁও; কাশিনাথ রোডে তাঁরা ভাড়া থাকতেন)। তাঁর আরেক ভাই নিতাইপদ দেব এই সমকালে চিরতরে নিখোঁজ হন। ধারণা করা হয় পাঞ্জাবিরা তাঁকেও হত্যা করে। এই পর্বে পাক পাক সেনারা পিটিআইকে মিনি হেডকোয়ার্টার বানায়।

অন্যদিকে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি টেলিগ্রামে কমান্ডেড মানিক চৌধুরীর কাছে পৌঁছামাত্র তিনি মাধবপুর থানার ১২ জন পুলিশ নিয়ে মাধবপুর-ঢাকা রাস্তায় সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শত-শত চা-বাগানের লোক ও বস্তিবাসী শায়েস্তাগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল রোডের রশিদপুর চা-বাগান এলাকায় গাছ কেটের দীর্ঘ রাস্তা দুর্ভেদ্য করে তোলে। আবার চা-শ্রমিকরা তীর-ধনুক নিয়ে রাস্তায় থাকে। কার্যত ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ বন্ধ হয়। যাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি সিলেটের দিকে প্রবেশ করতে না পারেএই ব্যবস্থা। বলা প্রাসঙ্গিক যে, পাক সৈন্যরা ২৬ মার্চ মৌলভীবাজার অবস্থান নিয়ে শ্রীমঙ্গলের পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। তারা আগের দিন পাকসেনাদের ড্রাইভার মনে করে পেট্রল সংগ্রহরত এক চালক জনরোষে পড়ে। ফলে পাকসেনারা শ্রীমঙ্গল নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিল বেশি। তারা শ্রীমঙ্গল ও রশিদপুরে ব্যারিকেড ও জন-প্রতিরোধের খবর শোনে শ্রীমঙ্গলের আগেই জাগছড়া চা বাগানের পাশে অবস্থান নেয়। ২৬ মার্চ দুপুরে হবিগঞ্জ শহরে রাজনীতিবিদ-ছাত্র-জনতা এক হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দীপ্ত অঙ্গীকার করে। এলাকার ট্রেনিং প্রাপ্ত আনসার, পুলিশ, ইপিআর (অবসরপ্রাপ্তসহ) তাৎক্ষণিক বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। সংগঠকরা হবিগঞ্জ এলাকা থেকে কয়েকটি ট্রাক সংগ্রহ করেন। তখন হবিগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক জনাব আকবর আলী খানের সহায়তায় সরকারি ট্রেজারি, পুলিশ, আনসার  ও পাবলিক থেকে (ছাত্র ও রাজনীতিবিদদের কল্যাণে) অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। তখন সেনাবাহিনীতে চাকরিরত সিনিয়র মেজর সিআর দত্ত ছুটিতে হবিগঞ্জ শহরে ছিলেন। কর্নেল বর ও জননেতা কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর আহবানে তিনি এই বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব¡ নেন। শীর্ষস্থানীয়দের সিদ্ধান্তে (মানিক চৌধুরীসহ) তাঁরাবৃহত্তর সিলেট জেলা মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। তখনো হবিগঞ্জে পাক সেনা প্রবেশ করতে পারেনি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ২৭ তারিখ বিকাল পাঁচটায় সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে এই নবগঠিত যোদ্ধা টিম রওয়ানা দেয়। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল হবিগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজারের বিভিন্ন জায়গাও সীমান্ত চৌকি দখল করে সিলেট পৌঁছানো এবং পাক সেনাদের সারেন্ডার করানো। এই ব্যাপারে জেনারেল এমএজি ওসমানীর যেমন প্রেরণা ছিলতেমনি তাঁর মাধ্যমে গোপন বিএসএফ-এর যোগসূত্র থাকে বলে জানা যায়। এমনও শোনা যায় যে, প্রবাসী সরকারের নীতিনির্ধারকরা শপথ গ্রহণের বিকল্প স্থান হিসেবে সিলেটেও মাথায় রাখা হয়েছিল।

২৭ মার্চ সন্ধ্যেবেলা একটা জীপ, পাঁচটা বাস ও দুই-তিনটি ট্রাক নিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ান দেয়। কর্নেল রব, মনিক চৌধুরী ও সিআর দত্ত একটি জিপে চড়েন। তাঁদের দলে প্রথমদিকে ১৫০ জন যোদ্ধা ছিলেন (মতান্তর আছে যে, অধিকাংশ ইপিআর, প্রাক্তন সৈন্য, মুজাহিদ ছিলেন)। পরে  যোদ্ধা সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। প্রথমে কর্নেল রবের কমান্ডে যোদ্ধারা কাজ করেন এবং মানিক চৌধুরী সমন্বয় সাধন করেন। পরে কর্ণেল রব মৌলভীবাজার এসে মূল প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা ও কমান্ডের ভারাভার সিআর দত্তের ওপর দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সমন্বয়, চারদিকে যোগাযোগ রক্ষা ও সংগঠনের ভূমিকায় থাকেন। পাক সেনাদের ঠেকানোর জন্য লোকজন রাস্তায় এমন ব্যারিকেড তৈরি করেছিল যে, সেগুলো পরিষ্কার করে রশিদপুর চা বাগান পর্যন্ত পৌঁছতে যোদ্ধা দলের বেশ রাত হয়ে যায়।  ওখানে তারা ক্যাম্প করেন। এদিকে মাধবপুরে তো ব্যারিকেড ছিল। ২৯ মার্চ হবিগঞ্জের অগ্রবর্তী বাহিনী শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। 

ইতোমধ্যে ২৮ মার্চ পাকসেনাদের তিনটি জীপ মৌলভীবাজার থেকে শমসেরনগরের দিকে টহলে যাত্রা করে। শমসেরনগরে ইপিআরের নেতৃত্বে থাকেন সুবেদার শাসসুল হক চৌধুরী। তিনি ইপিআর, আনসার ও পুলিশকে সশস্ত্র রাখেন। জনতার প্রতিরোধে শসসেরনগর  রেলস্টেশনের কাছে ৩টি গাড়ি প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ইপিআরদের গুলিতে একটি গাড়ির কয়েকজন সৈন্য জীপ আহত হলে সে গাড়ি মৌলভীবাজারের দিকে ফিরে যায়। অপর দুইটি জীপ ব্যারিক্যাড সরিয়ে শমসেরনগর থেকে ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে টহলে যায়। এই দলের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল (পশ্চিমা)। পাকসেনারা ভানুগাছ গিয়ে আর শ্রীমঙ্গলে যায়নি। তারা পুনরায় শমসেরনগরের দিকে যাত্রা করে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ইপিআর ও মোজাহিদ সদস্যরা শমসেরনগরের চৌমোহনী চত্বরের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী গঙ্গারামের দোতলায় উঠে অ্যাম্বুস করেন। তখন গুলিতে দুইটি জীপ উল্টে গিয়ে ৯জন পাক সৈন্য তাৎক্ষণিক মারা যায় (ভানুগাছের দিকের রাস্তায়)। এই সঙ্গে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের মৃত্যু ঘটে। জীবিত ৩জন সৈন্যকে জনতা ক্রমে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সিলেটে থেকে এই খবর অনেক কষ্টে পাক কমান্ড পেয়েছিল। তখন কমান্ড ছিল সিলেটকেন্দ্রিক। তাদের মধ্যে একটা ভয় ও বিষাদ কাজ করে। ফলে মৌলভীবাজারের দিকে আসা পাক সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। অথচ তারা দেখছে শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত প্রতিরোধ যোদ্ধারা পৌঁছে গেছে। অবশেষে পাক সৈন্যরা পিছু হটে গিয়ে শেরপুরবিশেষত সাদিপুর অঞ্চলে গিয়ে অবস্থান নেয় ও ব্যূহ তৈরি করে। এই সুযোগে বিনা বাঁধায় হবিগঞ্জ থেকে রওয়ানা দেওয়া সেই অগ্রবর্তী দল মৌলভীবীজার শহরে পৌঁছায় ২৯ মার্চ। তাঁরা পৌছার আগেই পাকসেনারা পিটিআই ছেড়ে চলে যায়। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য পিটিআই ক্যাম্পাসকে অস্থায়ী সদর দপ্তর করা হয়। শ্রীমঙ্গলে থাকে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র। সংগ্রাম কমিটি যোদ্ধাদের খাদ্য যোগান দেয়। পিটিআই-এ শুরু হয় যুদ্ধ ট্রেনিং। আবার বন্দুক চালাতে সক্ষম এমন কয়েকজন যুবক যোদ্ধাদলের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পাকসেনাদের হঠানোর জন্য সিআর দত্তের নেতৃত্বে শেরপুর-সাদিপুরের অগ্রসর হতে থাকেন। মৌলভীবাজার পিটিআইকে ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে’ রূপান্তরিত করে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছিল। তখন সিলেটের নানা জায়গায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার খবর ছাড়িয়ে পড়ে। বিয়ানীবাজার থেকে ঊনচল্লিশজন প্রতিরোধ যোদ্ধা ট্রাকে করে পিটিআই ক্যাম্পাসে পৌঁছেন। এই দলের তরুণ যোদ্ধা ছিলেন বিয়ানীবাজারের আব্দুল মালীক ফারুক। তিনি তাঁর ‘যুদ্ধযাত্রা একাত্তর’ গ্রন্থে পিটিআই যুদ্ধক্যাম্পের স্মৃতিচারণ করেছেন (বিয়ানীবাজার ২০১৬, পৃ. ২৭)। এদিকে হবিগঞ্জের তেলিয়াপড়া ও আশারাম বাড়ির দিকে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়। তেলিয়াপাড়ায় গোপন ট্রেনিং থেকে স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে আরো প্রতিরোধ যোদ্ধা চলে আসে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ৩০ মার্চ আশারাম বাড়ির দিকে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ভারতীয় হাই কমান্ডের নির্দেশ না থাকায় তারা প্রত্যক্ষ সাহায্য না করলেও (বিএসএফ) গোপনে হাত বাড়ায়। সিন্দুরখান সীমান্ত দিয়ে ছদ্মবেশে চা বাগানের ট্রাকে করে কিছু বিএসএফের প্রবেশের কথা অধ্যাপক স্যায়ীদ মুজিবুর রহমান ও কয়েকজন মুক্তি যোদ্ধা জানান। তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন। নিরাপত্তার জন্য শ্রীমঙ্গলে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প সুদৃঢ় করা হয়। শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। মো. ইলিয়াস এমএলএ কয়েকবার শ্রীমঙ্গল চাবাগান অঞ্চলের ডাকবাংলায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। সে সময় জেমস ফিলনের চা বাগানসমূহের কর্মকর্তা এসএম উদ্দিন (বাড়ি : সাদিপুর) গোপনে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবহনের জন্য বাগানের ট্রাক্টর ও অর্থ প্রদান করেন।

শেরপুরের গণ-প্রতিরোধ যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। সেখানে অবস্থান নেয় মৌলভীবাজার থেকে পিছুহটা ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৩ প্লাটুন পাক-সৈন্য। মৌলভীবাজারে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে (পিটিআই) সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে তিনটি কোম্পানি গঠন করা হয়। এই সশস্ত্র মাঠ-যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকেন সিআর দত্ত। ২৯ মার্চ ভোর রাতেই শেরপুরে যুদ্ধ শুরু হয়। সাহসী জনতাও সঙ্গে থাকে। তখন নদীতে ফেরিচলাচল করতো, সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। ৩ এপ্রিল সাদিপুরে ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে কয়েজন শহীদ হয়। কৌশলগত কারণে মুক্তিবাহিনী শেরপুর ও সাদিপুর যুদ্ধে জয়ী হয় এবং পাকসেনাদের হটিয়ে দিয়ে সিলেটের দিকে নবউদ্যোগে যাত্রা করে। পাক সেনারা ভয়ে সিলেট বিমানবন্দরে দিকে ছুঁটে চলে। মুক্তিযোদ্ধারা ধারণা করেছিল সিলেটে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করতে পারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার কাছে বিমানবন্দরে রক্ষিত তাদের শক্তি সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য ছিল না। মুক্তিবাহিনী সিলেটের মজুমদারীর সন্নিকটের বাগানে পৌঁছাতে গিয়ে বাঁধা পায়; তাদের অবস্থান থাকে আম্বখানার কলোনি পর্যন্ত। এমনকি পরিকল্পিত উপায়ে শহরের যোদ্ধাদের মোতায়েন করা যায়নি। তাই কীনব্রিজের দক্ষিণ দিকে (কদমতলী এলাকা, রেলস্টেশন) তাদের ডিফেন্স রাখে। যোদ্ধারা কয়েকদলে ভাগ হয়ে সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরে কীনব্রীজের মুখ তীরে অবস্থান নেয়। পরে শহরে প্রবেশ করে ছোট ছোট কয়েকটি দল। একটি দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার খান (বাড়ি: রাখা, মৌলভীবাজার সদর) সেনা সদস্য ছিলেন। তিনি ও তার দল আম্বরখানা-সুবিদবাজার গিয়ে পাকদের গুলির মুখে পড়ে আখালিয়া-সুনামগঞ্জের দিকে আত্ম রক্ষার্থে যাত্রা করেন। এভাবে কয়েকদিন (৪ থেকে ৮ মার্চ) বৃহত্তর সিলেট মোটামুটি মুক্ত থাকে। ৭ এপ্রিল সিলেট শহর মুক্ত হয় এবং প্রতিরোধ যোদ্ধা ও জনতা সিলেট জেলখানা ভেঙ্গে বন্দিদের মুক্ত করে নেয়। চারদিকে স্বাধীন পতাকা উড়তে দেখা যায়। সিলেট পর্যন্ত মেজর সিআর দত্তের কমান্ড অব্যাহত থাকে। এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ বিয়ানীবাজার থেকে সিলেটের দিকে যাত্রা করে কদমতলী পৌঁছে যুদ্ধ করেন। ৯ ও ১০ এপ্রিল শহরে ও আশপাশে তুমুল যুদ্ধ হয়। অন্যদিকে গোপনে পাক সেনারা দ্রুত নিজেদের শক্তি ও অস্ত্র বৃদ্ধি করতে থাকেতারা দ্রুত বিমান সাপোর্ট পায়। 

সিলেটে পাকিস্তানী সামরিক শক্তি ও অস্ত্র একবারে কম ছিল না। ৩১৩ পদাতিক ব্রিগেডকে আটকানোর মতো প্রতিরোধ যোদ্ধার সংখ্যা যেমন কম থাকে; তেমনি ভালো অস্ত্রও ছিল না। কিন্তু তাদের ছিল মনোবল ও উদ্দীপনা। সিলেটকে মুক্ত রাখার জন্য আরো অস্ত্র ও যোদ্ধার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কোনো যোগান ছিল না। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ইপিআর ও অল্প সংখ্যক সৈন্য ছাড়া বিশাল সংখ্যক তরুণদের প্রশিক্ষণ ছিল মাত্র কয়দিনের। যুদ্ধ কৌশলও তাদের না জানার কথা। পাকসেনাদের তখন একমাত্র ভরসা ছিল বিমান যোগাযোগ। এই অবস্থা ধরে রাখতে সীমান্তবর্তী ভারতের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। তখনো দিল্লি থেকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ও সাহায্যের কোনো বার্তা আসেনি। সবকিছু চলছিল অনানুষ্ঠানিক। 

এমতাবস্থায় জন-প্রতিনিধিরা কিছু অস্ত্র গোপনে সীমান্ত দিয়ে সংগ্রহ করেন (আশারামবাড়ি)। প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআর, মোজাহিদ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশকে সামনে রেখে ওপারে থেকে স্বল্পমাত্রায় সাহায্য আসতে থাকে। ৩ এপ্রিল দেওয়ান ফরিদ গাজী, মো. ইলিয়াস, ইছমত চৌধুরীসহ উচ্চ পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা শ্রীমঙ্গলের দিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। কিন্তু বড় ধরনের সাহায্য আসেনি। তবুও সিলেটের দিকে অগ্রবর্তী অবস্থা ধরে রাখতে জেনারেল এমএজি ওসমানীর নির্দেশনায় ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতনরা তাঁর উপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সভা করেন। সেদিন আবার বেঙ্গল রেজিমেন্টের পূর্বাঞ্চলের কয়েকজন কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, এমএলএ ও এমপিএ মিলে ৪ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল ডাকবাংলায় পুনরায় বৈঠক করেন (সাধারণের বেশে কয়েকজন বিএসএফ কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানা যায়)। এমতাবস্থায় শ্রীমঙ্গল গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। শ্রীমঙ্গল সীমান্তবর্তী থাকায় তখনো অঞ্চলটি অনেকটা স্বাধীন ছিল। ভারতীয় সাহায্য এই পথ দিয়েই আসত। সিলেটকে মুক্ত রাখার পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা সীমান্তবর্তী চা বাগানের ডাকবাংলোতে ঘনঘন বৈঠকে জোরালো হয়। এস এম আলীর কথা এখানেও স্মরণীয়। শেরপুর যুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে ৫ এপ্রিল মৌলবীবাজারে উচ্চ পর্যায়ে সামরিক অফিসার, ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (সামরিক পোশাক ছাড়া) এবং এমএলএ ও এমপিএদের বৈঠকে রণ কৌশল কিছুটা নির্ধারিত হয়। এই বৈঠকে উত্তরপূর্ব রণাঙ্গণের দায়িত্ব পড়ে সিআর দত্তের ওপর। ক্যাপ্টেন আজিজ থাকেন শেরপুর-সাদিপুর রণাঙ্গণে। ৭ এপ্রিল কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী আগরতলা গিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি অবহিত করেন। তারা সাহায্যেও আশ্বাস দেয়। ৮ এপ্রিল আগরতলা থেকে মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে বেশ বড় অস্ত্র চালান পাওয়া যায়। মূলত এদিকের অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানীদের প্রায় মাসখানেক ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল। সম্ভবত ৮ এপ্রিল ভারতীয় বিএফএফ ক্যাপ্টেন লিমাইয়া গোপনে সিলেট পরিদর্শন করেন ও  মেজর সিআর দত্ত ও ক্যাপ্টেন আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

প্রথম পর্বে মৌলভীবাজার মহকুমা শত্রুমুক্ত হয়ে সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে সবকিছু পরিচালিত হতে থাকে। মৌলভীবাজারস্থ পিটিআই ক্যাম্প ও শ্রীমঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আরো সক্রিয় হলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলাতে থাকে। 

পাক সেনাদের পাল্টা অভিযানে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ দখল :

পাকরা সিলেট বিমানবন্দর অবস্থান নিয়ে ব্যাপক যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের শক্তি সম্পর্কে প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধরা আঁচ করতে পারেননি। পাকসেনারা মরিয়া হয়ে সীমান্ত অঞ্চল বন্ধ করতে এবং সিলেট পুনরুদ্ধার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ফলে তারা আর দেরী না করে ৯মার্চ  থেকে ‘পোড়ামাটি নীতি’র আলোকে অগ্রসর হতে থাকে। সিলেট শহর ছিল তাদের ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম টার্গেট। তবুও প্রতিরোধ যোদ্ধারা শহরের প্রাণ কেন্দ্র চৌহাট্টায় দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করতে থাকে। তাদের গুলিতে পাকদের জীপ উল্টে কয়েকজন সৈন্য মারা যায় (কারো মতে তিন জন)। পাক সৈন্যরা মূহুর্ত দেরি না করে মুক্তিবাহিনী খুঁজতে গিয়ে বর্তমান শহীদ শামসুদ্দীন হাসপাতালে গিয়ে কয়েকজন ডাক্তার ও কর্মচারীদের হত্যা করে (শহীদ ডা. শামসুদ্দিন, শহীদ ডা. লালা প্রমুখ)। পাকসেনারা শহরে নির্বিচারে হত্যা, আগুন দিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। পাকসেনারা সুরমার কীনব্রিজ অতিক্রম করতে অনেক বেগ পায়। বিমান সহায়তা নিয়ে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অধিক্ষণ যুদ্ধ করে কদমতলী, রেলস্টেশন, চণ্ডিপুল, ধরাধরপুর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান নেয়। এভাবে ৯-১০ এপ্রিল পর্যন্ত কেউ কাউকে ছাড়েনি। পরে প্রচণ্ড বিমান হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে ওয়াকিটকি/যোগাযোগ ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি ছিল না। একদল যোদ্ধা বিয়ানী বাজার -সুতারকাদি দিয়ে ভারত সীমান্তে যায়; অন্যদল মৌলভীবাজারের দিকে গিয়ে সাদিপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকসৈন্যদের এই গতি রোধ করার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও রসদ ছিল না। তবুও খণ্ড-খণ্ড যুদ্ধ চলত। পাকসেনাদের বিশাল দল ঢাকাদক্ষিণ-জকিগঞ্জ-বিয়ানী বাজারের পথে হাঁটে, অন্যদল ফেঞ্চুগঞ্জে দিয়ে অগ্রসর হয়ে মোগলাবাজারের দিকে ঘাঁটি করে। সর্ববৃহৎ দলটি রওয়ানা দেয় শেরপুর মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ সড়ক পথ ধরে। পাকসেনাদের লক্ষ্য ছিল পুরো সিলেট জেলা দখল করা। এবং সড়ক ও রেলপথ পুনরায় চালুকরণ। তাদের কাছে ছিল তখনকার অত্যাধুনিক অস্ত্র। এই পর্বে পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় কুলাঙ্গারের দল ‘রাজাকার’। যারা ‘পাকিস্তান’ ও ‘ইসলাম’ রক্ষার নামে পাকদের প্রকাশ্যে সাহায্যের জন্য বের হতে থাকে। তারাই নরঘাতকদের রাস্তা, গ্রামীণ পথ-ঘাট, নেতাদের বাড়ি ও অবস্থান ইত্যাদি বলে দেয়। হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজারের প্রতিরোধ যোদ্ধারা পুনরায় একত্রিত হয়ে সাদিপুর ও শেরপুরে বিশাল ব্যারিকেড তৈরি করেন। রাস্তায় এমন ব্যারিকেড ছিল যে, পাকসেনাদের সিলেট থেকে সাদিপুর পর্যন্ত পৌঁছাতে ৯ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় নেয়। ১৫ এপ্রিল রাত থেকে সাদিপুর অঞ্চলে দফায়-দফায় সংঘর্ষ চলে। যা ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর মধ্যে পাকদের সহায়তা করতে ১৬, ১৭ ও ২৫ থেকে ২৬ এপ্রিল সাদিপুরে বিমান হামলা চালায়। উভয় পক্ষের অনেক হতাহত হয় (কারো কারো মতে এই যুদ্ধে চারশ জনের মতো মারা যায়)। কিছু মৃতদেহ ট্রাকে করে শ্রীমঙ্গল হয়ে আশারামবাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যোদ্ধা জানিয়েছিলেন। এবেলার সাদিপুর যুদ্ধে কমান্ডার ক্যাপ্টেন আজিজ যুদ্ধে ঘোরতর আহত হলে তাঁকে শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট চা বাগানে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই হাসপাতাল তখন যোদ্ধাহত চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাঁর অবর্তমানে এদিকে নেতৃত্ব দেন মেজর নূরুজ্জামান ও লে. কর্নেল আব্দুল মান্নান। তাঁরা জীবন পণ করে যতদিন পারা যায় পাকদের ঠেকানোর চেষ্টা চালান। এই যুদ্ধের বীরমুক্তিযোদ্ধা পুলক ধর (আগে শ্রীমঙ্গল চা বাগানে ছিলেন; বর্তমানে জাফলং থাকেন) জানান যে, তখন মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল-হবিগঞ্জ রক্ষার জন্য প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাদিপুর-শেরপুর ডিফেন্সে ভারতীয় বাহিনী গোপনে ও ছদ্মাবরণে অনেক সাহায্য করে যায়। বিমান আক্রমণে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শেরপুর ব্যূহ একপর্যায়ে ভেঙে যায়। পাক সেনারা শেরপুর ও সাদিপুরের আশপাশের সকল বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারা সাদিপুরে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে নেয়। আরেকটি ডিফেন্স করে শেরপুরে। তখন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংখ্যা কমতে থাকে। তবুও যোদ্ধারা মনুমুখ, বেকামুড়া ও কামালপুর এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

শেরপুর পতনের পর মুক্তিযুদ্ধের নীতি-নির্ধারকগণ আত্মরক্ষা এবং হিট এন্ড রান পলিসি অবলম্বন করেন। পাকসেনাদের হাতে যাতে নগদ অর্থ না যায় সে জন্য যুদ্ধসারথী জেনারেল এমএজি ওসমানীর নির্দেশনায় ২৬ এপ্রিল মোহাম্মদ ইলিয়াসের নেতৃত্বে (সিভিল ড্রেসে কয়েকজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ও মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন মিলে তাদের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে) মৌলভীবাজারস্থ ইস্ট পাকিস্তান ন্যাশন্যাল ব্যাংকের ভোল্ট ভেঙ্গে ২ কোটি ৫ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ভোল্ট যখন ভাঙ্গা হয়Ñতখন একদল গোয়েন্দা-সৈন্য গিয়াসনগরের বর্তমান কৃষি গবেষণাগারে (এই জায়গাকে বলা হতো ‘সুধা বাবুর বাংলা’) অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। ব্যাংকের টাকা পরে এম আর সিদ্দিকী ও কর্নেল রবের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের ফান্ডে ২ কোটি টাকা জমা হয়। বাদবাকি ৫লক্ষ টাকা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ও অস্ত্র, চিকিৎসা প্রভৃতি খাতে ব্যয় হয়েছিল। স্থানীয়ভাবে এই টাকা নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ও সন্দেহমূলক গল্পের জন্ম দেয়—যা ছিল অনেকটা কাল্পনিক ও অমূলক। এধরণের একটি সন্দেহজনক চিঠি লেখক দেখেছেন। শেরপুর থেকে পাক সেনারা চারদিকে গণহত্যা চালিয়ে প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে ধীরে অগ্রসর হয়। ২৮ এপ্রিল যখন বুঝা গেল পাক সেনারা শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত এসে পড়বে—তখন পিটিআই ক্যাম্পসহ অন্যান্য জায়গার মুক্তিযোদ্ধারা রসদপত্র নিয়ে শ্রীমঙ্গল হয়ে সীমান্তে যাত্রা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন মো. আজিজুর রহমান এমপিএ-র হিসেব মতে, ২৯ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল থেকে কয়েক হাজার ব্যারেল পেট্রল, ৩০ লাখ সিগারেট, কয়েক হাজার মন চাউল, ২৫০টি ট্রাক্টর, ৩০০ ট্রাক, ২০০ জীপ নিয়ে তারা ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় সংগঠিত করতে থাকেন (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ড)। গাড়ির এই হিসেবে অনেকের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে—তবে অধিকাংশ গাড়ি ছিল সিলেট চা বাগানগুলোর, কয়েকটা ভারতীয় সাহায্যের, বাদবাকী বিভিন্ন কনট্রাক্টারের ও ব্যক্তি মালিকানাধীন।

পাক সেনারা ২৯ এপ্রিল মৌলভীবাজার পুনর্দখল করে নেয় এবং পিটিআই ক্যাম্পাসে তারা পুনরায় হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে। এমতাবস্থায় মৌলভীবাজার শহরের দোসররা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে ওঠে। মৌলভীবাজার হেডকোয়ার্টার থেকে পরিকল্পনামাফিক সারা জেলায় পাকসেনারা বিস্তার লাভ করে। পরে শ্রীমঙ্গলেও তারা শক্ত অবস্থান নেয়। পাকসেনারা শহরের প্রান্তে বর্তমান বিডিআর ক্যাম্প সংলগø ‘সাধুবাবার থলা’কে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি বানায়। ২৯ এপ্রিল পাক সেনারা শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে বড় ঘাঁটি তৈরি করে। সেখান থেকে একদল যায় হবিগঞ্জ। ক্রমে পাকসেনারা তাদের দোসরদের সহযোগিতায় মিরপুর রশিদপুর বাহুবল চুনারুঘাট মাধবপুর প্রভৃতি স্থানে শক্তিশালী অবস্থান নেয়। তখন পাকদের ছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ও পোড়ামাটি নীতি। তারা দ্রুত বিভিন্ন সীমান্তের ইপিআর ফাঁড়িতে পৌঁছায়। ক্রমে তারা ধলই ফাঁড়ি, কুলাউড়ার লাঠিটিলা, জুড়ির দিলকুশা চা বাগান, কাপনাপাহাড়, শমসেরনগর বিমান বন্দর প্রভৃতি স্থানে শক্তি বৃদ্ধি করে নেয়। পাকদের কাছে বড় দুশ্চিন্তা বিষয় ছিল সীমান্ত রক্ষা করা। তাদের সৈন্য সংখ্যাও পর্যাপ্ত ছিল না।

এবার পাকিস্তনী বাহিনী তাদের এই বিজয় ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারাও রাজাকারদের ট্রেনিং দেয়। মে মাসে তারা নির্বিচারে তাÐব চালায়। ১৩ মে মনুব্রীজের ওপর (পুরাতন লোহার ব্রীজ) প্রদর্শন করে দুইজনকে হত্যা করে। ময়নামতি ক্যান্টমেন্টের সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভৈরব এবং ঢাকা রক্ষায় ব্যস্ত থাকে। কারণ এই দুই জেলা দিয়ে ঢাকা প্রবেশ সহজ ছিল। ফলে তারা মধ্যবর্তী ও সীমান্তবর্তী অঞ্চল হিসেবে মৌলভীবাজারকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার করে। তাদের সুরক্ষিত হেড কোয়ার্টারের অবস্থান ছিল সেই মৌলভীজাবার পিটিআই ক্যাম্পাস। ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা মৌলভীবাজার হেড কোয়ার্টারে অবস্থান নিয়ে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ প্রথম দিকে মৌলভীবাজার থেকে তারা হবিগঞ্জ-সিলেট-সুনামগঞ্জ পুরোটা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একাংশ (গঙ্গাসাগর পর্যন্ত) পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতো। এই বিশাল অঞ্চলের জন্য সৈন্য সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অতি অল্প। প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মূল যুদ্ধ শুরু হলে সিলেট বিমানবন্দর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ভৈরব রক্ষার্থে আলাদা ব্রিগেড ও গোলন্দাজ ইউনিট নিয়োগ করে। তখন মৌলভীবাজারে ৩১৩ পদাতিক ব্রিগেড এবং সিলেটে ২০২ অ্যাডহক ব্রিগেড মোতায়েন করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আলাদা কমান্ডে চলে যায়। তখন বৃহত্তর সিলেটের সীমানা দক্ষিণে চুনারুঘাট পর্যন্ত রাখে। এবং সালুটিকর বিমানবন্দর শক্তিশালী করে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ মহকুমা শহর এবং আশপাশের থানাগুলো নিয়ন্ত্রণ চালায়। সম্ভবত সৈন্য সংখ্যা কম থাকায় সুনামগঞ্জের দিকে বেশি সৈন্য মোতায়েন করতে পারেনি। ফলে সেখানে রাজাকারের সংখ্যা বাড়ায় বলে অনেকের ধারণা। 

উল্লেখ্য যে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চল (উত্তরাঞ্চল) নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকেন ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ (২০২ বিগ্রেড)। অন্যদিকে মৌলভীবাজারের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা (৩১৩ পদাতিক)। পরে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানাকে সিলেটের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। মৌলভীবাজারে পাকদের সদর দপ্তরের কমান্ডে পালাক্রমে কর্নেল সরফরাজ, মেজর দাউদ, ক্যাপ্টেন ইউসুফ, ক্যাপ্টেন জাফর, ক্যাপ্টেন আজিজ (রাজনগরের রাজাকার আবুল হোসেন তার বোনকে বিয়ে দেয়) প্রমুখ থাকলেও তখন সিলেট গঠনমূলক ভূমিকায় থাকে। বলা আবশ্যক যে ধলই ফাঁড়ি তাদের হাত ছাড়া হলে সিলেটকে তারা শক্তিশালী করতে থাকে।

(চলবে)


এএফ/১০