Cinque Terre

মোহাম্মদ মনির উদ্দিন

১৫ মে , ২০২০


আইনজীবী


ই-জুডিশিয়ারি-ভার্চুয়াল আদালত : সুবিধা-অসুবিধা

বাংলদেশে ই-জুডিশিয়ারি চালু করার জন্যে ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই আলোকে ওই সালেই প্রধানমন্ত্রী ই-জুডিশিয়ারি এর অংশ হিসেবে ভার্চুয়াল কোর্ট স্থাপনের নির্দেশনা দেন। ফলে ই-জুডিশিয়ারি স্থাপনের একটি প্রকল্প হিসেবে ১০টি জেলায় পাইলট প্রকল্প বাছাই করা হয়। অর্থাৎ যে সকল জেলার মন্ত্রীগণ কার্যত শক্তিশালী, সে সব জেলার নাম ওই পাইলট প্রকল্পের তালিকায় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই তালিকা গেলে, তিনি প্রেরিত তালিকা বাতিল করেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেন আটটি বিভাগীয় শহরে প্রথমে প্রকল্প হিসেবে চালু হবে। পরে ধাপে ধাপে সারাদেশে কার্যকর হবে। 

ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের আওতায় সিলেটে ২০১৬ সালের ০২ মার্চ তৎকালিন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এর দায়িত্ব থাকাকালে ডিজিটাল প্রযুক্তির উদ্বোধন করা হয়। সিলেটের জেলা ও দায়রাজজ, মহানগর দায়রাজজ,অতিরিক্ত ও যুগ্ম দায়রাজজ, বিশেষ জজ, ট্রাইব্যুনাল, মুখ্য বিচারিক হাকিমসহ অন্তত ২০টি আদালতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্য হিসেবে জবানবন্দি-জেরা গ্রহণ রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হয়। ডিজিটাল এই বিচার কার্যক্রমে পাঁচটি মনিটর রয়েছে। বিচারক, সাক্ষী, প্রসিকিউটর ও আইনজীবী, আসামি, কম্পিউটার কম্পোজ সহকারিসহ মোট এই ০৫ টি মনিটর। এভাবেই শুরু হয়েছিল ডিজিটাল পন্থার বিচারিক কার্যক্রম। এই ফেলে আসা চার বছরে আর কোনো অগ্রগতি তো হয়ইনি, বরং কিছুটা অবনতি হয়েছে বলা যায়। নতুন কোনো কিছুই যুক্ত হয়নি। ২০১৬ সালে যে সেট-আপ দিয়ে শুরু করা হয়েছিল,তা এখন পুরাতন হয়েছে। কথা বলার মাইক একেবারেই কাজ করছে না। কিছু মনিটর অকেজো হয়ে পড়েছে। বর্তমানে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলমান রয়েছে নামকাওয়াস্তের ডিজিটাল বিচারব্যবস্থা।

চলমান ই-জুডিশিয়ারি মূল্যায়ন সভা ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর এবং ৯ ডিসেম্বর জারি করা হয় কার্যবিবরণী। এই সুপারিশসহ পাঠানো হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। প্রকল্পটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রাক্কলন করা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ০২ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এই ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প কার্যকর হলে বিচারপ্রার্থী ঘরে থেকে মোবাইল ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তাঁর মামলা সম্পর্কে সহজেই জানতে পারবে।

করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এক ধরনের মহামারি বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত হওয়ার ফলে বাংলাদেশেও এর বিস্তার লাভ করে। একারণে গত ২৫ মার্চ ২০২০ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই তাৎক্ষনিক ছুটির ফলে কার্যত স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ প্রায় স্থিমিত হয়ে যায়। অনেকটা স্থবির হয় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম। এতে করে চলমান আদালতের কার্যক্রমও বন্ধ হয়। এক ধরনের সংকট তৈরির কারণে জরুরি বিচার মারাত্বক বাঁধাগ্রস্থ হতে থাকে। পরিস্থিতিজনিত যৌক্তিক কারণে ধাপে ধাপে ছুটি বর্ধিতকরণের ফলে সংকট আরও ঘনিভূত হয়। বিশেষ করে যে সব বিচারপ্রার্থী-আসামি-কয়েদি জামিন প্রাপ্ত হওয়ার উপযুক্ত কিম্বা জামিন আবেদন করতে আগ্রহী তাদের জন্যে এই উদ্ভূত পরিস্থিতি বড়ো ধরণের মানবিক প্রশ্ন হয়ে হাজির হয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধকল্পে দীর্ঘদিন ধরে আদালত বন্ধ থাকে। ফলে আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টজন ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্যে জোর দাবি উত্থাপন করেন। সঙ্গত কারণে সুপ্রিমকোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘ফুল কোর্ট সভা’ থেকে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারির জন্যে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। অনাহূত পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে গত ০৯মে, ২০২০ শনিবার ‘আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ-২০২০’ রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। এ বিষয়টি জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে। মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্তিতর্কগ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।

জারিকৃত অধ্যাদেশের ফলে যে আইন হয়েছে এর ধারা ০৫টি। ধারা সমূহে যা উল্লেখ রয়েছে তা হলো-

ধারা-০১, আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ নামে অভিহিত হয়ে সরকারি গেজেটে ০৯মে, ২০২০ তারিখ থেকেই আইনটি কার্যকর হয়েছে। ধারা-০২,উপধারা ০১ এ এই আইনের সংজ্ঞা রয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি ও ভার্চুয়াল উপস্থিতিকে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোনো কিছু না থাকলে এই অধ্যাদেশে ‘ভার্চুয়াল উপস্থিতি’ বলতে বুঝাবে অডিও-ভিডিও বা অনুরূপ অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে, কোনো ব্যক্তির আদালতের বিচার বিভাগীয় কার্যধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ। উপধারা ০২ এ অধ্যাদেশে ব্যবহৃত যে সকল শব্দ বা অভিব্যক্তির সংজ্ঞা এই অধ্যাদেশে প্রদান করা হয়নি, সেই সকল শব্দ বা অভিব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধিতে যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই অর্থে প্রযোজ্য হবে। ধারা-০৩ এর উপধারা-০১ অনুসারে এ আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছে। উপধারা-০১ অনুসারে ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো  আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, যেকোনো আদালত, এই অধ্যাদেশের ধারা-০৫ এর অধীন জারিকৃত প্রাকটিস নির্দেশনা সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিতক্রমে যে কোনো মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্তিতর্কগ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদান করতে পারবে। উপধারা-০১ এর অধীন অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসরণ করতে হবে বলে উপধারা-০২ বিবরণ দেওয়া।

ধারা-০৪ অনুসারে ভার্চুয়াল উপস্থিতি সশরীরে আদালতে উপস্থিতি বলে গণ্য হবে। ধারা-০৩ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা হলে  ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা অন্য কোনো আইনের অধীন আদালতে তা সশরীরে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতার শর্ত পূরণ হয়েছে বলে গণ্য হবে। ধারা-০৫ অনুসারে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টকে প্র্যাকটিস নির্দেশনা জারির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ধারা-০৩ এবং ০৪ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে,সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বা ক্ষেত্রমতো হাইকোর্টবিভাগ, সময় সময় নির্দেশনা জারি করতে পারবে। এই হচ্ছে মোটামুটি আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ এর মূল মর্ম।

এই আইনের ফলে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ১০মে,২০২০ রোববার ০৩ টি পৃথক আদেশে নির্দেশনা জানানো হয়েছে। ভার্চুয়াল আদালত কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে এর জন্যে প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের জন্যে ১৩ দফা, হাইকোর্টবিভাগের জন্যে ১৫ দফা এবং নি¤œ আদালতের জন্যে ২১ দফা সম্বলিত নির্দেশনা দিয়েছেন। নিম্ম আদালতে সবগুলো ফৌজদারি আদালত, হাইকোর্টের ০৩টি বেঞ্চ অতি জরুরি রিট ও দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলার জামিন, সম্পত্তি ও বিবাহ বিচ্ছেদসহ কিছু মামলার শুনানি হবে। ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছুটির সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলার জেলা ও দায়রাজজ, মহানগর এলাকার মহানগর দায়রাজজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, বিশেষ জজ আদালতের বিচারক, সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, দ্রæতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারককে এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজে অথবা তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক বা একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ এবং উচ্চ আদালতের জারিকৃত বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ অনুসরণ করে শুধুমাত্র জামিন শুনানি ভার্চুয়ালি করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

এই নির্দেশনার মুল বিষয়বস্তু হলো-ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার নিমিত্ত একটি ওয়েভ পোর্টাল চালু করা হয়েছে। ভার্চুয়াল ই-জুডিশিয়ারি এর ওয়েভ পোর্টাল হচ্ছে-(মাইকোর্ট.জুডিশিয়ারি.ওর্গ.বিডি)

সুপড়ঁৎঃ.লঁফরপরধৎু.ড়ৎম.নফ এই ভার্চুয়াল আদালতে আইনজীবী সেলফোনের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের সময় আইনজীবীর নাম, ছবি,ই-মেইল এডড্রেস দিতে হবে। যারা নিবন্ধন করবেন তাঁরা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পাবেন। পরবর্তীতে ইউজার আইডি এবং সরবরাহকৃত পাসওয়ার্ড ব্যবহারক্রমে ভার্চুয়াল কোর্টের ওয়েভ পোর্টালে লগইন করে প্রবেশ করতে হবে। প্রবেশ করার পর দেখা যাবে জামিন ও বেইলবন্ডের দু’টি ঘর রয়েছে। আবেদন ফি ছাড়াই ওকালতনামা ও সংযুক্ত কাগজপত্র ০৩ টি ধাপে আপলোড করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চসহকারী আবেদন বা দরখাস্তখানা শুনানিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। সংশ্লিষ্ট কোর্টের বিচারকের অনুমোদনের পর আইনজীবীকে ই-মেইলে জানানো হবে শুনানির তারিখ, সময়। এছাড়া সেলফোনে এলার্ট এসএমএস দেওয়া হবে। এছাড়া একটি ভিডিও লিংকও দেওয়া হবে। নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে ভিডিও লিংকে প্রবেশ করে আইনজীবী কনফারেন্সে সংযুক্ত হবেন বিচারকের সাথে। মামলার আবেদন বা দরখাস্ত শুনানি করবেন। জামিন প্রাপ্ত হলে বেইলবন্ড ভার্চুয়ালি দাখিল করবেন।

বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট দুর্যোগকালিন অবস্থায় চালু হলো। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেই ভার্চুয়াল আদালত রয়েছে। এমন কী আমাদের প্রতিবেশি দেশ ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানে আমাদের আগেই চালু করেছে। ভালো খবর বিচারপ্রার্থীদের জন্যে। অন্তত জরুরি বিষয়গলোর সুরাহা হবে। বিশেষ করে জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে। প্রায় ১৫৬ বৎসর পর এমন একটি যুগপোযোগী যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হওয়ার সুবিধা হলো-(০১) দুর্যোগ ও মহামারি সময়েও আদালত সীমিত পরিসরে অব্যাহত থাকবে; (০২) কারাগারে আটক আসামি-কয়েদির জামিন শুনানির সুযোগ; (০৩) সশরীরে উপস্থিত না হয়েই শুনানিতে পক্ষগণ ভার্চুয়ালি উপস্থিত হওয়া; (০৪)কাগজের ব্যবহার কমে যায়; (০৫)শুনানি বা নিষ্পত্তি হবে কম সময়ে; (০৬)তুলনামূলক ঘাটে ঘাটে খরচ কমে যাবে; (০৭)করোনাকালে বিচারকদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা বিদ্যমান (০৭) আরও অনেক সুবিধা হয়তো রয়েছে।

ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হওয়ায় অসুবিধা-(০১)আকস্মিকভাবে চালু হওয়া; (০২) বিচারক,আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টজনদের তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান; (০৩)আইনজীবীদের স্মার্ট ফোন বা ডিভাইস সংক্রান্ত টুলস এর অপ্রতুলতা কিম্বা এতৎবিষয়ে সীমাবদ্ধতা; (০৪)আইনজীবীদের পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা; (০৫)ইন্টারনেট সংযোগের ধীরগতি ও সংযোগ বিচ্ছিন্নতা; (০৬) বিদ্যুৎ সংযোগের ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা; (০৭) ভার্চুয়াল পোর্টাল বা সার্ভার ডাউন বা হ্যাং হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা; (০৮) সার্ভার হ্যাকারের কবলে পড়ে হ্যাক হওয়া; (০৯)তথ্যের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব; (১০)ওকালতনামা সংগ্রহ করে ক্লায়েন্টের স্বাক্ষর কারাগার থেকে নিয়ে আসা; (১১) বেইলবন্ড সংগ্রহ ও জামিনদারের স্বাক্ষর নেওয়া; (১২) ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির আশঙ্কা; (১৩)করোনাকালে আইনজীবী বা অ্যাডভোকেট ক্লার্কের কোনো সুরক্ষা নেই; (১৪)আরও নানাবিদ যক্কি-জামেলায় নিপতিত হওয়া।

কোভিট-১৯ মহামারি এই রোগ শুরু তা নিশ্চিত বলা যাবে না। গত ০৮ মার্চ, ২০২০ তারিখে রোগ নির্ণয় নিরীক্ষণে শনাক্ত হয় আমাদের দেশে। ফলে ২৫ মার্চ থেকে অদ্যাবধি সাধারণ ছুটি বহাল আছে। কবে স্পর্শকাতর এই মহামারির নিষ্পত্তি হবে তাঁর কোনো ইয়াত্তা বা হদিস নেই। গোটা পৃথিবী আজ ভাইরাসনামক এক ঘাতক দ্বারা আক্রান্ত। তদপুরি জীবন-জীবিকা তো আর থেকে থাকে না।

গত ২৩ এপ্রিল বৃহষ্পতিবার কোর্ট খোলার বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। যেখানে প্রত্যেক জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতকে সুবিধামতো প্রতি সপ্তাহের যে কোনো দু’দিন জরুরি জামিন শুনানির নির্দেশ দেওয়া হয়। কোর্ট চলাকালে কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয় প্রজ্ঞাপনে। পরবর্তীতে ২৭ এপ্রিল পূর্বের সিদ্ধান্ত আবার স্থগিত করা হয়। তৎপরবর্তীতে ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর নিমিত্ত বিদ্যমান এই আইন কার্যকর হয়। ইতোমধ্যেই সুপ্রিমকোর্টসহ সারাদেশে নিম্ন আদালতে ভার্চুয়ালি কার্যক্রম চালু হয়েছে। গত ১১মে,২০২০সোমবার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানির জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে দাখিল করা প্রথম রিট এটি। সারাদেশের কোনো কোনো আদালত ভার্চুয়ালি শুনানিক্রমে জামিন মঞ্জুর ও নামঞ্জুর আদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় বিচারপ্রার্থীদের আশাবাদের খবর এটি।

ভার্চুয়াল কোর্টের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি রয়েছে। হুট করে চাপিয়ে দেওয়া এই ব্যবস্থার প্রতি ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলার আইনজীবী সমিতি সভা করে সিদ্ধান্তগ্রহণ করেছেন, তাঁরা ভার্চুয়াল এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম হতে জানা যায়-ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা,গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, মেহেরপুর, নাটুর, যশোর, কুমিল্লা এবং আরও অনেক সমিতি এই ভার্চুয়াল ব্যবস্থার প্রতি অসম্মত রয়েছেন। তাঁরা চালুকৃত ভার্চুয়াল আদালতে অংশগ্রহণ করবেন না।

বিচার বিভাগ ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। এভাবেই মানুষ মনে করে। কিন্তু বিচার বিভাগ কী জনগণের সেই আস্থা ও ভরসার জায়গা হিসেবে তা ধরে রাখতে পারছে? সেদিকে নজর দিতে হবে। অনেকেই মনে করছেন ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের কার্যক্রম একেবারেই সন্তোষজনক নয়। যদি সন্তোষজনক হতো তাহলে বিচারক, আইনজীবী, সংশিষ্ট কর্মচারী এতোদিনে পরিপক্ষ হয়ে উঠতেন। কোনো আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর প্রশিক্ষণ বা কর্মশালা প্রদান করা হয়েছে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ ‘কাজীর গরু কিতাবেই’ আছে। ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের কাজ যথাযতভাবে হলেই আজকের এই ‘করোনা’ দুর্যোগ সময়ে চালুকৃত ভার্চুয়াল আদালতে সবার জন্যে সুবিধা হতো। ভার্চুয়াল আদালতে অধিকাংশ আইনজীবী অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ তাঁরা একেবারেই অনভ্যস্ত। ধীরে ধীরে হয়তো এক সময় সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন; তবে অনেক সময়ের ব্যাপার। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় কিছুটা ‘মনোপলি’ হয়ে যাবে ভার্চুয়াল বিচার কার্যক্রম। উপযুক্ত পরিবেশ, যান্ত্রিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ, উচ্চ গতির ইন্টারনেট ছাড়া কোনোভাবেই ভার্চুয়াল আদালতের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। তবে দেশের ভাবমূর্তি ও মানবাধিকারসহ নানা সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, তা হিসাব দেখানো যাবে বহির্বিশ্বে। প্রকৃত অর্থে কাজের কাজ হবে না। কার্যত যথাযত পদক্ষেপ এখনই না নিলে, ই-জুডিশিয়ারি ও ভার্চুয়াল আদালত ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ হিসেবেই দৃশ্যমান হবে।

লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, সিলেট