আহমেদ নূর
১২ অগাস্ট , ২০২৪
সম্পাদক
সিলেট মিরর
গত প্রায় এক মাস ধরে পুলিশের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড ক্ষোভ। জনরোষের কবলে পড়ে পুলিশ মাঠ ছাড়া। পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য এবং থানাগুলো হামলার শিকার হয়েছে। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ নেই। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। পুলিশের প্রতি এই ক্ষোভের যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কিন্তু কেন এমনটি ঘটল? এটি একটি বড় প্রশ্ন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ ছিল। আমরা এমনও দেখেছি পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে গিয়ে শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো সহিংসতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন হিংস্র হয়ে উঠল পুলিশ? পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হলো শিক্ষার্থীদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে। অস্ত্রের মুখে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কারা করলো এটা, কার নির্দেশে করলÑএসব ভেবে দেখতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে, উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অধস্তন পুলিশ সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ না পেলে কোনোভাবেই এমনটি করতে পারত না। নিজেদের দলীয় স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে চিহ্নিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করেছেন। এখন তারা পলাতক। তাই এর জন্য সব পুলিশ দায়ী এটা বলা ঠিক হবে না।
পুলিশের নতুন আইজি দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছেন, ‘কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।’ তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি মেনে নেওয়া কষ্টকর। কারণ ‘অপেশাদার কর্মকর্তা’ কীভাবে বাহিনীতে থাকতে পারে? এই কর্মকর্তারা যা করেছেন তা ‘রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও গুণ্ডামি’ ছাড়া কিছুই নয়। তাদের এই পৈশাচিক আচরণ পুরো পুলিশ বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সিলেটের ঘটনাগুলো তো আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। ছাত্র-সাংবাদিক মারা গেছেন। সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আবাসিক এলাকায়ও ত্রাসের সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ যখনই সরকারি দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাস্তায় নেমেছে তখন তাদেরকে শেল্টার দিয়েছে পুলিশ। সরকার পতনের এক দিন আগে ৪ আগস্ট পুরো নগর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দখলে ছিল। ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখেছে। এমনকি ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুঘণ্টা আগেও নগরের জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা ও দরগা এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়েছে পুলিশ। যে সময় রাজধানীতে ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন-বুক মেলাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময় যখন দমন-পীড়ন শুরু করে পুলিশ তখন সুযোগ নেয় অন্য একটি পক্ষ। শুরু সহিংসতা। হামলা হতে থাকে একের পর এক রাষ্ট্রীয় স্থাপনায়। এ সবকিছুর দায় কার? এর একটি সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম আক্রমণের শিকার হয় রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক। প্রথম প্রতিরোধও গড়ে তুলে পুলিশ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারপরও পুলিশের প্রতি মানুষের অভিযোগ-অনুযোগের শেষ নেই। কিন্তু পুলিশবিহীন একটি সমাজ কি আমরা কল্পনা করতে পারি? পারি না। আর পারি না বলেই পুলিশের বিরুদ্ধে যে যতই বলুক তারপরও বিপদের সময় মানুষ পুলিশের কাছেই ছুটে যায়। কিন্তু এবার পুলিশ যা ঘটাল তা অতীতে ঘটেনি। ছাত্র-জনতার মন থেকে এই ক্ষত কতদিন সারবে সেটা বড় প্রশ্ন। তবে দ্রুতই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
বিভিন্ন সময়ে সিলেট মহানগর পুলিশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংকলনে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম। এছাড়া নবীন পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও হয়েছিল। এসব লেখা বা বক্তৃতায় যা বলেছিলাম তার কোনোটাই বাস্তবে দেখতে পাইনি। এর জন্য দায়ী সিস্টেম এবং দলীয়করণ। যার জন্য একটি জনবান্ধব মানবিক পুলিশ বাহিনী আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
গোড়াতেই গলদ : সিপাহী বিপ্লবের পর ১৮৬১ সালে পুলিশ অ্যাক্টের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর জন্ম হয় অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে। এরপর ভারত ও অবিভক্ত পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও সেই ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক আইন দিয়েই চলছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। সত্যিকার অর্থে একটি আধুনিক, পেশাদার ও ‘জনবান্ধব’ পুলিশবাহিনী গড়ে তুলতে পরিকল্পিত উদ্যোগ আজ পর্যন্ত আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। পুলিশ প্রশাসনে সংস্কারের একটি উদ্যোগ ২০০৭ সালে নেওয়া হয়েছিল। পুলিশের তৎকালীন আইজি বলেছিলেন পুলিশ কমিশন, পুলিশ কমপ্লে¬ইন কমিশন এবং সশস্ত্রবাহিনীর আদলে পুলিশ ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হবে। তিনি এও বলেছিলেন এগুলো গঠিত হলে ক্ষমতাসীন সরকার ইচ্ছা করলে পুলিশকে দলীয় কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত সেই সংস্কার প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এটি করতে পারলে আমরা একটি নাগরিকবান্ধব সেবামুখী পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা যেত। সুতরাং পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা দূর না করে পাশ কাটিয়ে সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কেমন পুলিশ চাই : পুলিশ বিভাগেরই একটি জরিপের উদাহরণ দিই। এক যুগ আগে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে নরসিংদী জেলা পুলিশ আয়োজিত এক কর্মশালায় তাৎক্ষণিক জনমত জরিপ করা হয়েছিল। বিষয় ছিলÑ‘কেমন পুলিশ চাই’। জরিপে নরসিংদী জেলার ৪০টি কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। সবার মতামত হিসেবে ১২টি সুপারিশ ওঠে আসে। এগুলো ছিলÑ১. সঠিক ও সৎভাবে সেবাদানকারী পুলিশ চাই। ২. জনসাধারণের সঙ্গে ভাল ব্যবহারকারী পুলিশ চাই। ৩. পুলিশ এমনভাবে কাজ করবে যাতে জনগণ তাদের বন্ধু ভাবতে পারে। ৪. নিরীহ, নিরপরাধ ও অসহায় মানুষকে হয়রানী করবে না এমন পুলিশ চাই। ৫. অভিভাবকরূপী পুলিশ চাই। ৬. সৎ, দক্ষ ও মেধাবী পুলিশ চাই। ৭. প্রভাবশালীদের প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাই। ৮. নিরপেক্ষ পুলিশ চাই। ৯. কাজের মাধ্যমে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবে এমন পুলিশ চাই। ১০. গরীবদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবাদানকারী পুলিশ চাই। ১১. গ্রামের মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে পারে, এমন পুলিশ চাই। ১২. সঠিক তদন্ত করতে পারে এমন পুলিশ চাই।
আমার বিশ্বাস ১২ বছর আগের করা এই জরিপ এবং প্রত্যাশা এখনও প্রাসঙ্গিক। এটি শুধু একটি জেলার মানুষের নয় বরং পুরো দেশের মানুষের মনের কথা। তখনও প্রশ্ন জেগেছিল মানুষ এটা প্রত্যাশা করছিল কেন? তবে কি সাধারণ মানুষ পুলিশের এই ভূমিকা দেখতে পাচ্ছে না? আজ ১২ বছর পর যা প্রত্যক্ষ করলাম তাতে তো আর বলার কিছু থাকে না। ভাবমূর্তির এই সংকট কাটিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন এবং মানুষের ক্ষোভ প্রশমন এখন জরুরি।
রক্তাক্ত জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ এবং পট-পরিবর্তনের পর পুলিশ প্রশাসনে রদবদল করা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হচ্ছে। সিলেটেও করা হয়েছে। কিন্তু বদলি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নয়। যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং সঠিক তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণে এ সব সংস্কারে হাত দিতে হবে। সময় লাগবেÑকিন্তু জঞ্জাল মুক্ত করতে হবে। ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’Ñএমন একটা প্রবাদ আছে। তাই দুষ্টদের বাদ দিতে হবে। এখন আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেক মেধাবী, অনেক দূরদর্শী। অযোগ্যদের বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে পুলিশ বাহিনীতে যুক্ত করা যেতে পারে।
পুলিশ বাহিনীতে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক ক্ষোভ আছে। অনেক বঞ্চনা আছে। আজকে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ‘ডিআইজির বাসায় মুরগি পাহার দিতে হতো তিন পুলিশকে’ (সিলেট মিরর ১১ আগস্ট, ২০২৪)। এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। তাদের অনেকগুলো যৌক্তিক দাবি আছে। এগুলো চট করে সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দরকার।
আশার কথা, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল (১১ আগস্ট) রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পুলিশ চলবে পুলিশ কমিশনের অধীনে। এই পুলিশ জনগণের পুলিশ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পুলিশ বাহিনীকে লাঠিয়াল বাহিনীর মতো এভাবে ব্যবহার করা যাবে না।’
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর পেলাম, পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। হুকুমদাতাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছেন। এটা আশাব্যঞ্জক। আশা করছি পুলিশও সত্যিকার জনবান্ধব পুলিশ হয়ে উঠবে। এখন প্রয়োজন পুলিশের মনে যে ভয় রয়েছে সেটা দূর করা। পাশাপাশি জনমনে গত কয়েকদিন পুলিশের প্রতি যে ক্ষোভ ছিল সরকারের উদ্যোগের ফলে সেটাও প্রশমিত হবে বলে মনে করছি।