Cinque Terre

শাকুর মজিদ

০৫ নভেম্বর , ২০২৩


স্থপতি, লেখক, তথ্যচিত্র নির্মাতা
নগর ভাবনা: সিলেটের প্রবেশপথ


বাড়িওয়ালার চরিত্র বুঝার সবচেয়ে ভালো উপায়, বাড়ির প্রবেশপথ দেখা। চরিত্রের বৈশিষ্ট ফুটে তাঁর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির পরিচয়ের মধ্যে। ঠিক তেমনি একটা শহরের প্রবেশপথে ঢুকেই তার শহরের ঘ্রাণটুকু পাওয়া যায়। আপনি অপরিচিত কোনো দেশের অপরিচিত কোনো শহরে প্রবেশ করার যে পথ, হোক তা জল-রেল-সড়ক বা বিমানপথ তার প্রবেশমুখ বলে দেবে আপনি কোন শহরে প্রবেশ করেছেন। এই শহরের মানুষেরা কোন ধর্মের অবলম্বনকারী, এই শহরের অর্থনৈতিক অবস্থা কি, এই শহরে এমন বিশেষ কি কি আছে, এই শহরের মানুষেরা কেমন পোষাক পরে, কি খায়, এই শহরের প্রকৃতি কেমন, এটা ।

আমি যদি আমাদের সিলেট শহরে প্রবেশ করি, আমরা কি দেখতে পাই?

একসময় জলপথ ছিল আমাদের শহরাভিযানের প্রধান বাহন। যখন ক্বীন ব্রিজ হয়নি, তখন এই চাঁদনী ঘাট ছিল সিলেটের প্রবেশমুখ। ১৮৮৪ সালে বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক সিলেটে সফরে এসেছিলেন। তিনি আসবেন লঞ্চে করে। এসে নামবেন এই চাঁদনী ঘাটে। নেমেই সিলেটে একটা বিলেতি ঘ্রাণ যাতে তিনি পান, তাই লন্ডনের টেমস নদীর তীরে ওয়েস্ট মিনিস্টার এবিতে যেমন একটা ঘড়ি (বিগ বেন) রাখা আছে তেমন একটা ঘড়িমিনার বানালেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পৃথিমপাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খান। নাম দিলেন নিজের ছেলে আলী আমজদ খানের নামে। তাঁর যে সামর্থ্য আর কারিগরি জ্ঞান, তাতে বিলেতের মতো ৩১৬ ফুট উচ্চতার ঘড়ি মিনার তাঁর বানানো সম্ভব হয়নি। তিনি সাকুল্যে ২৬ ফুট পর্যন্ত উঁচু করেছিলেন। লোহার খুঁটির উপর ঢেউ টিন দিয়ে বানানো। এর বছর কুড়ি আগে মাত্র লন্ডনে বিগবেনের চূড়ান্ত দফার কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে এই সিলেটে হোক না বামনাকৃতির, তবুও এমন একটা কিছু বানিয়ে স্থানীয়দের সময় দেখানোর মতো একটা মিনার খোদ বড়লাটের আগমণ উপলক্ষ্যে যে বানানো হলো তাতে বড় লাট মহোদয় খুবই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।


অনুতাপের বিষয় যে ১৮৮৪ থেকে এই ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড়শো বছর হয়ে গেলো, এখনো সিলেটকে ব্রান্ডিং করতে আমরা এই আলি আমজদের ঘড়ির তেমন কোনো যোগ্য আইকনিক বিকল্প স্থাপনা পাইনি। বন্ধু বাবু কে ছিলেন আমি ঠিক জানি না, কিন্তু শতাধিক বছর থেকে সিলেটের-‘চাঁদনী ঘাটের সিড়ি/ আলী আমজদের ঘড়ি/ জিতু মিয়ার বাড়ি/ বন্ধু বাবুর দাড়ি।'এর তেমন কোনো বিকল্প আমরা তৈরি করতে পারিনি কিংবা তার কোনো প্রকাশও দেখিনি ।

সুরমা নদীর পাড়ে প্রায় তিনশ বছর আগে নদীর তীরকে কেন্দ্র করে এখানে বাণিজ্যিক বসতি গড়ে ওঠে। ২৬.৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ সিটি করপোরেশন এখন আয়তনে বেড়ে প্রায় ৫৭ বর্গকিলোমিটারে ব্যাপ্ত হয়েছে। সিলেটের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্য্য দেশ বিদেশের হাজার হাজার সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকদের আকর্ষণ করে এখানে নিয়ে আসে। এখানকার চা- বাগান, পাথরসমৃদ্ধ জাফলং, পানি আর সাদাপাথরের অপরূপ সংগম বিছনাকান্দি, সিলেটের সুন্দরবনখ্যাত রাতারগুল, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, এছাড়াও হযরত শাহজালাল (রহ:), হযরত শাহ পরাণ (রহ:) সহ ৩৬০ আউলিয়ার মাজার, এসবের জন্য প্রতি বছর প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। বনজ, খনিজ ও মৎস সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সিলেট জেলা বিশ্বের 'দ্বিতীয় লন্ডন' হিসেবেও খ্যাত। সিলেট জেলার প্রাণকেন্দ্র সিলেট পৌরসভা (বর্তমানে যা সিলেট সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত) স্থাপিত হয় ১৮৭৮ সালে। ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প (বড় ভুইছাল) গোটা সিলেট শহরকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তুপের ওপর গড়ে উঠে আসাম ও ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর সুন্দর স্থাপনা ।

একদিকে যেমন দিনে দিনে বাড়ছে দেশী পর্যটকদের ভিড়, অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার অভিবাসিত সিলেটিরা নাড়ির টানে স্বদেশে ফিরে এসে উন্নত শহরগুলোর সাথে নিজের শহরের তুলনা করতে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলেন । শহরকেন্দ্রে প্রবেশপথে তাঁরা শহরের কোনো ব্রান্ডিং খুঁজে পান না, যা পান তা হয়তো কোন পণ্য উৎপাদনকারীর বিজ্ঞাপন, আর কিছু না। সিলেটের বিমানবন্দর এখন আন্তর্জাতিক হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বিমান এসে সরাসরি নামে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। অথচ প্রবেশ পথের মুখে প্রথমেই তিনি স্বাদ পাবেন কোনো সেলফোন কোম্পানির বা কোনো হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিজ্ঞাপন। অথচ এই সিলেট দেশের প্রধান আধ্যাত্মিক নগরী এবং এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি বা ভূমিরূপ কিংবা অহংকার করার মতো এই অঞ্চলের মানুষের যে একটা আদি ভাষার নাগরী বর্ণমালা ছিল তার কোনো নজর চোখে পড়বে না। নানা প্রতিবাদের মুখে কিছু সেল-কোর বিজ্ঞাপনচিত্র যদিও বা সরিয়ে নিয়েছে তার জায়গায় কিছু ডিজিট্যাল প্রিন্টের বিছানাকান্দি বা টাঙ্গুয়া এসেছে-কিন্তু সিলেটেই এসে যে একজন নামলেন সে ঘ্রাণটুকু তাঁকে দেওয়া গেলো না ।

আমাদের একটা নতুন রেল স্টেশন হয়েছে, চমৎকার ডিজাইনের নতুন বাস টার্মিনাল হয়েছে। এই দুই ধরনের বাহন দিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যাত্রীর আসা যাওয়া । অথচ এখানেও কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সড়কপথে সুরমার দক্ষিণ দিক দিয়ে শহরের মূল প্রবেশ পথে যারা রাজধানী থেকে এই শহরে আসেন আসার পথে দুটো গোলচক্কর অতিক্রম করবেন। একটি আব্দুস সামাদ আজাদের নামে, ওপরটি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর নামে। কুলাউড়া বা উত্তরপূর্বাঞ্চল দিয়ে যারা শহরে ঢুকবেন তারাও পীর হবিবুর রহমানের নামে আরেকটি গোল চক্করের দেখা পাবেন। কিন্তু ঐ চক্করের গোল অবয়য় এবং সেখানে জরাজীর্ণ গুল্মরাজির আবর্জনার বাইরে আর কোনো কিছু দেখার সুযোগ পাবেন না।

এ সকল গোল চক্করের মধ্যেই নানা ভাষ্কর্যিক অবয়বে একটা শহরের ঐতিহ্য, তার স্বরপ এবং বিশেষত্বকে প্রকাশ করতে পারে। চাঁদনী ঘাটের সিড়ি, আলী আমজদের ঘড়ি বা জিতু মিয়ার বাড়ি ছাড়াও যে সিলেট আরো অনেক কিছু তার নমুনা সিলেটের প্রবেশপথেই দেখানোর সুযোগ থাকলে এটা তো কাজে লাগান উচিত।