Cinque Terre

মুফতি মুহাম্মাদ আকতার আল-হুসাইন

২২ মে , ২০২০


লেখক : ইমাম ও খতিব ওল্ডহাম জামে মসজিদ, যুক্তরাজ্য 


সাদাকাতুল ফিতর : কখন ও কি দ্বারা আদায় করা

রামাদ্বান মাসের ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত হচ্ছে রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের দিন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে দুটি সময়ের কথা পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে- এক. ফজিলতপূর্ণ সময়। দুই. জায়েজ সময়।

ফজিলতপূর্ণ সময়-  ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের পূর্বে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদেরকে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দেন।’ 

সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ এর মধ্যে এসেছে- ‘হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজাদারের অনর্থক কথাবার্তা ও অশালীন আচরণের কাফফারাস্বরূপ এবং গরীব-মিসকীনদের আহারের সংস্থান করার জন্য সাদাকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে তা আদায় করে তা গ্রহণীয় দান। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর আদায় করে, তা হবে দানসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি দান।’ 

জায়েজ সময় - ঈদের একদিন বা দুদিন পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। তখন তা ওয়াজিব হিসেবেই আদায় হয়ে যাবে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা, আযাদ ও গোলামের পক্ষ হতে সাদাকাতুল ফিতর অথবা (বলেছেন) সাদাকাই রামাদ্বান হিসেবে এক সা’ খেজুর বা এক এক সা’ যব আদায় করা ফরজ করেছেন। অতঃপর লোকেরা অর্ধ সা’ গমকে এক সা’ খেজুরের সমান দিতে লাগল। (রাবী নাফি বলেন) ইবনে উমর (রাঃ) খেজুর (সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে) দিতেন। এক সময় মদীনায় খেজুর দুর্লভ হলে যব দিয়ে তা আদায় করেন। ইবনে উমর (রাঃ) প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকলের পক্ষ হতেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন, এমনকি আমার সন্তানদের পক্ষ হতেও সাদাকার দ্রব্য গ্রহীতাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং ঈদের এক বা দুইদিন পূর্বেই আদায় করে দিতেন।’

ঈদের নামাজের পর দিলে কি আদায় হবে? সাদাকাতুল ফিতর ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বেই আদায় করা মোস্তাহাব। যদি কোনো কারণবশত ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে না পারে তাহলে পরে হলেও আদায় করা ওয়াজিব। এটা কখনো নফলে পরিণত হবে না। (হেদায়া প্রথম খণ্ড)। ঈদের কতদিন পূর্বে ফিতরা আদায় করা যাবে? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ থাকলেও গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, রামাদ্বানের পূর্বে আদায় করলেও ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামী দ্বিতীয় খণ্ড)। কি দ্বারা আদায় করা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হতো, যেমন খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ 

হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর যুগে গমের ফলন বেড়ে যাওয়ায় গমকে আলোচিত চারটি পণ্যের সঙ্গে সংযোজন করা হয়। আর তখন গমের দাম ছিল বাকি চারটি পণ্যের তুলনায় বেশি। আর মূলত এই দাম বেশি থাকার কারণেই হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) গমকে ফিতরার পণ্যের তালিকাভুক্ত করেছিলেন। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে এক সা’ খাদ্যদ্রব্য বা এক সা’ খেজুর বা এক সা’ যব বা এক সা’ কিসমিস দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর যুগে যখন গম আমদানী হল তখন তিনি বললেন, এক মুদ গম (পূর্বোক্তগুলোর) দু’ মুদ এর সমপরিমাণ বলে আমার মনে হয় (আদায় করার নির্দেশ দিলেন)।’ 

বুখারী শরীফের আরো একটি হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা’ পরিমাণ খেজুর বা এক সা’ পরিমাণ যব দিয়ে আদায় করতে নির্দেশ দেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, অতঃপর লোকেরা যবের সমপরিমাণ হিসেবে দু’ মুদ (অর্ধ সা’) গম আদায় করতে থাকে’। 

উপরোক্ত হাদিসের মাধ্যমে আমরা মোট পাঁচ প্রকারের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করার কথা জানলাম। সেগুলো হচ্ছে- খেজুর, কিশমিশ, জব, পনির ও গম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে উপরোক্ত হাদিসে যে খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে তা সে দেশের প্রধান ও প্রচলিত খাদ্য দ্রব্য ছিল। তাই তা থেকে তারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতেন। হাদিসে বর্ণিত খাদ্যদ্রব্যের যে উল্লেখ রয়েছে তা উদাহরণ হিসাবে এসেছে নির্ধারণ হিসেবে নয়। তাই প্রত্যেক দেশের প্রধান ও প্রচলিত খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে। অতএব বাংলাদেশে যেহেতু খাদ্য হিসেবে চালের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে তাই চালের ফিতরা আদায় করা যাবে। তবে যবের উপর ক্বিয়াস করে ধানের ফিতরা দিলে আদায় হবে না। চালের ফিতরার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন- হযরত ইবনুল কাইউম (রহঃ)- (কিতাব ইলামুল মুয়াক্কেয়ীন এর দ্বিতীয় খণ্ডে)। হযরত আল্লামা উষাইমীন (রহঃ)-(কিতাব মাযমুআ ফাতাওয়া উষাইমীন আঠারতম খণ্ডে)। হযরত হাফিয আইনুল বারী (রহঃ)–(কিতাব সিয়াম ও রমযান)। মুদ্রা (টাকা) দ্বারা আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। 

তার দলীল-‘হযরত যুহাইর (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ইসহাক (রহঃ) থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তারা রামাদ্বানের সাদাকায়ে ফিতর খাবারের বিনিময়ে মুদ্রা (টাকা) দ্বারা আদায় করতেন। (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড, সনদ সম্পূর্ণ সহীহ তথা প্রমাণযোগ্য)’। 

হাদিসের পর্যালোচনা- কেউ কেউ মুদ্রা (টাকা) দ্বারা ফিতরা দেওয়া জায়েজ হবে না বলেন। কারণ হিসেবে উনারা বলতে চান উক্ত হাদিসের রাবী হযরত ইসহাক (রহঃ) শেষ বয়সে উম্মাদ হয়ে গেছিলেন! (নাউযুবিল্লাহ)। আসল কথা হলো তিনির শেষ বয়সে এসে সৃতি শক্তি কমে গিয়েছিল। আর এটা যে কারো হতে পারে বয়স ভাড়ার সাথে সাথে। আর তিনি এই হাদিস যখন বর্ণনা করেছেন তখন কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ সৃতি শক্তির মানুষ ছিলেন। আবার এই বানোয়াট অভিযোগ তুলে যদি উক্ত হাদিস বাধ দেওয়া হয় বা দুর্বল বলা হয় তাহলে উনি বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিস মিলিয়ে কমপক্ষে নয়টি হাদিস বর্ণনা করেছেন সেগুলো কি করবেন? অথচ বুখারী শরীফের যে ১২১ জন বর্ণনাকারী রয়েছেন সবাই গ্রহণযোগ্য এখানে কারো বিষয়ে কোন মুহাদ্দীসের কথা নেই। সুতরাং আমরা যদি বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিস গ্রহণ করতে পারি তাহলে অবশ্যই ইবনে আবি শায়বা এর হাদিসও গ্রহণ করতে পারি।

‘হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন, মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করার দ্বারা কোন সমস্যা নেই’। (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড)। হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ.) এর চিঠি- ভাবার্থ: ‘হযরত ইমাম ওয়াকী (রহঃ) কুররা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমরা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিয (রহঃ) নিকট সাদাকাতুল ফিতর সম্পর্কে একটি চিঠি নিয়ে আসলাম সেখানে লিখা ছিলো লোকজন সাদাকাতুল ফিতর আদায় করবে অর্ধ সা' অথবা তার সমমূল্যে অর্ধ সা' পরিমান দিরহাম দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করবে।’ (ইবনে আবি শায়বা দ্বিতীয় খণ্ড)। ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহঃ) তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা এর দ্বিতীয় খণ্ডে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে- فِي إِعْطَاءِ الدَّرَاهِمِ فِي زَكَاةِ الْفِطْرِ অর্থাৎ সাদাকায়ে ফিতর মুদ্রা (টাকা) দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে। ইমাম বায়হাকী (রহঃ) তার রচিত কিতাব সুনানুল কুবরা চতুর্থ খণ্ডে এই ভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে– এই অনুচ্ছেদ হলো মুদ্রা (টাকা) দ্বারা যাকাত আদায় করা অনুমোদিত। আল্লামা জাজীরী (রহ:) বলেন, ‘মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়েয বরং সর্বোত্তম। কেননা তাতে গরিব অসহায় মানুয়ের অধিক উপকার সাধিত হয়।’ (ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা প্রথম খণ্ড)। তবে মালিকী বা হাম্বলী মাযহাব মতে জায়েজ নেই। হযরত ইমাম বুখারী (রহঃ) এর মত সম্পর্কে হযরত ইবনে রশীদ রহঃ) বলেন, ‘ইমাম বুখারী (রহঃ) এ মাসআলায় টাকা দিয়ে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা হানাফীদের সাথে সহমত পোষণ করেছেন।’ (ফাতহুল বারী তৃতীয় খণ্ড)।

 হযরত ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) বলেন, ‘খেজুর, গম বা যব দিয়ে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা আবশ্যক নয়। বরং যদি এর মূল্য দ্বারা আদায় করা হয়, যা গরীবদের জন্য অধিক উপকারী, তবে তা জায়েজ আছে। কেননা, সাদাকার দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হলো গরীবদের দারিদ্রতা দূর করা এবং তার সেদিনের প্রয়োজন পূর্ণ করা’। (মাউসূআতু ফিক্বহি সুফিয়ান সাওরী)। সর্বোপরি মুদ্রা (টাকা) দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায়ের মত ব্যক্ত করেছেন, হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ), উমর বিন আব্দুল আজীজ (রহঃ), হযরত হাসান বসরী (রহঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ), ইমাম তাহাবী (রহঃ), ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াই (রহঃ) ও ইমাম আবু সাউর (রহঃ)। (যাকাতুল ফিতরি আহকামূহা ওয়া নাওয়াজিলুহা, মুহাম্মদ বিন আব্দুল গাফফার শরীফ কৃত)। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফেৎনা সৃষ্টি না করে সঠিক দ্বীন বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)