দীপংকর মোহান্ত
২০ ডিসেম্বর , ২০২২
গবেষক ও প্রাবন্ধিক
উল্লেখ্য যে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চল (উত্তরাঞ্চল) নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকেন ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ (২০২ বিগ্রেড)। অন্যদিকে মৌলভীবাজারের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা (৩১৩ পদাতিক)। পরে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানাকে সিলেটের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। মৌলভীবাজারে পাকদের সদর দপ্তরের কমান্ডে পালাক্রমে কর্নেল সরফরাজ, মেজর দাউদ, ক্যাপ্টেন ইউসুফ, ক্যাপ্টেন জাফর, ক্যাপ্টেন আজিজ (রাজনগরের রাজাকার আবুল হোসেন তার বোনকে বিয়ে দেয়) প্রমুখ থাকলেও তখন সিলেট গঠনমূলক ভূমিকায় থাকে। বলা আবশ্যক যে ধলই ফাঁড়ি তাদের হাত ছাড়া হলে সিলেটকে তারা শক্তিশালী করতে থাকে।
১৯৭১ সালে মৌলভীবাজার পিটিআই এ পাকিস্তানী সেনাদের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার ছিল। ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা এই সুরক্ষিত ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে থাকতো। নীচে দুটি কক্ষ রয়েছে।
মৌলভীবাজার পিটিআই’য়ে শক্তিশালী ভূ-গর্ভস্থ বাঙ্কার নির্মাণ
ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা ব্রিগেডের দায়িত্ব নিয়ে মৌলভীবাজার যোগদানের পরপর সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও তার হেড কোয়ার্টারের নিরাপত্তার ওপর জোর দেয়। তাদের পরিকল্পিত ছকের দিকে চোখ ফিরালে প্রতীয়মান হয় যে, হবিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সীমান্তবর্তী অঞ্চল মে ও জুন মাসের মধ্যে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে। অর্থাৎ চুনারুঘাট তেলিয়াপাড়া, শায়েস্তাগঞ্জ, সিন্দুরখান, খেজুরিছড়া, ধলই, পাত্রখলা, শমসেরনগর, দিলখোশা, লাঠিটিলা, কাপনাপাহাড়, বড়লেখা, শাহবাজপুর, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, রাধানগর, জৈন্তা, ছাতক, টেংরাটিলা, তাহিরপুর প্রভৃতি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাদের সৈন্য পরিকল্পিতভাবে সাজায়।
মে মাসের শুরুতে পাকসেনারা মৌলভীবাজার মহকুমা শহরের আশপাশের ইট ভাট্টা থেকে হাজার হাজার ইট নিয়ে সারা পিটিআই-এর রাস্তা, সামনের দিকে শক্ত করে বসায়। তারা সরকারি বিএন্ডবি থেকে প্রচুর ইট পায়। তখন মৌলভীবাজারের নামকরা ইট ব্যবসায়ী ছিলেন মো. আলী হোসেন নামে একজন প্রথম শ্রেণির কনট্রাক্টর, (বাড়ি: যশোহর—তার উত্তর পুরুষ এখনো মৌলভীবাজারের পাগুলিয়া এলাকায় বসবাস করছেন); আবার শহরের বড় ঠিকাদার মোবারক মিয়ার ইটের ভাটা থেকে সকল ইট নিয়ে আসে। ফলে পাকসেনাদের ইটের অভাব হয়নি। অসংখ্য ইটের গায়ে ইংরেজিতে ‘১৯৭১’ লেখা রয়েছে। পিটিআই-এর বর্তমান একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ভবনের আড়ালে সৈন্যরা বিশাল একটি ভূ-গর্ভস্থ বাঙ্কার করে—যা আজো অক্ষত রয়েছে। এই বাঙ্কারের মধ্যে ছিল দুইটি কক্ষ। মাটির নীচের এই বাঙ্কারের ছাদ, চারপাশ এবং সিঁড়ি পাথর, সিমেন্ট ও রড দিয়ে প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরো করে ঢালাই দেওয়া—যাতে সাধারণ বম্পিং বা ফায়ারিং প্রতিরোধ করতে পারে। বাঙ্কারের দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট ও প্রস্থ ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। তার পাশেই কামান বসানো/দাগানোর জন্য একটি পাকাকৃত উচুঁ ভিত্তি রয়েছে। বাঙ্কারের উপরের ছাদ আবার চারদিকে ইটের দেওয়াল দিয়ে তারমধ্যে মাটি ফেলে কৃত্রিম টিলা বানানো। দূর থেকে মনে হতো এটি একটি টিলা। মাটির নীচের এই বাঙ্কার দেখলেই বুঝা যায় যে, সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তায় পারদর্শী লোক দ্বারা এটি তৈরি করা হয়েছিল। তার সুরক্ষিত ভিতরে থাকে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানা।
মৌলভীবাজার পিটিআই নিকটস্থ পর্যটন কেন্দ্রের ঘর [দুতলা ছিল, এখন ভাঙা হচ্ছে ], যেখানে সেনা কর্মকর্তা থাকতো। তার আশপাশ বধ্যভূমি ও গণকবর ছিল।
পিটিআই নির্যাতন কেন্দ্র, বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থান হয়ে ওঠে
দ্বিতীয় দফায় পাক সেনারাপিটিআইকে বিগ্রেড হেডকোয়ার্টার করলে পিটিআই চারপাশকে এবং ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে। পিটিআই-এর কক্ষগুলো ছিল নারী ও পুরুষদের নির্যাতনের কেন্দ্র। আবার লাশগুলো ফেলা হতো বর্তমান পিটিআই এর পশ্চিম দিকের পুকুরে (পুকুরে বাড়িঘর হয়ে গেছে), কুয়ার মধ্যে (একটি কুয়া এখনো দৃশ্যমান) এবং বর্তমান সুপার কুয়ার্টারের ঢালুর জায়গায় (এখন এই জায়গায় মহিলা হোস্টেল হয়েছে) এবং ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের চারদিকের গর্ত করে লাশ রাখে। ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের যে দিকে এখনো বাসাবাড়ি হয়েছে—চল্লিশ বছর আগেও সেখানে গণকবরের চিহ্নস্বরূপ অনেক গর্ত চক্ষুস্মান ছিল। মৌলভীবাজার পিটিআই-এর বর্তমান নতুন মহিলা হোস্টেলের নীচে একটি পুকুর ছিল—যেটা বাহাত্তর সালের দিকে খনন করা হয়েছিল—এটি খনন কালে কিছু হাড়গুড় পাওয়া যায়।
নারী নির্যাতন
মে থেকে জুলাই পর্যন্ত পাকসেনাদের কাজ ছিল গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালানো, ‘ভারতীয় শত্রুদের’ ঠেকিয়ে রাখা। কারণ তখনো ওপারে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ট্রেনিং গ্রহণে ব্যস্ত। সীমান্ত অঞ্চলে তারা ‘হিট ও রান পলিসি’তে পাকদের উপস্থিতি জানান দিতেন। এই পর্যায়ে বিনা বাঁধায় পাকসেনারা চারদিকে নির্যাতন করে যায়। তখন আর প্রতিরোধ ছিল না। টহলে গিয়ে নারীদের ধরে নিয়ে আসতো। অনেক বনেদি পরিবারের মেয়েকে তারা বিনা বাঁধায় নিয়ে আসে ক্যাম্পে; কাউকে আবার ফিরত দিত। ওটা ছিল নিয়মিত রুটিনের মতো। না বললে উপায় ছিল না। অনিচ্ছায় অনেক নারীকে আসতে হয়। টহলে গিয়ে পাকসেনারা ধর্ষণ করতো বেশি। প্রতিটি গণহত্যার সময় বা তার একটু পরে তারা নারীদের ওপর আদিমতায় লিপ্ত হতো। নরিয়া গণহত্যা, পাঁচগাও গণহত্যা, ভাড়াউড়া চা বাগান গণহত্যার পর নারী নির্যাতন বীভৎস ধরন ছিল প্রায় একই কায়দায়। শমসেরনগরের ডাকবাংলার ক্যাম্পে বহু নারী বন্দি ছিলেন। তন্মধ্যে একজন জয়গুন নাহার খানম ছিলেন—পরে তিনি যুদ্ধ শিশুর জন্ম দেন। শমসেরনগর ও মৌলভীবাজার শহরের বনেদি মুসলিমলীগের কয়েকটি পরিবার স্বপ্রণোদিত হয়ে পাকদের দাওয়াত খাবায়। খাওয়ার পর পাকরা জিজ্ঞাস করেছিলেন, ‘ল্যাড়কি কোন্ হ্যায়’। এই সমস্ত পরিবারের নারীদের ওপর নীরবে নরকযজ্ঞ বানিয়ে ছাড়ে। আমাদের মায়েরা দুর্বিষহ যন্ত্রণায় বহন করেছেন; কিন্তু মুখ ফুটাতে পারেননি। অনেক পরিবার ‘চুপচুপ’ করে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন—এই সকল যুদ্ধমায়েদের নাম ইতিহাসে আর কখনো আসবে না। আমাদের উচিত হবে তাদের নাম সামনে নিয়ে আসা এবং জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা।
পাকিস্তানি সেনাদের আশকারায় দীঘলগজী গ্রামের রাজাকার আসিদ আলী একটা বাহিনী গড়ে তুলে। সে নারী নির্যাতন করতো। দেশ স্বাধীন হলে বীরাঙ্গনা লিপি বেগম তার বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করেন। সে রাজাকারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
ব্রিগেডিয়ার রানার ইফতেখার রানার ভূ-গর্ভস্থ একটি কক্ষে বিনোদনের জন্য নারী রাখা হতো। এই নারীরা ছিলেন নিরাবরণ। কারণ লম্বা কাপড় পরনে থাকলে মেয়েরা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। কুলাউড়ার রবির বাজারের পূর্ব দিকে ফটিকুলি গ্রামে দুই বোন আত্মহত্যা করে ‘পাকদৈত্য’দের হাত থেকে বাঁচেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী পিটিআই ব্যাঙ্কার থেকে থানা বাজারের কাছের একজন ডাক্তারের দুইজন মেয়েকে উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। এই বাঙ্কারে নারীদের জন্য রুটি দিয়ে আসতো তৎকালীন মৌলভীবাজার পিটিআই-এর বাবুর্চি এখলাছুর রহমান। তার দেখা বর্ণনা লেখার মতো নয়। আবার ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসে মেজর, কর্নেল প্রভৃতি র্যাঙ্কের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকতো। তাদেরও বিনোদনের কক্ষ ছিল আলাদা-আলাদা; আলাদা নারীও। সাধারণ সিপাহিদের নারী নিয়ে বিনোদনের জায়গা ছিল বর্তমান মহিলা হোস্টেলের ছাদের ওপরে ও বিভিন্ন কক্ষে। পাকসেনারা ঘাঁটি করার পর মে মাসের শেষে ও জুন মাসের প্রথমে পিটিআই শিক্ষকদের সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়। চাকরির ভয়ে কয়েকজন শিক্ষক ‘ডান্ডিকার্ড’ নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। এই দলে একজন শিক্ষক ছিলেন—অজিত শর্মা। তিনি দেখেছেন তখন দুই একটি বাস চলাচল শুরু করলে বাসের যাত্রীদের জোরে ধরে নিয়ে পিটিআই এলাকায় কাজ করাতো। তিনি থাকতেন বর্তমান মহিলা হোস্টেলের নীচ তলায়। রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে বুটের চলাচল তিনি লক্ষ্য করেছেন। নারী কন্ঠের কান্নার শব্দ তিনি শোনেছেন। একবার ছাদের ওপর রক্তও দেখেছিলেন। তাদের জন্য চলাচল ছিল খুবই সীমিত। পরীক্ষার পর তাদের বিদায় করা হয়। পিটিআই ক্যাম্পাসে ইট বিছানোর কাজ করেছেন এখলাছুর রহমান। তিনি জানিয়েছিলেন প্রতিদিন লোক ধরে নিয়ে কাজ করাতো কিন্তু তাদের মজুরি দেয়নি। দিঘলগজী গ্রামের মুক্তির সমর্থক ফিরোজ মিয়াকে (৮০) একবার ধরে এনে পিটিআই-এর কাজ করায়। ক্ষুধার জ্বালায় তারা কিছু বলতে পারেননি। আবার যেতেও পারেননি। কয়েকদিন কাজ করার পর তিনি কৌশলে বনাঞ্চল দিয়ে লুকিয়ে চলে যান। এই সময় কিছু দালাল ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য পাকসেনাকে নারী ধরিয়ে দিতে কসুর করেনি। রাজাকাররা শহর ও গ্রাম থেকে নারীদের দিনের পর দিন যোগান দিতো। তখন শহরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিল চেক পোস্ট ও ব্যাঙ্কার। যেমন শমসেরনগর রোডের দিকে একটি চেকপোস্ট, বর্তমান হাসপাতালের নিকটে একটি চেক পোস্ট, সরকারি হাইস্কুলের পাশে কিছু সেনা তাঁবু দিয়ে থাকে। সেখানে মুসলিমলীগের পরিবারে নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা ঘটে। লেখিকা সুরঞ্জনা মায়ার বইতে তার কিছু বিবরণ রয়েছে। সরকারি কলেজের পাশ দিয়ে যে রাস্তা কালেঙ্গার দিকে গেছে—তার মুখে একটি ব্যাঙ্কারসহ চেক পোস্ট ছিল, মনুব্রীজের কাছে ছিল আরেকটি চৌকি। কয়েকশত সৈন্যের স্থান হয় মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের টিলার উপরের ছাত্র হোস্টেলে। কিছু আবার থাকে কলেজে। পাশের অরেঞ্জ টিলার পাশের কয়েকটি কাঁচা বাঙ্কার ছিল। কলেজ হোস্টেলের নীচে কিছু লাশ পড়েছিল কিন্তু সেগুলো কাদের লাশ ছিল— তা কেউই অনুসন্ধান করেননি। অরেঞ্জ টিলার বাসিন্দা এমদাদুর রহমান চৌধুরী (৭২) নিজের বাসায় বিল্ডিং করার সময় মাটি খুঁড়লে একটি গর্তে পাঞ্জাবিদের পোষাক ও বাঙালি মহিলাদের শাড়ি ও অন্যান্য উপকরণসহ হাড়-কঙ্কাল ওঠে আসে। ধারণা করা হয় যে, মিত্র বাহিনীর আক্রমণের সময় বাঙ্কারগুলো ধ্বংস হয়; তার নিচেই তারা মারা যায়। নিশ্চয় এই নারী সেখানে বন্ধি ছিলেন। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হলেন শরফুদ্দিন আহমদ (৭০), পিতা: সাদির মিয়া, অরেঞ্জটিলা। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, যেখানে সেনাদের অবস্থান ছিল বা বাঙ্কার ছিল সেখানে নারীদের যোগান আসতো নানা কৌশলে। মৌলভীবাজার শহরের আলী আমজদ বালিকা বিদ্যালয়ে পাকসেনাদের একটি মনোরঞ্জণের স্থান ছিল। যে কারণে স্বাধীনতার পরপর সে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মেয়েদের ও স্টাফদের তোপের মুখে পড়েন। পরে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
পাকসেনাদের নারী সাপ্লাইয়ার ছিল চৈত্রঘাট এলাকার একজন ঠিকাদার। মুন্সিবাজার দুর্গাপুর গ্রামের পাশে গোবিন্দপুর গ্রামের বোদাই রাজাকার ছিল পাকদের নারী সরবরাহকারী। সে তার পাশের গ্রামের রেনু বিবিকে পাকদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাঁকে অনেক ক্যাম্পে রাখা হয়। সেও এই অসহায় নারীকে তার বাড়িতে কয়েকদিন আটকে রাখে। তার একজন যুদ্ধ শিশু আছে। মৌলভীবাজারে পিটিআই-এর পূর্ব দিকে পাহাড় বর্ষিজোড়া গ্রামে অতি নিরন্ন শব্দকর সমাজের বসবাস। তাদের অপরাধ যে তারা নৌকায় ভোট দিয়েছিল। এই গ্রামের পাশেই দিঘলগজী গ্রামের আসিদ আলী নামের এক যুবক হঠাৎ করে রাজাকার হয়ে ওঠে। তার একটা ছোট ধরনের রাজাকার বাহিনী ছিল। তাদের কাজ ছিল নারী নির্যাতন ও লুট করা। তখন আসিদ আলী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতো। কারণ পাকদের কাছে তার জবাবদিহি করতে হতো না। সে পিটিআই অঞ্চলে পাকদের বরপুত্র ছিল। মাঝে মাঝে পাকরা টহলের নামে সেনাদের গ্রামে নিয়ে যেতো। সে নিজেও নারী নির্যাতন করেছে। এভাবে পাহাড় বর্ষিজোড়া গ্রামে আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ জন বীরাঙ্গণার সন্ধান পেয়েছি। তাদের মধ্যে এখন তিনজন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। এই তিনজনের নাম হলো—অনিতা কর, খেলারানি বাদ্যকর ও অশোক কর। এই তিন বীরাঙ্গণা এখন জীবনযুদ্ধে কাতর। অনিতা দু চোখ হারিয়েছেন। খেলারাণী শয্যাশায়ী, অনেকটা মৃত্যু শয্যায়। অনিতা কোনো রকমে ভিক্ষা করছেন। পাকসেনাদের অত্যাচারে তাঁর গর্ভের শিশু অকালে জন্ম নিয়ে বিদায় নিয়েছে। কে দেখবে তাঁদের? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাইয়ের পর রিপোর্ট তাঁদের পক্ষে গেলেও গেজেট ঝুলে আছে। এই হচ্ছে নিদারুণ বাস্তবতা। কেবল ঢাকার নারীপক্ষ নামে একটি সংগঠন মাসিক ওষুধের টাকা পাঠিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এই আসিদ আলী রাজাকারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েছিলেন দিঘলগজী গ্রামের লিপি বিবি (লিপি বেগম), অনোয়ারা খাতুনসহ কয়েজন নারী। একদিন তাদেরও ধরে নিয়ে যায় পাক জন্তুরা।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে এই নারীরা আসিদ আলীর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা দায়ের করেন। এই কাজে নির্যাতিত মহিলাদের সাহায্য করেন দিঘলগজী গ্রামের ফিরোজ মিয়া (তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন; বয়স এখন ৮২ বৎসর) ও রউফ মিয় (মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী ; বর্তমান বয়স ৮০)। এই মামলায় ৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। বিচারে আশিদ আলীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৪ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসিদ আলী সিলেটে আপিল করেন। কিন্তু তার রায় বহাল থাকলে দীর্ঘ দিন জেল খাটতে হয় তাকে। (সাপ্তহিক যুগভেরী, ১৯ এপ্রিল, ১৯৭৩ এবং লীলা বেগমের সাক্ষাৎকার)। পঁচাত্তর সালের পর লীলা বেগম ভয়ে দীঘলগজী গ্রাম ছেড়ে কালেঙ্গা চলে যান। আজ তিনি বয়সের ভারে কাতর। চিকিৎসাও চলছে না।
(চলবে)
প্রথমপর্ব পড়ুন-