Cinque Terre

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

১২ মে , ২০২০


সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী

[email protected]
ইফতেখার হোসেন শামীম : সিলেটের সমকালীন রাজনীতির এক ট্র্যাজিক হিরো

ইফতেখার হোসেন শামীম। সিলেটের গণমানুষের কাছে একটি সংগ্রামী নাম। দীর্ঘদিন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযুদ্ধা ইফতেখার হোসেন শামীম। পদ পদবী অনেকেরই ভাগ্যে জোটে। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য সকলের হয় না। ইফতেখার হোসেন শামীম শুধু আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সিলেট শহরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ব্যাবসা, ক্রীড়া প্রায় প্রতিটি অঙ্গনেরই একজন পৃষ্ঠপোষক, যোগ্য নেতৃত্ব। ইফতেখার হোসেন শামীমের পৈতৃক বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দেওকলস ইউনিয়নের উলুপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা এডভোকেট ইরশাদ হোসেন ছিলেন সিলেট শহরের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। তিনি ব্রিটিশ আমলেই সিলেট শহরে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইফতেখার হোসেন শামীম সিলেট শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম শরিফা খাতুন। তিনি ছিলেন সিলেট অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। ইফতেখার হোসেন শামীম সিলেট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে এমসি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ইফতেখার হোসেন শামীম মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।ইফতেখার হোসেন শামীম মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সম্মুখ সমরের যোদ্ধা। তিনি ৪নং সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ী এ বীর জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সিলেটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র জীবনে রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না থাকলেও সিলেটে পচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুবলীগকে সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার পরই মূলত তাঁর সরব রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু। আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে বাকশাল গঠনের পর সিলেটের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য আওয়ামী লীগ নেতারা বাকশালে যোগ দেন। এই কঠিন সময়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের তরুণ নেতৃত্বকে সংগঠিত করতে ব্যাপক অবদান রাখেন। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে অনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার পর প্রথমে তিনি সিলেট জেলা যুবলীগের সভাপতি,পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের যুব বিষয়ক সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সর্বশেষ সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।সিলেটের সমকালীন আওয়ামী রাজনীতির এক ট্রাজিক হিরো ইফতেখার হোসেন শামীম। বিভিন্ন নির্বাচনে বার বার তিনি অংশ নিয়েছেন কিন্তু কখনও সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। তিনি ১৯৮৩ সালে সিলেট পৌরসভার নির্বাচনে সিলেট ইয়ুথ ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে অংশগ্রহণ করেন। তখনকার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ প্রথমে তাঁকে নির্বাচনে উৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে অনেকেই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে সিলেট পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেও পরাজয় বরণ করতে হয়। ১৯৯০ সালে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে অবতীর্ণ হলেও দলীয় কোন্দল ও সিলেট শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে পরাজয় বরণ করতে হয়।১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও তিনি ব্যাপক আলোচনায় থাকা সত্বেও জয়ের মুখ দেখতে পারেননি। ইফতেখার হোসেন শামীমের ব্যক্তি জীবনও নাটকীয়তা পূর্ণ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা ও বন্ধু বান্ধবদের প্রভাব তাঁর ব্যক্তি মানসকেও বিভিন্ন সময় প্রভাবান্বিত করেছে।সাহসী,দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী এই মানুষটি আপোষকামীতা জানতেন না বলে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একসময় তিনি জার্মানী চলে গিয়েছিলেন। পরে ঢাকায় রেষ্টুরেন্ট ব্যবসাও করেছেন কিছু দিন। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ১৯৮২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নাজনীন হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বশুর মকসুদ আহমদ চৌধুরী ছিলেন গণপরিষদ সদস্য। স্ত্রী নাজনীন হোসেনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের দূর্দিনে সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের তাঁর বাসাটি ছিল দলীয় নেতাকর্মীদের অলিখিত ঠিকানা। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছুটে যাওয়া নেতাদের মধ্যে ইফতেখার হোসেন শামীম ছিলেন সর্বাগ্রে। সংকটে,সমস্যায় তিনি ছিলেন কর্মীদের আশ্রয়স্থল। দেশ ও জাতির এই সংকটময় মুহুর্তে ইফতেখার হোসেন শামীমের প্রাসঙ্গিকতা যেন আরো বাড়ছে। কর্মীদের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছিল তাঁর বড় গুণ। নিজ দলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজেও ছিল তাঁর ব্যাপক প্রভাব। সিলেটের বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলনে তিনি থাকতেন নেতৃত্বের ভূমিকায়।সিলেটের রাজনৈতিক সহনশীলতা রক্ষার্থে তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। শুধু দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের সমস্যা সমাধানেও তিনি রাখতেন অগ্রণী ভূমিকা।দলের দু:সময়ে সঠিক অবস্থান ও সিদ্ধান্ত নিতে তিনি পালন করতেন মূখ্য ভূমিকা। গ্রুপিং রাজনীতির কারণে তিনি অনেক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।অন্যভাবে বললে তাঁর মতো বিচক্ষণ, ব্যক্তিত্ববান মানুষের যতটুকু পাওয়ার কথা ততটুকু তিনি পাননি। দলের স্বার্থে তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। আন্দোলন, সংগ্রামে ইফতেখার হোসেন শামীমের উপস্থিতি কর্মীদের উজ্জীবিত করতো। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন একজন কর্মীবান্ধব নেতা। আজ ১১ মে। সিলেটের এই নন্দিত নেতার ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের ১১ মে ঢাকা থেকে সিলেট ফেরার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান।প্রয়াত এই নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।