Cinque Terre

শাকুর মজিদ

০৪ নভেম্বর , ২০২৩


স্থপতি, লেখক, তথ্যচিত্র নির্মাতা
নগর ভাবনা-২: নিজের পরিসর নিজেকেই সাজাতে হয়




আমাদের গাও গেরামে নতুন সম্পর্ক করতে যাওয়া বর পক্ষের লোকেরা কনে পক্ষের ঘর-বাড়ি দেখতে যেতো। একবার আমি আমার এক নানার সঙ্গে গেলাম এক কনের বাড়িতে। অচেনা গ্রাম, অচেনা বাড়ি। আমি মুরুব্বিদের সঙ্গে আছি। আমাকে ইচ্ছা করে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। আমি ছোট। ৮-৯ বছর বয়স। আমার কাজ ছিল স্পাইগিরি করা। 

আমার উপর একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। রান্না ঘরে ঢুকে গিয়ে কলসী থেকে পানি নিয়ে আসা। উন্দালে ঢুকে দেখতে হবে কলসীর আশে পাশে কী পরিমাণ ময়লা জমে আছে, চুলার পাশে কী পরিমাণ ময়লা জমা—এসব। 

এটা শেষ করে রিপোর্ট জমা দিলাম। খানিক পরে, দেখি সেই নানা এক উসিলা করে টাট্টিঘরে গেলেন। 

খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা যখন হেঁটে হেঁটে আবার আমাদের গ্রামে ফিরছি, নানা আমাকে বলেন—নাতি, কুটুমিতা করার আগে দেখি লাইবায় তান উন্দাল আর টাট্টিখানা কিলান আছে। যার উন্দাল আর টাট্টিখানা পয়-পরিস্কার থাকে বুঝিলাইবায়, এরা মানুষ ভালা, এরা জানে কিলা পয়-পরিস্কার থাকা লাগে। 


নানার সঙ্গের সেই গল্পটা আমার আরেকবার মনে পড়লো, ২০১৮ সালে যখন জাপান গেলাম। জাপান গিয়ে তাঁদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বড় হবার গল্প শুনেছিলাম। বাচ্চাদের নার্সারির স্কুলে কোনো ক্লিনারের পদ নেই। বাচ্চাদেরকে প্রথমেই শেখানো হয় নিজের পরিসরকে কিভাবে পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হয়। এটা তাঁদের প্রথম কাজ। 

নিজের চোখে দেখি এক অশীতিপর বৃদ্ধ তাঁর বাড়ির সামনের সড়কের জমে থাকে সামান্য ধূলা-বালি নিজেই একটা ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করছেন। প্রথমে আমার ধারণা হয়েছিল, তিনি মিউনিসিপ্যালিটির কেউ হবেন। কাছে গিয়ে আলাপ পরিচয়ে জানি তিনি একজন রিটায়ার্ড ইঞ্জিনিয়ার। 

জিজ্ঞেস করি, আপনি কি এই পরিস্কার করার মালিগিরির কাজ এখন নিয়েছেন?

তিনি হাসেন। বলেন—আমার বাড়ির সামনের জায়গাটা আমারই পরিস্কার করা উচিত। আমি কেন এই কাজের জন্য সরকারের কাছ থেকে টাকা নেব?

জাপানের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দেশ তো আর জাপান না। কিন্তু জাপানের মতো এই অভ্যাস আমাদের অর্জন করার জন্য তো জাপানী হওয়ার দরকার পড়ে না।আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিচ্ছন্ন হতে শিখিনি বলেই আমরা আমাদের শিশুদের ছোটবেলা থেকে পরিচ্ছন্ন হতে শিখাইনি। তাই বড় হয়ে সে তাঁর অপরিচ্ছন্ন পরিসরকেই স্বাভাবিক মনে করে। 

আসলে এতো কথা আমি বলছি, মূলত একটা নগরের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে। 

উন্দালে ময়লা জমে থাকে যে বাড়ির রান্নাঘরে, এই বাড়ির বাসিন্দা পরিচ্ছন্নতা জানেন না, এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য হচ্ছে, যে শহরের মানুষ তাঁর নিজের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন না তাঁর কাছে শহরের ময়লা আবর্জনা তেমন কোনো বিষয় না। কিন্তু আসলেই একটা শহরের বাসিন্দাদের সামগ্রিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটে তাঁর ব্যবহৃত পরিসরকে সে নিজে কিভাবে রেখেছে তার ওপর। 

আমরা বলতেই পারি যে, আমরা মিউনিসিপ্যালিটিকে ট্যাক্স দেই, সুতরাং আমাদের বাড়ির সামনা আমরা আবর্জনার স্তূপ বানিয়ে রাখব, করপোরেশনের লোক এসে পরিস্কার করে দিক। কিন্তু এটা ভাবি না যে এতো লাখ লোকের আবর্জনা গুটিকয় লোক কী করে সারাতে পারে। 

নাগরিক পরিচ্ছন্নতার জন্য একবার ঢাকার এক সিটি মেয়র কয়েকজন সুন্দরী নায়িকাকে হাতে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে ফটোশুট করিয়েছিলেন। পত্রিকায় যে ছবি ছাপা হয়েছিল, তা ছিল এমন যে, রাস্থা পরিস্কার করছেন অমুক অমুক নায়িকারা। মেয়র মহোদয় হয়তো ভেবেছিলেন যে, নাগরিকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তিনি এমনটা দেখাবেন যে, নিজের বাড়ির সামনের রাস্তা নায়িকারা যদি সাফ করে রাখতে পারেন, সাধারণের তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এমনটি কিন্তু কাজ আসেনি। কোনো লাভ হয়নি এই প্রচারণায়। 

বরং নাগরিক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার শিক্ষাটা যদি শিশু বয়সে কোমলমতিরা নিজের ভেতর আত্মস্থ করে ফেলতে পারতো, বড় হয়ে সে কখনোই তার বাড়ির সামনের ড্রেনে চিপসের প্যাকেট ফেলতো না। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চানাচুর আর বাদাম ভাজা খেয়ে, তার খোসা বা কাগজের প্লেটটা সে কখনোই ময়লা ফেলার ঝুড়ি ছাড়া আর কোথাও ফেলবে না। 

এখন আপনি বলতেই পারেন, আমাদের ফুটপাতে সেরকম ঝুড়ি কোথায় আছে?

আমি এটাও দেখেছি, চীনের অতি মফস্বল শহরেও রাস্থায় মোড়ে মোড়ে, পার্কে, ফুটপাতে কিছুদূর পরপরই ময়লা ফেলার ঝুড়ি আছে। এই ঝুড়ি ছাড়া কেউ ময়লা অন্য কোথাও ফেলবে এমন চিন্তা করা যায় না। অনেক উন্নত দেশ আছে যেখানে এইসব ঝুড়ি ছাড়া অন্য কোথাও কেউ সামান্য ময়লা ফেললে তাকে জরিমানা দিতে হয়। 

ঢাকার আরেক মেয়র কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে কতগুলো দৃষ্টিনন্দন ডাস্ট-বিন শহরের নানা ফুটপাতে বসিয়েছিলেন। এইসব ঝুড়ির গায়ে তাঁর নিজের নামও লেখা ছিল, যে এটা তাঁর উপহার। কয়েক মাস পরে এই ঝুড়িগুলোর নানা অংশ নানা জায়গায় চলে যায় নানা মানুষের কাছে। শুধু ছাচটা রয়ে যায়, এখানেও কেউ ময়লা ফেলে না। কারণ ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে এই অভ্যাস করানো হয়নি যে ময়লার জায়গায় ময়লা ফেলতে হবে অন্য কোথাও না। এটা আমরা বিদেশ গেলে দেখি, নিজের দেশে, নিজের শহরে দেখি না। 

আমরা সবাই না জানলেও এটা সত্য যে, প্রতিটি শহরের জন্য একটা জল ও পয়নিষ্কাশনের বন্দোবস্ত থাকে। আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির ভেতর থেকে যে তরল পদার্থ বেরিয়ে যায় তা নানা রকমের নল ও নালার ভেতর দিয়ে একটা বড় জায়গায় গিয়ে জমা হয়। আবার বাড়ির বাইরের বৃষ্টির পানিও নালা-নর্দমা-ছড়ার মাধ্যমে গিয়ে নদীতে মিশে যায়। কিন্তু এই আবর্জনার পথ নিজেরা বন্ধ করে রাখলে সিটি করপোরেশনকে গালাগালি করা ছাড়া আর কিছু না করেই দুর্ভোগটা নিজেদেরই পোহাতে হয়। 

আমাদের যেহেতু সেরকম কোন ভিত গড়ে উঠে নাই তাই আমাদের প্রয়োজন প্রথমে স্কুলের শিক্ষক মহলকে বিষয়টি ভালোভাবে শেখানো যাতে তাঁরা প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিশুদেরকে এমনভাবে দীক্ষিত করতে পারেন যে, এরা বড় হয়ে নিজেরাই নিজেদের আঙিনাকে এবং তাঁর চলাচলের পথকে সুন্দর করে তুলতে পারে। কেননা নিজের পরিসরকে নিজে পরিশুদ্ধ করতে পারলেই শুধু একটা নাগরিক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।