Cinque Terre

রানা মজুমদার বাপ্পী

২৭ এপ্রিল , ২০২০


প্রাবন্ধিক


শহর আবার হাসবে

ঘরের বাজার প্রায় শেষের দিকে। বাবার বয়স হয়েছে। এদিকে তিনি ডায়াবেটিস রোগীও। তাই করোনা কালের এই দিনে আমাকেই বাজারে যেতে হলো। বাসা থেকে বের হলাম। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ। ফেসবুকে পড়েছিলাম বেশি তাপমাত্রায় নাকি করোনা ভাইরাস বাঁচে না। আবার এটাও দেখেছি যে এসব কথাবার্তা নাকি গুজব। মানুষ পারেও বটে। করোনা নিয়ে গুজব, করোনা নিয়ে ট্রল, করোনা নিয়ে ব্যবসা, করোনা নিয়ে লোটপাট, করোনা নিয়ে ন্যাড়া হওয়ার চ্যালেঞ্জ আরও কত কি!

যা-হোক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বংশ নির্বংশ করা বাদ দিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলাম। একটা রিকশা পাওয়া গেল। রিকশা চলছে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। যেন পুরো শহর দুপুরবেলার ভাতঘুমে। আমার ছোট থেকে বেড়ে উঠার আজকের এই শহরটি খুব অপরিচিত লাগছে। কে যেন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে আমার এই সুন্দর, গোছালো ছোট্ট শহরকে।

আমাদের কোর্ট আর সরকারি কলেজ খুব কাছাকাছি দূরত্বে। তাই কোর্ট সংলগ্ন এলাকাটি সবসময়ই লোকে লোকারণ্য থাকে। অথচ এখন কলেজের সামনের বইয়ের দোকানগুলোতে নেই কোন ভীড়, কোর্ট প্রাঙ্গণে উকিল-মক্কেল-দালালদের নেই কোন ব্যস্ততা। কোর্ট পেরিয়ে চলে আসলাম পৌর পার্কের সামনে। যেসকল ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত স্কুল, কলেজে যাওয়ার সময় পেতো না তারাও এই পার্কের ফুসকার দোকানগুলোর নিয়মিত কাস্টমার ছিল। আজ সেখানে নুয়ে পরা সূর্যমুখী ফুল গাছগুলো ব্যতিত আর কিছুই নেই। এই গাছ গুলোতে একটু পানি দেওয়ার মত লোকও নেই।

আরেকটু এগিয়ে দেখলাম মোড়ে কয়েকজন কর্তব্যরত পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশেই কোন একটি সংগঠন ত্রাণ দিচ্ছে। ত্রাণ নিতে আসা মানুষেরা সামাজিক দূরত্ব বজায়  না রেখে একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। অনেকের মুখে মাস্কও নেই। হয়তো তারা জানেই না কোন ঘটনাটির জন্য তাদেরকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে!

এবার রিকশা চলে এলো আমাদের জেলার শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী সরকারি স্কুলের সামনে। দুপুরবেলা স্কুলের গেইটের সামনে ছাত্রদের ভীড় থাকতো পারভেজ মামার ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য। অথচ আজ সেখানে শুধুই স্মৃতিকাতরতা। নেই পারভেজ মামা, নেই তাঁর  ভাগিনারাও!

চলে এসেছি বাজারে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে প্রথমেই সবজি বাজারে ঢুকলাম। সবজির পরে মাছ, মাছের পরে চাল সাথে আরও কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। সবকিছুর মূল্যই বেশ চড়া। আর দোকানীদের মধ্যেও কেমন জানি একটা তড়িঘড়ি ব্যাপার দেখলাম। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সবকিছু বন্ধ করে ফেলতে হবে হয়তো সেকারণেই।

এবার রিকশা খোঁজার পালা। রিকশা খুঁজে পাওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য মনে হলো। কারণ এখানে যারাই বাজার করতে এসেছেন বেশিরভাগই রিকশা রিজার্ভ করে রেখেছেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম একজন বয়স্ক রিকশাওয়ালা একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন। কিন্তু লোকটা বয়স্ক হওয়ায় কেউই ওনার কথায় সাড়া দিচ্ছিলো না। দেখে মায়া লাগলো। উনার কাছে গেলাম। কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, চাচা কই যাবেন? বললাম বড়বাড়ি, কলেজ গেইট। যাবেন? উনি রাজী হলেন আর নিয়মিত ভাড়ার চাইতে দশ টাকা বেশি চাইলেন। আমি হেসে বললাম, আচ্ছা চলুন।

রিকশা চলছে। খানিকটা পথ আসার পর দেখলাম ওনার প্যাডেল যেন আর চলছেই না। চলবেই বা কি করে। ৫০ কেজি চালের বস্তা, মাছ, সবজি তার ওপর আমার নিজেরও ওজন কমপক্ষে আরও ৫৫ কেজি হবে। বয়স্ক মানুষ এতকিছু একসঙ্গে টানতে পারে। আমি নিজেই টানতে পারতাম না! 

বাজার রেখে রিকশা থেকে আমি নেমে পড়লাম। আর উনিও প্যাডেল চাপার পরিবর্তে এবার হাত দিয়েই রিকশা টানছেন। রিকশা ভাড়া করার পরেও এভাবে অর্ধেকেরও বেশি পথ আমাকে হাঁটতে হলো। খুব বেশি খারাপ লাগলো না। উনার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা বিভিন্ন জায়গায় তো চাল ডাল দিচ্ছে। এসব নিলেই তো পারেন। তাহলে আর বের হওয়া লাগেনা।’ উনি বললেন, বাজান রে ওইগুলা যদি নিতাম ই তাইলে তো আর এই রইদের মধ্যে কষ্ট কইরা রিকশা নিয়ে বাইর হইতাম না।

বললাম, হুম বুঝেছি। 

তিনি বললেন, দোয়া কইরেন বাজান আল্লায় যেন রোগটা তাড়াতাড়ি সরাইয়া নেয়। আসলেই খুব কষ্টে আছি রে বাজান।

উনার কথা শুনে খুব ইচ্ছে হলো নিজের করা বাজার থেকে উনাকেও কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু উনি তো এভাবে নেওয়ার লোক না।

রিকশা এসে থামলো বাসার সামনে। উনাকে বললাম, চাচা একটু চালের বস্তাটা ধরুন। দুজন মিলে ধরাধরি করে বাজারগুলো বাসায় ঢুকালাম। 

এরপর দ্রুত উনার ভাড়া মিটিয়ে গেইট বন্ধ করে দিলাম। ঘরে ঢুকতেই রিকশাওয়ালা চাচার ডাক। দৌঁড়ে গেলাম। গেইট খুলতেই উনি বললেন, বাজান ভুল কইরা মনে হয় পঞ্চাশ টেকা বেশি দিয়া দিছেন! আমি খুব আশ্চর্য হলাম। অন্য কেউ হলে নিশ্চিত না বলেই নিয়ে যেতো। এত দারিদ্রতা, এত কষ্ট আর অসহায়ত্বের মধ্যেও লোকটার সততা দেখে অভিভূত হলাম। আজকের এই ঘুমিয়ে পড়া পৃথিবীতে করোনা আমাদের অনেক কিছুই কেড়ে নিচ্ছে। তারপরও কিছু কিছু মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেনি অমূল্য সম্পদ সততা।

আমি রিকশাচালক চাচাকে বললাম, টাকাটা আপনি রেখে দিন। এমনি এমনি দেই নি। ওই যে তখন আমার বাজারগুলো বাসায় ঢুকিয়ে দিলেন সেই পরিশ্রমের মূল্য হিসেবেই দিয়েছি। 

রিকশাওয়ালা চাচা মুচকি হেসে চলে গেলেন। উনার হাসিতে আমাদের ঘুমন্ত শহরের হেসে উঠার চেষ্টাই যেন প্রতিফলিত হলো।