Cinque Terre

রাহাত শামস

১৭ এপ্রিল , ২০২৫


সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা
অপরাধীদের রাজনৈতিক ছাতা


সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাটের ঘটনাগুলো আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে এসব ঘটনায় অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে, আর নিরীহ অনেকেই পড়তে পারে পুলিশের তদন্ত বা অভিযানের ফাঁদে। এতে করে শুধু সাধারণ মানুষের আস্থা কমবে না, বরং অপরাধীরা আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠবে যা একটি সমাজের জন্য অশনি সংকেত।

আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। অন্যথায় এদের অপরাধ প্রবণতা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু তা-ই নয়, তদন্তের মাধ্যমে বের করে আনতে হবে এসব ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত কি না এবং কারা এদেরকে মদদ দিচ্ছে বা দিয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক শক্তি এদের পেছনে থেকে থাকে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। অপরাধীদের পেছনের ‘লুটতরাজের বস’ বা ‘সুযোগসন্ধানী গডফাদারদের’ বিচারের আওতায় আনা ছাড়া প্রকৃত বিচার অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

অপরদিকে, পুর্বের মতো পুলিশের কিছু ‘সংখ্যা দেখানোর’ প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো অপরাধ ঘটার পরপরই কিছু সন্দেহভাজনকে আটক করে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি ‘মিটমাট’ দেখানোর চেষ্টা চলে যা তদন্তের মান ও প্রকৃত বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অপরাধীদের ধরা যেমন জরুরি, তেমনি নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রাজনীতির ছায়ায় অপরাধীদের বেড়ে ওঠা। দীর্ঘদিন ধরে এদেশে রাজনীতির ছত্রছায়ায় অনেক অপরাধী গড়ে উঠেছে, যারা আইনের ফাঁকফোকর, ক্ষমতাধরদের আশীর্বাদ কিংবা দলের তৎপরতার কারণে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এতে একদিকে যেমন ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়েছে, অন্যদিকে সমাজে অপরাধ একটি স্বাভাবিক বা ‘লাইসেন্সধারী’ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে শুরু করেছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। রাজনীতিকে অপরাধমুক্ত করতে হলে, সৎ, যোগ্য, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন এবং দেশ-সমাজ নিয়ে ভাবতে পারা নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। রাজনীতিতে শুধু ক্ষমতার খেলা না করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং অপরাধ দমনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে যদি দেশপ্রেমিক, সচেতন এবং নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন কর্মী ও নেতৃত্ব উঠে আসে, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোও হবে কার্যকর, জনগণের ভরসার স্থল এবং অপরাধীদের আখড়া না হয়ে বরং হবে প্রতিরোধের ঘাঁটি।

পুলিশ প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা যেখানে অনস্বীকার্য, সেখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামো পারে এই অপরাধচক্র ভাঙতে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থেকে অপরাধীদের পক্ষে সাফাই দেওয়ার সংস্কৃতিও দূর করতে হবে।

অপরাধীরা যেন আর কোনো রাজনৈতিক ছাতা না পায়, সেই নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা আজ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।