Cinque Terre

মোহাম্মদ আলী

০৬ মে , ২০২০


প্রাবন্ধিক


তদন্তে চীনের আপত্তি কেন?

করোনাভাইরাস প্রথম ছড়ায় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে। প্রথম দিকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে, দেশে দেশে এই বিষয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তবে ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকার কারণে বিশ্বের অনেক দেশই চুপ করে আছে। এমন মন্তব্য করেছেন রাজনীতিবিদসহ বিশ্লেষকদের অনেকে। 

করোনায় মহামারী রূপে বিশেষ করে আমেরিকার বর্তমান করুণ অবস্থায় অনেক ভাবনার জন্ম দেয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন অনেক আগেই। কিন্তু তাঁকে সমর্থন দেওয়ার মতো শক্ত অবস্থান আর কোনো দেশ থেকে এখনো সেভাবে আসেনি। তবে এক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান অনেকটা স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে।

এই ভাইরাসের উৎস নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যে চীনের বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিলেও আমেরিকার পর অস্ট্রেলিয়ার গলা শোনা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায়ও চীনকে সন্দেহ করছে।

চীনের বক্তব্য হলো, বন্য প্রাণীর বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্বের একটি বড় অংশের ধারণা এই ভাইরাস ছড়িয়েছে চীনের গবেষণাগার থেকে। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন এ ব্যাপারে চীনের পরিস্কার উত্তর দাবি করেছেন। এতে চীন ভীষণ ক্ষেপেছে। এমনকি এ কারণে তারা অষ্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছে। অষ্ট্রেলিয়ার এই আচরণে চীন যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটিও চীনের উদ্যত মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। 

পিটার ডাটন কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ।  ২০০১ সাল থেকে কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের ডিক্সন থেকে নিয়মিত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সেই পিটার ডাটন আবার আলোচিত হয়ে ওঠেন এই করোনাভাইরাসের সময়ে। অস্ট্রেলিয়ার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হোন। 

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন করোনা ভাইরাসে।  সাড়ে ১১ লাখ মানুষ আক্রান্ত। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে দেশটিতে। যেন মনে মনে হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার জন্যই  এই মহামারী এসেছে। তবে এখন এটা বলার কোনো কারণ নেই। কারণ বিশ্বের ২১০টি দেশ-অঞ্চল এখন আক্রান্ত। এটি অস্বীকার উপায় নেই যে, অস্ট্রেলিয়া সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট একটি দেশ। স্বভাবতই করোনাভাইরাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যের সঙ্গেও তাদের সমর্থন থাকবে, এমনটি অনেকের ধারণা। কিন্তু এটি ঠিক, চীনের বিষয়ে করোনা নিয়ে অঙ্গলি উত্তোলন অমূলক কিছু যে নয় তা বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রও স্বীকার করছেন। বিবিসির সংবাদ বিশ্লেষণে গত শুক্রবার উঠে এসেছে, নানা হিসেব-নিকেশের কারণে চীনের বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছে অনেক রাষ্ট্রকে। এ থেকে একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট যে, চীন গোটা বিশ্বে একটি একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে অথবা করে ফেলেছে। হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই তা দিবালোকের মতো প্রকট হয়ে উঠবে।

অবশ্য নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি-ধমকি অব্যাহত রেখেছেন। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায়ও নিয়মিত চীনকে অভিযুক্ত করে আসছেন। যদিও তিনি করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করতে নিজের দেশে ব্যর্থ হয়েছেন। ট্রাম্প চীনকে সন্দেহ করে গত সপ্তাহে বলেন, ‘এ ভাইরাস কোথা থেকে এসেছে তা আমরা নির্ণয় করতে চাই।’

অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটনও বলেন, ভাইরাসের উৎস জানার জন্য নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত হতে হবে।

এদিকে একজন চীনা মুখপাত্র বলেছেন, ‘কিছু অস্ট্রেলীয় রাজনীতিবিদ আছেন, তাঁরা আমেরিকার তোতা পাখি।’ এটি স্পষ্ট যে, ডাটনকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাউথপিস’ বলেই আখ্যা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, আরও এক ধাপ এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয় চীন। অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদ‚ত চেং জিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তদন্তের কথা বেশি বললে বিশ্ববিদ্যালয়, পর্যটন, কৃষিক্ষেত্রে লেনদেন চীন বর্জন শুরু করবে। গরুর মাংস আমদানি বন্ধ করে দেবে।

অস্ট্রেলিয়ার এক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বেইজিং-ওয়াশিংটন একে অপরকে প্রায়ই দোষারোপ করে। তবে এ জন্য চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোও অস্ট্রেলিয়াকে এক হাত নিচ্ছে। কোনো কোনো চীনা সংবাদমাধ্যম অস্ট্রেলিয়ার প্রতি চ‚ড়ান্ত আক্রমণাত্মক বক্তব্যও প্রকাশ করছে।

অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুমাত্রিক। চীন অস্ট্রেলিয়ার এক নম্বর রপ্তানি বাজার। ৯০ শতাংশ পণ্যদ্রব্য আসে চীন থেকে। ২০১৮ সালে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ২১৫ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৮-১৯ সালে ১৪ লাখ চীনা পর্যটক অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে আসে।

তবে আমেরিকা কিংবা অষ্ট্রেলিয়ার এই অভিযোগ নেহাত ফেলে দেওয়ার বিষয় নয় বলে অনেক ক‚টনৈতিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। অনেকে বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে বলেছেন, এ বিষয়টির তদন্ত হোক। অনেকের কথা হচ্ছেÑঅভিযোগ যখন উঠেছে, তখন চীনের উচিত তদন্তে সহযোগিতা করা। তাদের কথা হলোÑচীন এই বিশ্ব মহামারী নিয়ে যেখানে সমাধানের পথ দেখানোর কথা ছিল, সেখানে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অধিক ব্যস্ত। তাছাড়া একটি বিষয় কারো চোখ এড়ায়নি। সেটি হলোÑযে চীনে মহামারী শুরু সেই চীন এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। এদিকে চীনে করোনায় প্রায় ৪ হাজার মানুষের প্রাণ গেলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিযোগ, এ হিসেব সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রেও চীন তথ্য গোপন করেছে।   

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এরপর এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। চীনের একটি পশুর বাজারে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। আজ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৪ লাখের বেশি মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন এবং এরই মধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছেন। মানুষের মৃত্যুও মিছিল চলছেই।

এখন কথা হলো, করোনা ভাইরাসের সৃষ্টি নিয়ে তদন্তে চীনের আপত্তি কেন? এটি তো সত্য, চীনে এই ভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকেই এর উৎপত্তি ও বিস্তার। সুতরাং এ নিয়ে তদন্তের দাবি ওঠা স্বাভাবিক। অনেকের যুক্তি, এ সংক্রান্ত তথ্য বিভিন্ন দেশকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা করবে।